সংঘ পরিবার সম্প্রতি ঘোষণা করেছে যে, অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতে শুধু রাম মন্দিরই নির্মাণ করা হবে৷ অন্য কোনো নির্মাণ নয় এবং সেই নির্মাণকার্য শুরু হচ্ছে আগামী বছর থেকে৷ আদালতের বাইরে আপোষ মীমাংসায় তারা আগ্রহী নয়৷
বিজ্ঞাপন
অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার ২৫তম বর্ষপূর্তির ঠিক মুখে মৌলবাদী বিশ্ব হিন্দু পরিষদ কর্নাটকের উড়ুপিতে সংঘ পরিবার আয়োজিত ধর্ম সংসদ থেকে ঘোষণা করে, আগামী বছর থেকে অযোধ্যার বিতর্কিত জমিতেই শুরু হবে রাম মন্দির নির্মাণ৷ ঐ জমিতে অন্য কোনো নির্মাণ নয়৷ ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর হিন্দু কর সেবকরা বাবরি মসজিদ ভাঙার পর কেটে যায় ২৫ বছর৷ মামলা মোকদ্দমা চলে বহু বছর৷ এলাহাবাদ হাই কোর্টে এক প্রস্থ রায় ঘোষণার পরেও তার চূড়ান্ত মীমাংসা হয়নি৷ ঐ রায়ে বিতর্কিত জমিকে বিবদমান তিন পক্ষের মধ্যে তিনটি ভাগে ভাগ করা হয়৷ তখন অযোধ্যার বিতর্কিত জমির মামলা চলে যায় শীর্ষ আদালতে৷ সম্প্রতি আর্ট অফ লিভিং-এর ধর্মগুরু শ্রী শ্রী রবিশংকর আদালতের বাইরে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এক মীমাংসাসূত্র বের করার উদ্যোগ নেন৷ কিন্তু সংঘ পরিবার তাতে আমল দেয়নি৷ তাদের মতে, ধর্ম সংসদই বলবে শেষকথা৷
বাবরি মসজিদের প্রতিষ্ঠা থেকে ভাঙচুরের ইতিহাস
হিন্দু দেবতা রামচন্দ্রের জন্মস্থান, রাম মন্দির, নাকি মোগল সম্রাট বাবরের আমলে নির্মিত একটি মসজিদ? বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৩ সাল থেকে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ চলেছে, যা চরমে ওঠে ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরে৷
ছবি: dpa - Bildarchiv
১৫২৮ সালে নির্মাণ
রামায়ণ-খ্যাত অযোধ্যা শহর ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদ জেলায় অবস্থিত৷ তারই কাছে রামকোট পর্বত৷ ১৫২৮ সালে সেখানে সম্রাট বাবরের আদেশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যে কারণে জনমুখে মসজিদটির নামও হয়ে যায় বাবরি মসজিদ৷ আবার এ-ও শোনা যায়, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের আগে এই মসজিদ ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান' বলেও পরিচিত ছিল৷
ছবি: DW/S. Waheed
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
বাবরি মসজিদ নিয়ে সংঘাত ঘটেছে বার বার৷ অথচ ফৈজাবাদ জেলার ১৯০৫ সালের গ্যাজেটিয়ার অনুযায়ী, ১৮৫২ সাল পর্যন্ত হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ই সংশ্লিষ্ট ভবনটিতে প্রার্থনা ও পূজা করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. E. Curran
সংঘাতের সূত্রপাত
প্রথমবারের মতো হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত৷১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ সরকার দেয়াল দিয়ে হিন্দু আর মুসলমানদের প্রার্থনার স্থান আলাদা করে দেয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/D .E. Curran
হিন্দুদের দাবি
আওয়াধ অঞ্চলের বাবর-নিযুক্ত প্রশাসক ছিলেন মির বকশি৷ তিনি একটি প্রাচীনতর রাম মন্দির বিনষ্ট করে তার জায়গায় মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে হিন্দুদের দাবি৷
ছবি: AP
বেআইনিভাবে মূর্তি স্থাপন
১৯৪৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর – বেআইনিভাবে বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হয়৷
ছবি: DW/S. Waheed
নেহরুর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
রাম-সীতার মূর্তি স্থাপনের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে চিঠি লিখে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি অপসারণ করার নির্দেশ দেন, তিনি বলেন ‘‘ওখানে একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে’’৷
