অমর একুশে বইমেলার তিনটি পর্যায় খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় আমার৷ নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মেলা যখন মেলা হয়ে উঠছে, তখনই এই দেখার শুরু৷ এর আগে আশির দশকের মাঝামাঝিও মেলায় আসা হয়৷ তারপর আবার ২০১৪ সাল থেকে৷
বিজ্ঞাপন
আশির দশকের ওই সময়টায় আমি কলেজের ছাত্র এবং থাকি ঢাকার অদূরের একটি জেলা শহর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়৷ সকালের ট্রেনে ঢাকায় এসে মেলা ঘুরে রাতেই ফিরে যেতে পারতাম আমরা৷ নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে আসতাম আরো দূরের শহর চট্টগ্রাম থেকে৷ তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি এবং দলেবলে বছরে অন্তত একবার ঢাকায় আসি সেটা বইমেলার সময়৷ অপার কৌতূহল নিয়ে আসতাম বইমেলায়৷ আসা-যাওয়া এবং থাকা-খাওয়ার খরচেই আমার পকেটের টাকা ফুরিয়ে যেত, বই কেনা হতো না খুব একটা৷ তবু আমরা আসতাম এবং যতদিন বেশি সম্ভব থাকতাম ঢাকায়৷ কেননা, ততদিনে একুশের বইমেলা প্রকাশকদের কাছে তো বটেই, যাঁদের লেখালেখির অভ্যাস আছে, যাঁরা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশ করেন এবং যাঁরা বই পড়তে ভালোবাসেন, তাঁদের সবার কাছে সারা বছরের সবচেয়ে বড় উৎসবে পরিণত হয়েছে৷ নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে মেলাটি প্রকৃতই মেলার রূপ পেয়েছিল৷ তবে এর একটা মন্দ দিক ছিল, বইয়ের চেয়ে বারোয়ারি পণ্যই মেলায় গুরুত্ব পেতে শুরু করেছিল৷
মেলার বাইরে বইয়ের মেলা
রাজধানী ঢাকার কয়েকটি জায়গায় গড়ে উঠেছে বইয়ের আধুনিক কিছু দোকান৷ শুধু বই কেনাই নয়, লেখক-পাঠকদের জন্য নানান আয়োজনও আছে নতুন এ সব বইঘরে৷ ঢাকার এ রকম কয়েকটি বইয়ের জগত দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: Abdullah Al Momin
পাঠক সমাবেশ সেন্টার
ঢাকার শাহবাগে আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটের বিপরীতে অগ্রণী ব্যাংকের দ্বিতীয় তলায় বৃহৎ বইয়ের দোকান ‘পাঠক সমাবেশ সেন্টার’৷
ছবি: Abdullah Al Momin
বই প্রেমীদের নতুন ঠিকানা
পাঠক সমাবেশ সেন্টার কেবল বইয়ের বিক্রয় কেন্দ্রই নয়, এখানকার বইয়ের জগতে অন্তত একবেলা সময় সাচ্ছন্দে সময় কাটাতে পারেন বইপ্রেমীরা৷
ছবি: Abdullah Al Momin
নানা আয়োজন
শুধু বই কেনা-বেচাই নয়, বইকেন্দ্রিক নানা অনুষ্ঠান, প্রকাশনা উৎসব, পাঠচক্র, সাহিত্য আড্ডা দেয়ারও চমৎকার জায়গা শাহবাগের এই পাঠক সমাবেশ সেন্টার৷
ছবি: Abdullah Al Momin
দীপনপুর
রাজধানীর কাটাবন মোড়ে আরেক বইয়ের জগত ‘দীপনপুর’৷ ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে জাগৃতি প্রকাশনীর কার্যালয়ে জঙ্গি হামলায় নিহত হয়েছিলেন প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন৷ গত বছর তাঁর ৪৫তম জন্মদিনে যাত্রা শুরু হয় এই বইঘরটির৷
ছবি: Abdullah Al Momin
দীপনের স্মৃতি
দীপনের মৃত্যুর পর তাঁর সহধর্মিনী ডা. রাজিয়া রহমান জলি স্বামীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে চালু করেন এই বইয়ের দোকান৷ জাগৃতির হাল ধরার পাশাপাশি দীপনের স্মৃতি ও চেতনাকে ধরে রাখতেই তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ভিন্নধর্মী এই বুকশপ ক্যাফে৷
ছবি: Abdullah Al Momin
শিশুদের জন্য ‘দীপান্তর’
দীপনপুরে শিশু-কিশোরদের জন্য রয়েছে ‘দীপান্তর’৷ শিশুরা এখানে পড়তে পারবে বই, আঁকতে পারবে ছবিও৷ পাশাপাশি আছে খেলাধুলা করার ব্যবস্থা৷
ছবি: Abdullah Al Momin
দীপনপুরের যত আয়োজন
দীপনপুরে বই পড়তে পড়তে চুমুক দেয়া যাবে চা কিংবা কফির পেয়ালায়৷ প্রয়োজনীয় বইটি না থাকলে অর্ডার সাপেক্ষে যথাসময়ে বাড়িতে পৌঁছে যাবে৷ এছাড়া ক্রেতারা অনলাইনেও বই কিনতে পারেন দীপনপুর থেকে৷
ছবি: Abdullah Al Momin
বাতিঘর
