মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে অমর্ত্য সেনের মন্তব্যে চাপানউতোর রাজনৈতিক মহলে৷ তৃণমূল উচ্ছ্বসিত নোবেলজয়ীর মূল্যায়নে৷ বিরোধীরা খারিজ করছে তার বক্তব্য৷
ছবি: Matthew Lloyd/Getty Images for ReSource 2012/Getty Images
বিজ্ঞাপন
নোবেল বিজেতা বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন বরাবরই বিজেপির ঘোর সমালোচক৷ গেরুয়া শিবিরকে সমাজ, অর্থনীতির নানা প্রশ্নে অতীতে বিদ্ধ করেছেন তিনি৷ এবার সরাসরি বিজেপির বিরোধী কোনো নেতার প্রশংসা শোনা গেল ভারতরত্নের মুখে৷
সংবাদ সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অফ ইন্ডিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সেনকে প্রশ্ন করা হয়, মমতা কি দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারেন? নোবেলজয়ী বলেন, ‘‘এমন নয় যে তাঁর এই দায়িত্ব নেওয়ার ক্ষমতা নেই৷ তাঁর সেই ক্ষমতা রয়েছে৷ কিন্তু মমতা বিজেপির বিরুদ্ধে জনগণের হতাশার বিষয়গুলিকে এক ছাতার তলায় এনে বিভেদের রাজনীতির অবসান ঘটাতে নেতৃত্ব দেবেন, এটা এখনো প্রতিষ্ঠিত নয়৷''
খোদ পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী এ সম্পর্কে প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, অমর্ত্য সেনের উপদেশ তার কাছে আদেশের মতো৷ তৃণমূল সাংসদ শান্তনু সেনের বক্তব্য, ‘‘নরেন্দ্র মোদীকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারেন শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ বিধানসভা নির্বাচনে সেটা বোঝা গিয়েছে৷''
নোবেলজয়ীর মতামতকে উড়িয়ে দিয়েছে বিজেপি৷ বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদারের প্রতিক্রিয়া, ‘‘কেউ কোনো মন্তব্য করতেই পারেন৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী কেন, আমেরিকার রাষ্ট্রপতিও ভাবতে পারেন৷''
অমর্ত্যের দৃষ্টিভঙ্গিকে অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে করেন পর্যবেক্ষক শুভময় মৈত্র৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘লোকসভা ভোটে বিজেপি গরিষ্ঠতা না পেলে অন্যান্য দল সুযোগ পাবে৷ সেই বিকল্প জোটের নেতা হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম গুরুত্বের সঙ্গে উঠবে৷ এই যোগ্যতা বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর আছে৷''
যোগ্যতা থাকলেই কি কেউ প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে বসতে পারেন: নীলাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়
This browser does not support the audio element.
সাক্ষাৎকারে সেন অবশ্য বিকল্প জোটের চেহারা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন৷ কংগ্রেসের দুর্বলতার কথাও মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি, যদিও এই সময় জোর চর্চায় রাহুল গান্ধীর ‘ভারত জোড়ো' যাত্রা৷ কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্যের প্রতিক্রিয়া, ‘‘উনি যদি অনুগ্রহ করে কংগ্রেসের ইতিহাস দেখেন, তা হলে বোঝা যাবে এই দলে জোয়ার-ভাঁটা, ওঠা-নামা এসেছে৷ কংগ্রেসই পারে সারা দেশে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে৷''
বিজেপি বিরোধী শিবিরে আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে নেতৃত্বের প্রশ্নে প্রতিযোগিতা রয়েছে৷ আম আদমি পার্টি (আপ), ভারত রাষ্ট্র সমিতি (বিআরএস), সমাজবাদী পার্টি, শিবসেনা প্রভৃতি দলও নেতৃত্বের দাবিদার৷ অরবিন্দ কেজরিওয়ালের নেতৃত্বে আপ দুটি রাজ্যে ক্ষমতায়৷ মোদীর বিকল্প হয়ে ওঠার লক্ষ্যে বিআরএস নেতা কে চন্দ্রশেখর রাও বুধবার দিল্লিতে জনসভা করে বিজেপি বিরোধী নেতাদের একজোট করতে চাইছেন৷