ছবি: Getty Images
মসজিদের তালা খোলার আন্দোলন
১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে৷ ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর সরকার ঠিক সেই নির্দেশই দেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
দুই সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাম মন্দির নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে৷ ১৯৮৬ সালে মসজিদের তালা খুলে সেখানে পূজা করার অনুমতি প্রার্থনা করে হিন্দু পরিষদ৷ অন্যদিকে, মুসলমানরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন৷
ছবি: AP
‘রাম রথযাত্রা'’
১৯৮৯ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে ভিএইচপি বিতর্কিত স্থলটিতে (মন্দিরের) ‘শিলান্যাস'-এর অনুমতি পায়৷ ভারতীয় জনতা পার্টির প্রবীণ নেতা লাল কৃষ্ণ আডভানি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে দশ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ‘রাম রথযাত্রা'’ শুরু করেন৷
ছবি: AP
১৯৯২
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর এল কে আডভানি, মুরলি মনোহর যোশি, বিনয় কাটিয়াসহ অন্যান্য হিন্দুবাদী নেতারা মসজিদ প্রাঙ্গনে পৌঁছান৷ ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি, শিব সেনা আর বিজেপি নেতাদের আহ্বানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাবারি মসজিদে হামলা চালায়৷ ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷
ছবি: AFP/Getty Images
সমঝোতার উদ্যোগ
২০০২ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী দু’পক্ষের সমঝোতার জন্য বিশেষ সেল গঠন করেন৷ বলিউডের সাবেক অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহাকে হিন্দু ও মুসলমানদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়৷
ছবি: AP
শিলালিপি কী বলে
পুরাতাতত্বিক বিভাগ জানায়, মসজিদের ধ্বংসাবশেষে যে সব শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, তা থেকে ধারণা করা হয়, মসজিদের নীচে একটি হিন্দু মন্দির ছিল৷ আবার ‘জৈন সমতা বাহিনী'-র মতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের নীচে যে মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি জৈন মন্দির৷
ছবি: CC-BY-SA-Shaid Khan
বিজেপি দোষী
বিশেষ কমিশন ১৭ বছরের তদন্তের পর ২০০৯ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দেয়৷ প্রতিবেদনে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপিকে দোষী দাবি করা হয়৷
ছবি: AP
এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়
২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে জানান, যে স্থান নিয়ে বিবাদ তা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া উচিত৷ এক তৃতীয়াংশ হিন্দু, এক তৃতীয়াংশ মুসলমান এবং বাকি অংশ নির্মোহী আখড়ায় দেওয়ার রায় দেন৷ রায়ে আরো বলা হয়, মূল যে অংশ নিয়ে বিবাদ তা হিন্দুদের দেয়া হোক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদন
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের সেই রায় বাতিল করে৷ দুই বিচারপতির বেঞ্চ বলেন, বাদী বিবাদী কোনো পক্ষই জমিটি ভাগ করতে চান না৷
ছবি: AP
ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়
ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কণ্টকিত ইতিহাসে বাবরি মসজিদে হামলা একটি ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’৷ গুটি কয়েক হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিনটিকে সূর্য দিবস বলে আখ্যায়িত করলেও বেশিরভাগ ভারতীয় দিনটিকে ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেন৷ অনেকেই বলেন, এই ঘটনায় দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি একেবারে ভূলুন্ঠিত হয়েছিল৷