ঢাকার বাংলা মোটর এলাকায় বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অষ্টম তলায় চালু হয়েছে বইঘর ‘বাতিঘর’৷ ৫০০০ বর্গফুট জায়গাজুড়ে এ বইয়ের জগতে আছে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির নানা শাখার বিষয়াবলীর পাশাপাশি খেলাধুলা, রাজনীতি ও সমকালীন বিজ্ঞান, দর্শন আর লোকসংস্কৃতির উপর রচিত লক্ষাধিক বইয়ের সংগ্রহ৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা
২০০৫ সালে চট্টগ্রামে ছোট পরিসরে যাত্রা শুরু করেছিল বাতিঘর৷ ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব ভবনে তিন হাজার বর্গফুটের বড় পরিসরে পুরনো জাহাজের আদলে সম্প্রসারিত হয় বাতিঘর৷ ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় আরো বড় পরিসরে চালু হলো বাতিঘরের দ্বিতীয় শাখা৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
বইয়ের ভাণ্ডার
ঢাকার বাতিঘরে প্রায় শতাধিক বিষয়ের ১০ হাজার লেখক ও এক হাজার দেশি-বিদেশি প্রকাশনা সংস্থার লক্ষাধিক বইয়ের বিষয়ভিত্তিক বৈচিত্র্যপূর্ণ সংগ্রহ রয়েছে৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
নানান কর্নার
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাতিঘরে আছে বিষয় ভিত্তিক কর্নার৷ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘ভ্রমণ ও প্রবন্ধ কর্নার’, ‘কবিতা কর্নার’, ‘দর্শন কর্নার’,‘শীর্ষেন্দু-সুনীল-সমরেশ কর্নার’, ‘মুহম্মদ জাফর ইকবাল কর্নার’ ‘ছোটগল্প কর্নার’, ‘ইতিহাস কর্নার’ ‘রহস্যগল্প কর্নার’ ইত্যাদি৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
বেঙ্গল বই
রাজধানীর ধানমণ্ডিতে দেশি-বিদেশি বই বিকিকিনির সাথে পড়ুয়াদের এক নতুন আড্ডাস্থল ‘বেঙ্গল বই’৷ গল্প, উপন্যাস থেকে শুরু করে এখানে মিলবে শিল্পকলা, সাহিত্য, স্থাপত্যবিষয়ক বইও৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
বিশাল আয়োজন
বেঙ্গল বইয়ের তিন তলা ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলা জুড়ে আছে দেশি-বিদেশি বই৷ নিচতলায় সব শ্রেণির পাঠকের জন্য আছে পুরনো বই ও ম্যাগাজিন৷ দোতলার বারান্দায় বসে কফি খেতে খেতে গল্প করার ব্যবস্থাও আছে৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
নানা আয়োজন
বেঙ্গল বই-এ নিয়মিত পাঠচক্র, কবিতা পাঠের আসর, নতুন লেখা ও লেখকের সঙ্গে পরিচিতিমূলক সভা, প্রকাশনা উৎসব, চিত্র ও চলচ্চিত্র প্রদর্শনীসহ নানা আয়োজন থাকে৷ অসুস্থ বা প্রতিবন্ধীরা হুইলচেয়ারে পুরো জায়গা ঘুরে নিজের পছন্দমাফিক বই কিনতে পারবেন৷ প্রবীণদের জন্য রয়েছে বইয়ে বিশেষ ছাড় এবং বাগানে বসে আড্ডা দেওয়ার ব্যবস্থা৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
আকাশকুসুম
বেঙ্গল বই ভবনের তিনতলার প্রায় পুরোটাই শিশুদের জন্য৷ ‘আকাশকুসুম’ নামে সেই রাজ্যে শিশুবান্ধব পরিবেশে বইপড়া ছাড়াও গল্পবলা, আবৃত্তি, ছবি দেখা ও আঁকাআঁকির মধ্য দিয়ে শিশুরা হারিয়ে যেতে পারবে অন্য জগতে৷
ছবি: DW/Abdullah Al Momin
15 ছবি1 | 15
নব্বইয়ের দশকের শেষে বারোয়ারি মেলাটিকে যখন শুধুই বইয়ের মেলায় রূপান্তরের উদ্যোগ নেওয়া হয়, তখন ‘ভোরের কাগজ' পত্রিকার একজন রিপোর্টার হিসেবে ‘মেলার প্রতিবেদন' লিখে বইপ্রেমীদের জানাচ্ছি আমি৷ পরে টানা সাত বছরের মতো একই কাজ করেছি ‘প্রথম আলো'-য়৷ তবে ২০১৪ সালে মেলাটিকে যখন বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণের বাইরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে বিশাল বিস্তৃতি দেওয়া হয়েছে, তখন থেকে মেলার সঙ্গে আমার দেখাদেখিতে একটু ভাটা পড়েছে৷ মাঝে অবশ্য নিজেই একটি প্রকাশনা সংস্থা গড়ার চেষ্টা করে বিফল হয়েছি৷ বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প বহুদিন ধরে বইমেলাকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে, ফলে মাঝের ওই সময়টাতেই আমি প্রবলভাবেই বইমেলায় উপস্থিত ছিলাম৷ নানান ভূমিকায় বইমেলাকে দেখার কারণে মেলা নিয়ে আমার অবস্থা হয়েছে সবজান্তা শমসেরের মতো৷ বোধ হয় এই কারণেই ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে আবেদন হারিয়েছে বইমেলা৷ অথচ একদা ফেব্রুয়ারি মাসে এমন দিন ছিল দুর্লভ, যেদিন একেবারে শেষবেলায় হলেও মেলার আড্ডায় হাজির হইনি৷ ‘ভোরের কাগজ' থেকে ‘প্রথম আলো'-য় বইমেলা নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন লিখতে হয়েছে আমাকে৷ এই কাজের জন্য প্রায় প্রত্যেকদিনই মেলা শুরু হতে না হতেই মেলা প্রাঙ্গণে প্রবেশ করেছি আমি৷ খবর সংগ্রহ করে অফিসে ফিরেছি, প্রতিবেদন জমা দিয়ে একেবারে শেষবেলায় আবার মেলায় ফিরে গেছি৷ মেলা ভেঙে যাওয়ার পর বন্ধুরা মিলে আড্ডা দিয়েছি, মেলার বাইরে, বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তায়, টিএসসিতে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে৷
এখন আর মেলার আড্ডায় ওই টান পাই না৷ আড্ডা কি তাহলে ‘কম বয়সের কথকতা'? নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে মেলা করতে আসার কথা আগেই বলেছি৷ একবার, সেটা সম্ভবত ১৯৯৪ সালের কথা, আমরা তিন বন্ধু শাহীনুর রহমান, রোকন রহমান ও আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে প্রায় পুরো ফেব্রুয়ারিটাই ঢাকায় কাটিয়ে দিয়েছিলাম৷ তখন মেলা ছাড়া ঢাকার অন্য কোথাও যাইনি বললেই চলে৷ মেলার তোরণ উন্মুক্ত হতে না হতেই আমরা উপস্থিত হয়ে যেতাম মেলার মাঠে৷ প্রায় একই সময়ে আসতেন হুমায়ুন আজাদ৷ মাঝেমধ্যে আমাদের তিনজনের সঙ্গে যোগ দিত, ঢাকার বন্ধু শিশুসাহিত্যিক রুদ্রাক্ষ রহমান৷ বন্ধুমহলে ফজলু নামে পরিচিত রুদ্রাক্ষ রহমানের সঙ্গে হুমায়ুন আজাদের ছিল অম্লমধুর সম্পর্ক৷ আমরা গিয়ে বসতাম বর্ধমান হাউস সংলগ্ন আম গাছটির নীচে এবং তার বিপরীতেই ছিল আগামী প্রকাশনীর স্টল৷
প্রাণের মেলা – অমর একুশে গ্রন্থমেলা
ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি৷ আর এই ভাষার মাস মানেই হলো একুশে বইমেলা৷ তাই অবরোধ-হরতালের মধ্যেই ১লা ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলন দিয়ে শুরু হয়ে গেছে মেলা৷ গ্রন্থমেলায় এ বছর মোট ৩৫১টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিচ্ছে৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
অস্থিরতার মধ্যেও চলছে বইমেলা
বাংলাদেশে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই চলছে মাসব্যাপী অমর একুশে গ্রন্থমেলা৷ তবে বাঙালির প্রাণের মেলা হিসেবে খ্যাত বইপ্রেমীদের এ মিলনমেলায় বিএনপি ও সমমনা ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধ আর হরতাল কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলেছে৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
সপ্তাহান্তে গ্রন্থমেলায় ভিড়
ছুটির দিনে অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইপ্রেমীদের ভিড়৷ অবরোধ সত্ত্বেও ছুটির দিনগুলোতে বইমেলা প্রাণ ফিরে পায়৷ পুরো বাংলা একাডেমি চত্বর আর সোহরাওয়ার্দি উদ্যান প্রাঙ্গণ দর্শনার্থীদের পদচারনায় মুখরিত৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
সর্বদা তটস্থ ব়্যাব-পুলিশ
অমর একুশে গ্রন্থমেলার প্রবেশ পথে এক দর্শনার্থীর ব্যাগ তল্লাশি করছে পুলিশ৷ হরতাল-অবরোধের সময় অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে মেলা প্রাঙ্গণে তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ প্রতিটি প্রবেশ পথে আর্চওয়ে, মেটাল ডিটেক্টর ছাড়াও আছে ব়্যাব ও সাদা পোশাকে পুলিশের টহল৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
‘আমরা তোমায় ভুলবো না...’
