'অযোগ্য' তালিকায় নাম, স্কুল শিক্ষিকার আত্মহত্যা
৬ ডিসেম্বর ২০২২স্কুলে শিক্ষক নিয়োগের একাধিক দুর্নীতির মামলা আদালতে বিচারাধীন। ইতিমধ্যে প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী-সহ তার অধীনে কাজ করা একঝাঁক কর্তা এখন জেলে। যে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে টাকা দিয়ে চাকরি পাওয়ার অভিযোগ উঠেছে, তাদের মাথার উপর খাঁড়া ঝুলছে। এদের পদত্যাগ করতে বলেছে আদালত। মামলার নিষ্পত্তি হওয়ার আগেই শিক্ষকদের পদত্যাগের ঘটনা সামনে এসেছে। কিন্তু রবিবার যা ঘটেছে, তা অত্যন্ত হৃদয়বিদারক।
নবম-দশম শ্রেণিতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যে বেনিয়ম হয়েছে, তা নিয়ে মামলা চলছে কলকাতা হাইকোর্টে। আদালতের নির্দেশে স্কুল সার্ভিস কমিশন ১৮৩ জন শিক্ষকের তালিকা প্রকাশ করেছে যাদের সুপারিশের ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এই সুপারিশের নেপথ্যে আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ। তা খতিয়ে দেখতে এই তালিকা ধরে তথ্য যাচাই করা হচ্ছে।
এই সংক্রান্ত একটি তালিকা সোশ্যাল মিডিয়ায় কয়েকদিন ধরে ভাইরাল। তারপরই রবিবার পূর্ব মেদিনীপুরের নন্দীগ্রামে এক শিক্ষিকার ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হয়েছে। আত্মঘাতী ৩০ বছর বয়সি টুম্পারানি মন্ডল দেবীপুর মিলন বিদ্যাপীঠের বাংলার শিক্ষিকা ছিলেন। চণ্ডীপুর থানার সরিপুর গ্রামে ভাড়াবাড়ি থেকে টুম্পাকে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।
সূত্রের খবর, ২০১৬ সালে কমিশন যে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে, তাতে আবেদন করেন টুম্পা। ২০১৯ সালে নন্দীগ্রামের ওই স্কুলে শিক্ষক পদে যোগ দেন। তার পরিজনের বক্তব্য অনুযায়ী, কমিশনের তালিকা বলে একটি পোস্ট সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার পর মানসিক অবসাদে ভুগছিলেন টুম্পা। ওই তালিকায় ৫৮ নম্বরে তার নাম রয়েছে। শনিবার স্কুলে যাননি শিক্ষিকা। পরের দিন আত্মহত্যা করেছেন।
কী কারণে টুম্পার আত্মহত্যা, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ। তবে অনুমান করা হচ্ছে, ভাইরাল তালিকায় নাম থাকার জন্য তিনি আত্মঘাতী হয়েছেন। এ জন্য কমিশন ও রাজ্যকে দায়ী করছে শিক্ষা মহলের একাংশ। শিক্ষক শিক্ষাকর্মী শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের রাজ্য সম্পাদক কিঙ্কর অধিকারী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''যারা নিয়োগের ব্যবস্থা করেছিলেন, তারাই টুম্পারানির পরিণতির জন্য তারাই দায়ী। ১৮৩ জনের নাম হিমশৈলের চুড়ো। এটা ব্যক্তির নয়, সংগঠিত অপরাধ। রাজ্যকে এর দায় নিতে হবে।''
শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার শিক্ষিকার আত্মহত্যার খবরে স্তম্ভিত। তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''শিক্ষাক্ষেত্রে অনৈতিক ব্যবস্থাপনার শিকার হয়েছেন যারা, মাছের মতো বড়শিতে যাদের গাঁথা হয়েছে, তাদের প্রাণ যাচ্ছে দুঃসহ লজ্জায়। তারা বুঝতে পারছেন কী অন্যায় করেছেন, অন্যায় করতে তাদের বাধ্য করা হয়েছে।''
বিভিন্ন স্তরে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে আর্থিক লেনদেনে শাসক দলের একাংশ যুক্ত রয়েছে বলে অভিযোগ। আইনি প্রক্রিয়ায় এই অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতাও মিলেছে। কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা আদালতে যে রিপোর্ট দিয়েছে, তাতে দাবি করা হয়েছে, এই দুর্নীতির জাল অনেক দূর পর্যন্ত বিস্তৃত।
এর প্রমাণ অতীতে মিলেছে যখন রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পরেশ অধিকারীর মেয়ের নিয়োগ আদালত বাতিল করে দেয়। প্রাক্তন শিক্ষিকা অঙ্কিতা অধিকারীকে বেতনও ফেরত দিতে হয়েছে। শাসক দলের জেলবন্দি নেতা অনুব্রত মণ্ডলের মেয়ে সুকন্যা মণ্ডলের নিয়োগ নিয়েও একই প্রশ্ন উঠেছে।
বেআইনি ভাবে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তাদের অনেকে ইতিমধ্যে স্কুলে আসা বন্ধ করে দিয়েছেন বলে খবর। বিশেষত, পয়লা ডিসেম্বর এসএসসি-র তালিকা ভাইরাল হওয়ার পর। প্রশ্ন উঠছে, যে টাকা অঙ্কিতাকে ফেরত দিতে হয়েছে, নিয়োগ বাতিল হলে বাকিদেরও কি একই পরিণতি হবে? লাখ লাখ টাকা ফেরত দেওয়ার ভয়ে কেউ চরম পথ বেছে নেবেন না তো?
এর সঙ্গে রয়েছে সামাজিক সম্মানহানি। সেভ এডুকেশন কমিটি-র সম্পাদক, অধ্যাপক তরুণ নস্কর ডয়চে ভেলেকে বলেন, ''সকালে খবরটা দেখে খুব খারাপ লাগল। যে শিক্ষিকা আত্মঘাতী হয়েছেন, তিনি সম্মানহানির আশঙ্কা করেছেন। রাজ্য সরকারই এ জন্য দায়ী।''
সামাজিক সংকটের প্রসঙ্গ তুলে অধ্যাপকের বক্তব্য, ''যিনি অর্থের বিনিময়ে চাকরি চাইছেন, তার সাংস্কৃতিক অবনমন এর সঙ্গে জড়িত। কিন্তু তার থেকেও বেশি অপরাধী যারা ঘুষের বিনিময়ে মেধা তালিকায় অযোগ্যদের জায়গা করে দিচ্ছেন।''
এ জন্য সরাসরি রাজনৈতিক নেতৃত্বকে দায়ী করেছেন মীরাতুন। তাঁর ভাষায়, ''জনদরদি হয়েছেন বলে যারা দাবি করেন, সেই নেতা বা নেত্রীরা যে কেলেঙ্কারির ব্যবস্থাপনা বিশেষত শিক্ষা ক্ষেত্রে তৈরি করেছেন, সেজন্য তাদের বর্জনযোগ্য বলে বিবেচিত হওয়া উচিত।''