অমর একুশে বইমেলা: আমাদের সবেধন নীলমণি
৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪আগের শতকের বাহাত্তরের ফেব্রুয়ারি মাসে একাডেমি প্রাঙ্গণে বটের তলে চট বিছিয়ে বই প্রদর্শন শুরু করেন প্রকাশক চিত্তরঞ্জন সাহা৷ যেখানে একাত্তরে প্রতিষ্ঠিত তার প্রকাশনা মুক্তধারার ৩২টি বই উপস্থাপিত হয়৷ সেখানে এবারের বইমেলায় ৭ ফেব্রুয়ারি বুধবার একটি দিনেই প্রকাশিত নতুন বইয়ের সংখ্যা ৬৯টি৷
চিত্তরঞ্জন সাহার হাত ধরে যার সূচনা- যা সময়ের পরিক্রমায় বাংলা একাডেমির অমর একুশে গ্রন্থমেলা হিসেবে রূপ পায়, তার পরিসর যে দিনে দিনে বড় হয়েছে তা সংখ্যা আর জায়গা দিয়ে সহজেই মাপা যায়৷ গত কয়েক বছরে বইমেলা একাডেমির নিজের গণ্ডি ছাড়িয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছড়িয়ে গেছে৷ তাতে কমেনি পাঠকের ভিড়, বরং বেড়েছে৷ বেড়েছে প্রকাশক ও বইয়ের সংখ্যাও৷ এবারের মেলায় অংশ নিয়েছে ৬৩৫ প্রতিষ্ঠান৷ যেখানে আগের বছর প্রতিষ্ঠান সংখ্যা ছিলো ৬০১৷ গতবার বই বিক্রি হয়েছে ৪৭ কোটি টাকার৷ তার আগে তথা ২০২২ সালে টাকার অঙ্ক বেশি ছিলো, যার পরিমাণ ৫২ কোটি৷ তখন নতুন বই প্রকাশ হয় তিন হাজার ৪১৬টি৷ ২০২৩ সাল আবার সেই তুলনায় এগিয়ে, কারণ বইয়ের সংখ্যা ছিলো তিন হাজার ৭৫০৷
গ্রেগরিয়ান বর্ষপঞ্জির সবচেয়ে ছোট্ট মাসে যদি সাড়ে তিন হাজারের বেশি সৃজনশীল-মননশীল বই বের হয়, তবে বছরের বাকি ১১ মাস প্রকাশিত বই সংখ্যা কত? এমন প্রশ্নে সময় প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘বাংলাদেশে বইমেলাকে কেন্দ্র করেই ৮০-৯০ শতাংশ সৃজনশীল বই প্রকাশিত হয়৷ সারাবছর নতুন বই তেমন প্রকাশিত হয় না৷ তবে বইমেলা সামনে রেখেই সারাবছর ব্যস্ত থাকতে হয়৷ ফেব্রুয়ারিতে বইগুলো প্রথম মার্কেটিং করা হয়৷ তারপর সারাদেশে মার্কেটিং করা হয়৷'
তবে একুশে বইমেলায় প্রকাশকদের চেয়ে বেশি সুযোগ থাকে পাঠকদের জন্য- এমনটা মনে করছেন বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সবশেষ কমিটির সভাপতি ফরিদ আহমেদ৷ তিনি বলছেন, মেলায় কয়েক লাখ শিরোনামের বই একই সঙ্গে ঘুরে দেখতে পারেন পাঠক৷ কোনো দোকানে গিয়ে এতো বই দেখা বা পছন্দ করার সুযোগ থাকে না৷
শুধু প্রকাশক নন, অনেক লেখকও বইমেলা সামনে রেখেই লেখালেখি করেন৷ ফেব্রুয়ারি মাসজুড়ে বই নিয়ে নানা প্রচারণায়ও দেখা যায় তাদের৷ এক্ষেত্রে সক্রিয় একজন লেখক তৌহিদুর রহমান৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলছেন, এখন অবধি তার ৪৫টি বই বের হয়েছে৷ এরমধ্যে একটি মাত্র বই প্রকাশিত হয়েছে বইমেলার বাইরে অন্য সময়ে৷ তার দাবি, বইয়ের প্রচারণার ক্ষেত্রে যে খরচ, সেটা প্রকাশক করে থাকেন৷ কিছু ক্ষেত্রে খরচ তিনিও বহন করেন৷
বইমেলার বাইরে বই নিয়ে পাঠকদের আগ্রহ নিয়ে হতাশার কথাই বললেন তৌহিদুর রহমান৷ তার ভাষ্যমতে, এটা বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্য যে বইমেলায় পাঠকদের বিশাল সাড়া থাকলেও শুধু পাঠক নন, প্রকাশক ও বই সংশ্লিষ্ট সবাই সারাবছর ঝিমিয়ে থাকেন৷ বই নিয়ে বছরব্যাপী ক্যালেন্ডার থাকা উচিৎ বলে তিনি মনে করেন৷
শুধু বইমেলা নয়, সারাবছরই সৃজনশীল-মননশীল বইয়ে চোখ রাখেন ঢাকার বাসিন্দা তানিয়া আক্তার৷ তিনি বলেন, বছরের অন্যান্য সময় বই কিনতে হলে আগে অনলাইনে খোঁজ করতে হয়৷ কিন্তু বইমেলায় একই সঙ্গে অনেক প্রকাশনা থাকে বলে সুবিধা হয়৷ এখন বেঙ্গল বই, বাতিঘরের মতো বিক্রয়কেন্দ্র হওয়ায় তেমন সুবিধা সারাবছর কিছুটা মিলছে বলে তিনি মনে করেন৷
বাংলা একাডেমি লক্ষ্যে আছে তো?
একুশে বইমেলার মাধ্যমে বই যাতে পাঠকের কাছে যায়, লেখক যাতে পাঠকের কাছে পরিচিত হতে পারেন- বইমেলা নিয়ে এই প্রত্যাশার কথা ডয়চে ভেলেকে বললেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন৷ তবে তিনি বলছেন, ‘‘বইমেলা সামনে রেখে আমি লেখালেখি করি না৷ আমি সারাবছর নিজের লেখালেখি ঠিকমতো করি৷ বই সারাবছর প্রকাশও হয়ে যায়৷’’
এদিকে বইমেলার আয়োজক বাংলা একাডেমি নিজেই ওয়েবসাইটে লিখেছে, তাদের প্রধান লক্ষ্য- বাংলা ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে গবেষণা, প্রকাশনা ও অনুবাদের মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক জাতি গঠনে ভূমিকা রাখা৷ একুশে বইমেলা আয়োজন এক্ষেত্রে কী ভূমিকা রাখছে, জানতে চাইলে বাংলা একাডেমির সভাপতি সেলিনা হোসেন বলেন, মাতৃভাষার চর্চার ক্ষেত্রে পাঠকের হাতে লেখকের বই তুলে দিয়ে ভূমিকা রাখছে৷ বইমেলার আয়োজন নিয়ে ব্যস্ততায় একাডেমির অন্যান্য কাজে বিঘ্নিত হয় না বলে তিনি দাবি করেন৷