বইমেলায় বরাবরের মতো এবারও প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের দারুণ কদর৷ মেলার সোহরাওয়ার্দি উদ্যান প্রাঙ্গণে ‘অন্য প্রকাশ’-এর প্যাভিলিয়নের ওপরে স্থাপন করা হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের বড় প্রতিকৃতি৷ পোস্টার আকারে তাঁর ছবিও রয়েছে জায়গায় জায়গায়৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
বিরাট প্যাভিলিয়ন
সোহরাওয়ার্দি উদ্যান প্রাঙ্গণে ‘ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড’-এর দৃষ্টিনন্দন প্যাভিলিয়ন৷ গত বছর বাংলা একাডেমি থেকে মেলার পরিসর সোহরাওয়ার্দি উদ্যান পর্যন্ত বাড়ানোর পর, এ বছর যোগ হয়েছে বড় আকারের প্যাভিলিয়ন৷ দেশের পুরনো ও বড় প্রকাশকরা পেয়েছেন এ সব জায়গা৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
শিল্পীরাও আছেন
অমর একুশে গ্রন্থমেলার সামনের সড়কের ফুটপাথে এক দর্শনার্থীর প্রতিকৃতি আঁকছেন একজন শিল্পী৷ বইমেলার প্রবেশ পথে কয়েকজন শিল্পী মেলায় আসা দর্শনার্থীদের নানাভাবে মুখচ্ছবি এঁকে দেন৷ এ জন্য ৩০০ থেকে ১০০০ টাকা খরচ হয়৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
গ্রন্থমেলায় টিভি চ্যানেল
বইমেলা প্রাঙ্গণ থেকে মেলা সম্পর্কিত খবরাখবর টেলিভিশন চ্যানেলগুলো সরাসরি সম্প্রচার করে৷ নতুন বইয়ের খবর, লেখকদের সাক্ষাৎকার, পাঠকদের প্রতিক্রিয়াসহ নানান বিষয় ফুটিয়ে তোলে এ সব চ্যানেল৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
ব্যস্ত নজরুল মঞ্চ
বাংলা একাডেমি চত্ত্বরের নজরুল মঞ্চ৷ পুরো বইমেলায় এ মঞ্চ সরগরম রাখে অসংখ্য নতুন বইয়ের মোড়ক উম্মোচনের অনুষ্ঠান৷ এ বছর মেলা প্রাঙ্গন পরিচ্ছন্ন রাখার ব্যাপারেও বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে৷ সেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘সুইচ’-এর সদস্যরা এ কাজে সদা সজাগ৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
অগুন্তি বই, অনেক পড়ুয়া
অমর একুশে গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণে একটি বোর্ডে টাঙানো নতুন বইগুলোর প্রচ্ছদ৷ বইমেলার ১৫তম দিনে তোলা এ ছবিটি৷ এদিন মেলায় নতুন বই আসে ৭১টি৷ সেদিন পর্যন্ত এবারের একুশে বইমেলায় দুই হাজারেরও বেশি নতুন বই প্রকাশিত হয়৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
‘শিশু প্রহর’
বইমেলার একটি স্টলে অভিভাবকদের সঙ্গে পছন্দের বই দেখছে একটি শিশু৷ সপ্তাহের দুটি দিনের কিছু সময় শিশুদের জন্য বরাদ্দ৷ শুক্র ও শনিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত চলা ‘শিশু প্রহর’ শুধু শিশুদেরই জন্য৷ তবে শিশুদের সঙ্গে অভিভাবকরাও আসতে পারেন৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
বই দেখুন, বই পড়ুন
একটি স্টলে দর্শনার্থীরা বই দেখছেন৷ মেলায় আসা প্রকাশকরা তাঁদের স্টলগুলো এমনভাবে সাজিয়েছেন, যাতে দর্শকরা ভালোভাবে বই পরখ করতে পারেন৷ বই দেখার ছলে অনেকে অবশ্য বইয়ের বেশ খানিকটা অংশ পড়েও নেন৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