এদের টপকে যাওয়ার জন্য বেশি আসনে জেতার পাশপাশি সবার আস্থা অর্জন করতে হবে মমতাকে, এমনটাই মত পর্যবেক্ষকদের৷ বিশ্লেষক নীলাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘যোগ্যতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রয়েছে৷ কিন্তু যোগ্যতা থাকলেই কি কেউ প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে বসতে পারেন? সবাইকে এক ছাতার নীচে আনা কঠিন৷'' যোগ্যতার প্রশ্নেও বিরোধীরা সন্দিহান৷ প্রবীণ বাম নেতা বিমান বসুর মন্তব্য, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী রাজ্য পরিচালনায় যে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে প্রধানমন্ত্রী হওয়া অসম্ভব বলেই মনে হয়৷''
পর্যবেক্ষকদের ধারণা, বিজেপি কম আসনে জিতলে কোন বিরোধী দল কত আসন পেল, সেটাই যোগ্যতার থেকে বড় হয়ে উঠবে৷ পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি লোকসভা কেন্দ্র থাকায় সেটা তৃণমূল নেত্রীকে এগিয়ে রাখবে৷ শুভময়ের মতে, ‘‘ভোটের আগে বিকল্প জোট সম্ভব নয়৷ ফল বেরোনোর পর বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সামনে সুযোগ আসতে পারে৷''
নরেন্দ্র মোদী নিজেই নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে অখণ্ড ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী আখ্যা দিয়েছেন৷ বাম নেতা জ্যোতি বসু মসনদের খুব কাছে পৌঁছেও পারেননি৷ মমতা কি বাঙালির সেই আক্ষেপ পূরণ করবেন?
নতুন বছরের আনন্দ নেই, আছে শুধু আন্দোলনের পথ
কলকাতা-সহ পুরো দেশ যখন নতুন বছরের খুশিতে মাতবে, তখনো এই মানুষগুলি রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করে যাবেন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
প্রতিবাদে, প্রতিরোধে
তারা কেউ ছয়শ দিন ধরে, কেউ ১৭০ দিন ধরে, কেউ ১৩৫ দিন ধরে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন। সরকার তাদের দাবি মানেনি। তা সত্ত্বেও আশায় বুক বেঁধে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে, চাকরি পাওয়ার আন্দোলন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
শহিদ মিনারের পাশে
“দাবি মোদের একটাই, যোগ্য লোকের চাকরি চাই” এমন নানান স্লোগানে মুখরিত ধর্মতলার শহিদ মিনারের পাশের এলাকা। আপার প্রাইমারি, গ্রুপ-ডি, মাদ্রাসার শিক্ষাকর্মী নিয়োগ, এরকম নানান ক্ষেত্রের চাকরিপ্রার্থীরা নিয়োগের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বেশ কিছুদিন ধরে অবস্থান করছেন। ২০২২-কে বিদায় ও ২০২৩-এর শুরুও তারা দেখবেন এই অবস্থানে বসে থেকেই।
ছবি: Subrata Goswami/DW
কবে মানা হবে দাবি?
গান্ধীমূর্তির পাদদেশে সাড়ে ছয়শো দিনেরও বেশি সময় ধরে অবস্থান করে আসছেন এসএসটির চাকরিপ্রার্থীরা। অযোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের প্রতিবাদে তারা আন্দোলনের পথ দেখিয়েছিলেন। তাদের দাবি মানা হয়নি। তাদের আন্দোলনও চলছে। চলবে নতুন বছরেও।
ছবি: Subrata Goswami/DW
লড়াই করে বাঁচা
সেই পথ অনুসরণ করে মাতঙ্গিনী হাজরার মূর্তির নিচে ১৯০দিন ধরে নিয়োগ দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। তারা আন্দোলন করে যাচ্ছেন। কলকাতা দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত আন্দোলনের শহর বলে। কলকাতার সেই আন্দোলনের ঐতিহ্য এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তারা।
ছবি: Subrata Goswami/DW
১৩৫ দিন ধরে
দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলনও ১৩৫ দিন অতিক্রান্ত। সাধারণ মানুষ যখন বর্ষশেষের উৎসবে মাতোয়ারা, সেইসময় চাকরির দাবিতে জীবনযাপনকে উৎসর্গ করেছেন এই চাকরিপ্রার্থীরা। প্রথম প্রথম মিডিয়া খবর করে। তারপর তারা থেকে যান খবরের বৃত্তের বাইরে। তখন শুধু দিন যোগ হয়। সামনের বছর কি এই সময়ে পাঁচশ দিন ধরে আন্দোলন করতে দেখা যাবে তাদের!