অটোগ্রাফ নেয়ার ধুম
গ্রন্থমেলা প্রাঙ্গণে অটোগ্রাফ শিকারীদের কবলে জনপ্রিয় লেখক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল৷ একমাত্র বই মেলাতেই প্রিয় লেখককে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান পাঠকরা৷ তাই প্রিয় লেখকের অটোগ্রাফ নেয়ার সুযোগ ছাড়েননা অনেকেই৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
বইমেলা তারুণ্যের প্রতীক
বইমেলা শুধু প্রাণের মেলাই নয়, এখন বাঙালির সার্বজনীন উৎসবও এটি৷ সেজেগুজে নানা পোশাকে তাই দর্শনার্থীদের ঘুরে-বেড়াতে দেখা যায়৷ ছবিতে মেলা প্রাঙ্গণে সেলফি তুলছে একদল তরুণ বইপ্রেমী৷ বইমেলা অবশ্য তরুণদের পদচারণাতেই সবচেয়ে বেশি মুখর থাকে৷
ছবি: DW/Mustafiz Mamun
13 ছবি1 | 13
ফজলু এলে হুমায়ুন আজাদ স্যারের সঙ্গে আমাদের খুনসুটি ভালো জমত৷ পাঠকের ভিড় জমে যাওয়ার আগে আজাদ স্যারের সঙ্গে আড্ডা দিতে পারার সুযোগ ব্যক্তিগতভাবে আমাকে সমৃদ্ধ করেছে, তবে ওই আড্ডা এখানে প্রাসঙ্গিক নয়৷ সেবারই মেলায় বরিশালের হেনরী স্বপনের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলো আমাদের৷ আমরা একে একে সবাই ঢাকায় চলে এলেও হেনরী রয়ে গেছে তার প্রিয় শহর বরিশালে৷ চিঠিপত্রে আগে থাকতে যোগাযোগ থাকলেও সেবারই সাক্ষাৎ-পরিচয় হলো ময়মনসিংহের মুজিব মেহদী, আশরাফ রোকন ও নেত্রকোনার মাহবুব কবিরের সঙ্গে৷ কবির হুমায়ুন, মুজিব ইরম, শাহেদ কায়েস, নজরুল কবীর প্রমুখের সঙ্গে বন্ধুত্ব ছিল আগে থাকতেই, সেবার বন্ধুত্ব নিবিড় হলো৷ নজরুলের মাধ্যমে পরিচয় হলো আহমাদ মোস্তফা কামালের সঙ্গে৷ আমি যে সময়টার কথা বলছি, তখন বইমেলা ছিল দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা তরুণ লেখকদের অপরিচয়ের ব্যবধান ঘুচিয়ে আনার একটা ক্ষেত্রও৷
বইমেলার সঙ্গে আমার সম্পর্ক আরও নিবিড় হলো তারও কয়েক বছর পর ১৯৯৮ সালে৷ সেবার ‘ভোরের কাগজ' পত্রিকায় চাকরি পাওয়ার পরীক্ষা দিচ্ছিলাম বইমেলা নিয়ে প্রতিদিনের প্রতিবেদন লিখে৷ তখন পর্যন্ত আমাদের জানা ছিল মুক্তধারার চিত্তরঞ্জন সাহা বইমেলার সূত্রপাত করেছিলেন ১৯৭২ সালে৷ ওই বছর একুশের অনুষ্ঠানের দিন বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে ৩২টি বই সাজিয়ে বসে গিয়েছিলেন তিনি৷ ওই ৩২টি বই ছিল মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় চিত্তরঞ্জন সাহা প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ, যা পরে ‘মুক্তধারা' নামে পরিচিতি পায়, সেই প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রকাশিত৷ বইগুলোর লেখকরা সবাই ছিলেন যুদ্ধের সময় ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রিত বাংলাদেশি৷ অবশ্য বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে বইমেলা সংক্রান্ত একটি লেখায় দাবি করেন, বাংলাদেশে প্রথম বইমেলা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের আগে, ১৯৬৫ সালে, সরদার জয়েনউদদীনের উদ্যোগে৷ আজকের দিনের অমর একুশে বইমেলা সম্পর্কে শামসুজ্জামান খানের লেখায় মনে হয় চিত্তরঞ্জন সাহার চেয়েও বড় ভূমিকা ছিল রুহুল আমিন নিজামী নামে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের প্রকাশকের৷
বইয়ের কলেজ স্ট্রিট
শুরু হয়ে গিয়েছে কলকাতা বইমেলা৷ ব্যস্ত কলেজ স্ট্রিট পাড়াও৷ কলকাতার বইয়ের আঁতুড়ঘর৷ ছোটবড় প্রায় সমস্ত প্রকাশনার দফতরই এখানে৷ যে পাড়ার রাস্তাঘাটেও ছড়িয়ে থাকে বই৷ বই নিয়ে আড্ডা হয় কফি হাউসে৷ হেঁটে দেখা যাক সেই পাড়া৷
ছবি: Twisha
বইপাড়া
কলেজ স্ট্রিটকে বলা যেতে পারে শিক্ষাসংস্কৃতির সূতিকাগার৷ বাংলা ভাষায় বই প্রকাশের প্রধানতম কেন্দ্র এটিই৷ বই কেনাবেচারও৷ প্রতিদিন নতুন নতুন বই প্রকাশিত হচ্ছে, প্রকাশনার খুঁটিনাটির পরিকল্পনা হচ্ছে এখানে বসেই৷ অল্প দূরেই ছাপাখানা, কাগজের পসরা, সবই কলেজ স্ট্রিটকে ঘিরে৷ স্কুলকলেজের পাঠ্যবইয়ের কেজো দুনিয়াদারি যেমন এখানে, পাশাপাশি রচিত হচ্ছে সাহিত্যের উজ্জ্বল মণিমুক্তোও৷
ছবি: Twisha
হারানো বই
হঠাৎ কোনো হারিয়ে-যাওয়া ফুরিয়ে-যাওয়া বইয়ের খোঁজ মিলে যাবে এখানে৷ কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথে বা প্রেসিডেন্সির রেলিঙে৷ গুপ্তধন পাওয়ার উল্লাসের সঙ্গে মিশে যাবে স্মৃতির বিলাস বা বেদনা৷
ছবি: Twisha
এবং দে’জ
চল্লিশের দশকে দে বুক স্টল নামে ছোট বইয়ের দোকান হিসেবে পথ চলা শুরু৷ ১৯৭০ সালে শুরু হয় তাদের প্রকাশনাসংস্থা দে’জ পাবলিশার্স৷ প্রায় পঞ্চাশ বছর কাটিয়ে এখন তাদের প্রকাশনা দপ্তর ও বইয়ের দোকান বিশাল আকার নিয়েছে৷ প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কত হিসেব করা কঠিন৷ এখন তারা পশ্চিমবঙ্গের অগ্রনী প্রকাশক৷
ছবি: Twisha
চক্রবর্তী, চ্যাটার্জি অ্যান্ড কোম্পানি
১০৮ বছর আগে প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের তিন ছাত্র ‘চক্রবর্তী, চ্যাটার্জি অ্যান্ড কোম্পানি লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন৷ কলেজ স্ট্রিটের ওপরে দু’টি তলা নিয়ে দোকানটি অবস্থিত৷ নীচের তলায় পাঠ্যপুস্তক ও ওপরের তলায় বাকি নানা ধরনের বই৷ বর্তমান মালিকেরা ১৯৭১-এ অধিকাংশ শেয়ার কিনে এর মালিকানা পান৷ ১৯৭৩ থেকে তাঁরা নিয়মিত নানা ধরনের বই প্রকাশ করে আসছে৷
ছবি: Twisha
বেঙ্গল পাবলিশার্স
বেঙ্গল পাবলিশার্স প্রতিষ্ঠা করেন বিখ্যাত সাহিত্যিক মনোজ বসু৷ তাঁর রচিত অনেক বইই প্রকাশিত হয়েছিল এই প্রকাশনী থেকে, তার মধ্যে আছে ‘নিশিকুটুম্ব’৷ এ ছাড়াও বাংলা সাহিত্যের অনেক বিখ্যাত লেখকের ও নানা ধরনের বই এঁরা প্রকাশ করেছেন, যেমন ‘সুন্দরবন অমনিবাস’, ‘জীবনানন্দ দাশের কাব্যগ্রন্থ’৷ ইদানীং তাঁদের প্রকাশনায় ভাটার টান, গত দু’বছর ধরে তাঁরা নতুন বই প্রকাশ করছেন না, বইমেলাতেও থাকছেন না৷
ছবি: Twisha
কফিহাউস
বইপাড়ার ঠিক মাঝখানে কফিহাউস৷ তাকে বলা যাবে না নিছক রেস্তোরাঁ, যদিও খাবার পাওয়া যায়৷ মূলত কফিতে চুমুক দিয়েই চলে এখানকার আড্ডা গল্প আর তা থেকে ছলকে ওঠে সাহিত্যশিল্পের দ্যুতি৷ কে না এসেছেন এখানে! শঙ্খ ঘোষ থেকে শুরু করে কৃত্তিবাসের কান্ডারীরা, নকশাল আন্দোলনের ছোটোবড়ো কর্মীরা, লিটল ম্যাগাজিনের স্বপ্নপাগল ছেলেমেয়েরা৷ এসেছেন, এখনও আসেন। কফিহাউস শিল্পসাহিত্য ভাবাই যায় না!