ছবি: Subrata Goswami/DW
তবু আশা নিয়ে
মাতঙ্গিনী হাজরার মুর্তির নীচে ৩২ দিন ধরে অনশন চালিয়ে আসছেন সুন্দরবনের প্রেমাংশু হালদার। কিছুদিন হলো বাবার ব্লাডক্যান্সার ধরা পড়েছে। আপার প্রাইমারির প্রার্থী, আটবছর ধরে চাকরির আশায় থেকে থেকে দিন মজুরের কাজ শুরু করেছিলেন। এখন অনশন-প্রতিবাদ চলছে। যদি তার কথা পৌঁছয় কর্তাদের কানে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নিয়োগপত্র চাই, না হলে আব্দোলন
বিকেল গড়াতে না গড়াতেই মশার উপদ্রবে বসা দুষ্কর হয়ে ওঠে। তবু হাল ছাড়েননি এই আন্দোলনকারীরা। এসএসসি আন্দোলনকারীদেরই একজন শহিদুল্লাহ জানালেন, নিয়োগপত্র হাতে পেলে সেটাই হবে আমাদের উৎসব। যতক্ষণ না হাতে পাচ্ছি, বড়দিন, নতুন বছর সবই আমাদের কাছে অর্থহীন।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আসা-যাওয়ার মাঝখানে
নদীয়ার হরিনঘাটা অঞ্চলে বাড়ি মেহেবুবা খাতুনের। চার বছরের কন্যা সন্তানকে নিয়ে প্রতিদিন সকাল এগারোটায় এই ধর্ণামঞ্চে এসে পৌঁছনোর জন্য বাড়ি থেকে সকাল সাতটায় রওনা দেন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত আটটা বাজে। এভাবেই চলছে। জানেন না আর কতদিন এভাবে থাকতে হবে। তার জীবনে কোনো উৎসব নেই। আছে শুধু যাওয়া-আসা এবং প্রতিবাদ জানানো।
ছবি: Subrata Goswami/DW
আশার আলো নিভে গেলো
৩০ জানুয়ারি ২০১৪ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েও আপার প্রাইমারিতে একবার নিয়োগ বাতিল। এক নিয়োগে দু-দুবার ইন্টারভিউ সম্পন্ন করেও আজ নিয়োগ অধরা। অবস্থানকারীদের দাবি- তারা বঞ্চিত, ইন্টারভিউয়ের ডাক পাননি। দীর্ঘ আট বছরে শূন্যপদ বৃদ্ধি হয়নি। গেজেট মেনে ইন্টারভিউ ১৫ দিন আগে পর্যন্ত সমস্ত শূন্যপদ বৃদ্ধি করে তাদের ইন্টারভিউ ডাকতে হবে।
ছবি: Subrata Goswami/DW
অন্য পথ নেই
গ্রুপ-ডির আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, ঘোষিত শূন্যপদে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী অধীনে দপ্তর, তবুও তারা আজ নিয়োগের দাবিতে রাজপথে অবস্থানে। এছাড়া তাদের কাছে আর কোনো রাস্তা নেই।
ছবি: Subrata Goswami/DW
নতুন বছরে
তাদের এই মরিয়া প্রয়াস কি নতুন বছরে সফল হবে? তাদের কি দাবিপূরণ হবে? রাজপথে আন্দোলনের জীবন থেকে তারা কি পৌঁছতে পারবেন চাকরির জীবনে? নতুন বছর তাদের জন্য কী খবর নিয়ে আসবে তা জানা নেই, তবে তারা একটা কথা জানেন, বছর ঘুরে যায়, তবু দিন বদলায় না। তবু, সফল হওয়ার আশাটুকু নিয়ে তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, যাবেনও।