ছবি: Twisha
বই পাঠানোর ধুম
বই পাঠকের কাছে পৌঁছনোর আগে থাকে লম্বা এক প্রস্তুতিপর্ব, তারই শেষ পর্যায়ে থাকে থাকে বইয়ের প্যাক ছাপা বাঁধাইয়ের পালা শেষ করে রওনা দেয় প্রকাশকের গখরে বা বইয়ের দোকানে৷ টেম্পো ট্রাক ভ্যান বা রিক্সা, কত রকম যে বাহন তার!
ছবি: Twisha
7 ছবি1 | 7
শামসুজ্জামান খান লিখেছেন, ‘‘১৯৭২ সালে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বাংলা একাডেমির একুশের অনুষ্ঠানে কোনো বইমেলা হয়নি৷ তবে বাংলা একাডেমির দেয়ালের বাইরে স্ট্যান্ডার্ড পাবলিশার্সের রুহুল আমিন নিজামী তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রগতি প্রকাশনীর কিছু বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসেন৷ তাঁর দেখাদেখি মুক্তধারা প্রকাশনীর চিত্তরঞ্জন সাহা এবং বর্ণমিছিলের তাজুল ইসলামও ওভাবেই তাঁদের বই নিয়ে বসে যান৷ ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে একটি বিশাল জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়৷ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মেলার উদ্বোধন করেন৷ সে উপলক্ষ্যে নিজামী, চিত্তবাবু এবং বর্ণমিছিলসহ সাত-আটজন প্রকাশক একাডেমির ভেতরে পূর্ব দিকের দেয়ালঘেঁষে বই সাজিয়ে বসে যান৷ সে বছরই প্রথম বাংলা একাডেমির বইয়েরও বিক্রয়কেন্দ্রের বাইরে একটি স্টলে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়৷ এভাবেই বিচ্ছিন্ন বই বিক্রির উদ্যোগের ফলে ধীরে ধীরে বাংলা একাডেমিতে একটি বইমেলা আয়োজনের জন্য গ্রন্থমনস্ক মানুষের চাপ বাড়তে থাকে৷ ১৯৮৩ সালে কাজী মনজুরে মওলা সাহেব যখন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক, তখন তিনি বাংলা একাডেমীতে প্রথম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা'-র আয়োজন সম্পন্ন করেন৷ কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষা ভবনের সামনে ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিলে ট্রাক তুলে দিলে দুজন ছাত্র নিহত হয়৷ ওই মর্মান্তিক ঘটনার পর সেই বছর আর বইমেলা করা সম্ভব হয়নি৷ ১৯৮৪ সালে সাড়ম্বরে বর্তমানের অমর একুশে গ্রন্থমেলার সূচনা হয়৷''
১৯৮৪ থেকে ১৯৯৮ বইমেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ কালপর্ব৷ ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি মধ্যবিত্তের কাছে বইমেলা ততদিনে মাসব্যাপী একটি উৎসবে রূপ পেয়েছে৷ তবে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝিতে এসে মেলার বারোয়ারি রূপটি এতটাই প্রকট হয়েছিল যে স্টলগুলো থেকে উচ্চস্বরে বাজানো কবিতা ও গানের ক্যাসেটে কান পাতা দায় ছিল৷ ভেঁপু-বাঁশির সুর শোনা যেত টিএসসি কিংবা দোয়েল চত্বরে পৌঁছার আগেই৷ পুরো শাহবাগ থেকেই শুরু হয়ে যেত শিল-পাটা থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যের পসরা৷ সম্ভবত ১৯৯৭ সালে বইমেলাকে শুধুই বইয়ের মেলায় রূপান্তরের একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল৷ তবে বাংলা একাডেমির সেই সময়কার মহাপরিচালক সৈয়দ আনোয়ার হোসেনকে উদ্যোগটা সফল করতে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত সময় লেগে যায়৷ আমিও ঠিক ওই বছর ‘বইমেলা প্রতিবেদন' লিখে ভোরের কাগজে চাকরি পাওয়ার পরীক্ষায় অবতীর্ণ হই৷ আমার মনে আছে বাংলা একাডেমির ছোট্ট চত্বরেই সেবার বইমেলাটি বেশ বড় লাগছিল৷ মেলা শুরুর দু-চার দিনের মধ্যেই আমি একটা প্রতিবেদন লিখেছিলাম, যার শিরোনাম ছিল ‘কোকিলেরও ডাক শোনা যায়'৷
মেলার মাঠ থেকে কোকিলের ডাক শুনতে পাওয়ার তাৎপর্য নতুনদের বলে বোঝানো যাবে না, অন্তত যারা ২০১৪ সাল থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিশাল পরিসরে মেলা দেখে অভ্যস্ত হয়েছেন৷ বাংলা একাডেমিতে মেলার অনুষ্ঠানাদি চললেও ওই বছর থেকে মূল ধারার প্রকাশকদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে উদ্যানে এবং প্রতিবছরই উদ্যান অংশে বাড়ানো হচ্ছে মেলার পরিসর৷ এবারও গতবারের তুলনায় প্যাভিলিয়ন বাড়ছে ১০টি৷ মেলার সার্বিক প্রস্তুতি সম্পর্কে মেলা পরিচালনা কমিটির দেওয়া তথ্যানুযায়ী, গতবার প্যাভিলিয়ন পাওয়া দু'টি প্রকাশনা সংস্থা এবার প্যাভিলিয়ন না নেওয়ায় নতুন ১২টি প্রকাশনা সংস্থা প্যাভিলিয়ন পাচ্ছে৷ প্যাভিলিয়ন পাওয়া প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যা হচ্ছে ২৩টি৷ সব মিলিয়ে এবার ৩৪০টি প্রকাশনা সংস্থা মেলায় অংশ নিচ্ছে, যার মধ্যে এবারই প্রথমবারের মতো মেলায় অংশ নিতে যাচ্ছে ২১টি প্রকাশনা সংস্থা৷ এবারের মেলায় ৬৭৬টি ইউনিট বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, যা গতবারের চেয়ে ১৪টি ইউনিট বেশি৷
একুশের বইমেলা বড় হয়েছে, তবে বাংলাদেশের বইয়ের বাজার ছোট হয়েছে৷ মেলা নিয়ে বিগত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতা থেকে নিশ্চিত করে বলতে পারি, প্রকৃত পাঠক ও বইয়ের ক্রেতার সংখ্যা আনুপাতিক হারে বাড়েনি৷ মানুষ বেড়েছে, বেড়েছে প্রকাশনা সংস্থার সংখ্যাও৷ একুশের বইমেলা আমাদের প্রকাশনাকে উন্নত করেছে এমন দাবি করবার অবকাশ নেই৷ বইমেলার উদ্দেশ্য বইয়ের প্রচার, বইকে জনপ্রিয় করার চেষ্টা, বইয়ের বিক্রি বাড়ানো৷ কিন্তু আমাদের একুশের বইমেলা মূলত খুচরা বই বিক্রির মেলায় পরিণত হয়েছে এবং ফলে মাসব্যাপী এর বিস্তৃতি৷ উন্নত বিশ্বের বইমেলা প্রধানত প্রচার, বিপণন ও বাজারজাত করার উদ্দেশে আয়োজন করা হয়৷ যতদূর জানি ওই সব মেলায় খুচরা বিক্রি হয় খুব সামান্য৷
একুশের বইমেলাকে কেন্দ্র করে আমাদের প্রকাশনা শিল্প হয়ে পড়েছে ফেব্রুয়ারিকেন্দ্রিক৷ বাংলাদেশে প্রকাশিত অধিকাংশ বইই এখন আর মফস্বল শহরে পাওয়া যায় না৷ এমনকি ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বইয়ের দোকানেও পাঠ্যপুস্তকের বাইরে কোনো বই পাওয়া পাওয়া যায় না বললেই চলে৷ কোনো একটি বইয়ের খবর পেয়ে যদি আমার সেই বইটি কিনতে ইচ্ছা করে তাহলে বইটির প্রকাশকের বাংলাবাজারের দোকানে যেতে হবে বা অপেক্ষা করতে হবে আগামী বইমেলা পর্যন্ত৷ অবশ্য আজকাল অনলাইনে বই কেনার মতো কিছু প্রতিষ্ঠান সেই কষ্ট লাঘব করেছে এবং একই সঙ্গে শুধুমাত্র বই কিনতে যারা মেলায় যেতেন, তাদের মেলায় যাওয়াটাও বন্ধ করে দিতে চলেছে৷
প্রকাশনাকে শিল্প বলা হলেও এই শিল্পে বিনিয়োগ করে জীবিকা নির্বাহ করাই দূরুহ৷ আমাদের প্রকাশকদের একটা বড় অংশ মূলত পাঠ্যপুস্তক ও নোটবুকের প্রকাশক৷ সামাজিক মর্যাদা বাড়ানোর জন্য তাদের অনেকেই লোকসান দিয়ে হলেও কিছু সৃজনশীল বই প্রকাশ করেন৷ বনেদী কিছু প্রকাশনা সংস্থাও সক্রিয় রয়েছে, প্রকাশনার সঙ্গে জড়িয়ে থাকার মায়া-মোহ কাটাতে না পেরে৷ এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য বইমেলাকেন্দ্রিক প্রকাশনাকে সারা বছরের প্রকাশনায় রূপান্তর করতে হবে৷ দূরের এই ভাবনাটা না ভাবলে বইমেলা বইকে কেন্দ্র করে নিছক একটা মেলার অনুষঙ্গে পরিণত হবে৷