ছবি: AP
16 ছবি1 | 16
এই আবহে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভাগবত দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বুঝিয়ে দেন, অযোধ্যার রামজন্মভূমিতে রাম মন্দিরই আমাদের বানাতে হবে, সেখানকার পাথর দিয়েই৷ অন্য কোনো নির্মাণ নয়৷ আর সেই নির্মাণ শুরু হতে আর দেরি নেই৷ আগামী বছর থেকেই শুরু হবে সেই নির্মাণকার্য৷ এটা হাততালি কুড়াবার ঘোষণা নয়৷ গভীর ধর্মবিশ্বাস থেকেই করা হয়েছে, যেটা নড়চড় হবার প্রশ্ন নেই৷ এই ধর্ম সংসদ থেকেই ডাক দেওয়া হয় গো-হত্যা বন্ধ করার, গরুকে জাতীয় প্রাণীর মর্যাদা দেওয়ার, লাভজেহাদ বা হিন্দু-মুসলিম বিয়ে-শাদির ওপর নিষেধাজ্ঞা, ধর্মান্তরকরণ ইত্যাদি বিষয়৷
সংঘ-পরিবারের এই ধরণের ঘোষণায় সরব হয় মুসলিম শিবির৷ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে হায়দ্রাবাদের সাংসদ এবং এআইএমআইএম-এর সভাপতি আসাদউদ্দিন ওয়েইসি বলেছেন, সংঘ পরিবার আগুণ নিয়ে খেলছে৷ সুপ্রিম কোর্টকে পর্যন্ত পরোয়া করছে না৷ করলে অযোধ্যার বিতর্কিত জমি নিয়ে এমন মন্তব্য কেউ করতে পারে না৷ বিষয়টির সংবেদনশীলতার দিকে তিনি সুপ্রিম কোর্টের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চান৷ মুসলিম পার্সোনাল ল' বোর্ডের মুখপাত্র মৌলানা খালিদ সইফুল্লা রেহমানি জানিয়েছেন, বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন৷ বিচার বিভাগের ওপর আমাদের আস্থা আছে৷ শীর্ষ আদালতের রায় আমরা বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করবো৷ কিন্তু তার আগেই বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছে৷ এটা মেনে নেওয়া যায় না৷ কংগ্রেস পার্টির মুখপাত্র আনন্দ শর্মাও অনুরূপ মন্তব্য করে বলেছেন, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ এই ধরনের ঘোষণায় সুপ্রিম কোর্টকে চ্যালেঞ্জ জানানো হয়েছে. অযোধ্যা মামলায় যা অবস্থান নেবার, তা শীর্ষ আদালতই নেবে৷ উল্লেখ্য, আগামী ৫ই ডিসেম্বর থেকে এই মামলার শুনানি শুরু হচ্ছে৷
‘মুসলিমরাও বুঝতে পারছে, এটা সংঘ পরিবারের এক ধরনের ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই না৷’
ঘটনাচক্রে আগামী এক বছরের মধ্যে দেশের আটটি রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন৷ ২০১৯ সালে সাধারণ নির্বাচন এবং সেই নির্বাচনে মোদীর জয়লাভ হবে নিঃসন্দেহে এক বড় চ্যালেঞ্জ৷ রাজনীতিকদের অনেকে মনে করেন, গুজরাট ও হিমাচল প্রদেশে বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে রামমন্দির নির্মাণের কর্মসূচির আগাম ঘোষণা করেছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ৷ ভোটের রাজনীতির সব অপ্রিয় প্রশ্ন থেকে দৃষ্টি সরাতেই এই মেরুকরণের বার্তা৷ মোদী সরকার এখন কি অবস্থান নেয়, সেটাই দেখার৷
রাজনীতির অভিজ্ঞ বিশ্লেষক অমূল্য গাঙ্গুলি অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণ ইস্যু সম্পর্কে ডয়চে ভেলের কাছে তাঁর মত ব্যক্ত করতে গিয়ে বললেন, সংঘ পরিবার নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে বিষয়টিকে জিইয়ে রেখে হিন্দু ভোট সুসংহত করতে চাইছে৷ এটা ওদের পুরোনো অ্যাজেন্ডা৷ এছাড়া অন্যকিছু ওদের মাথায় ঢোকে না৷ এটাই ওদের নিজস্ব সাংগঠনিক ধারা৷ সংগঠনকে ধরে রাখতে এই ধরনের কথাবার্তা বলতে হয়, তাই বলে৷ রাম মন্দির নিয়ে আমজনতার খুব যে একটা মাথাব্যথা আছে এমনটা আমার মনে হয় না৷ তাই এই ইস্যুতে ওরা কোনো মধ্যস্থতাও চায় না৷ তাই শ্রী শ্রী রবিশংকরের উদ্যোগ বানচাল হয়ে গেল৷ আর শীর্ষ আদালতের রায়ের কথা বলছেন? ওদের মতে, ধর্ম সংক্রান্ত ব্যাপারটা আদালতের এক্তিয়ারে পড়ে না৷ আগেও বিচার বিভাগের অনেক রায় ওরা অমান্য করেছে৷ তার জন্য হাসিমুখে জেলে যেতেও রাজি৷ যেমনটা হয়েছিল বাবরি মসজিদ ভাঙার সময়৷ তত্কালীন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যান সিং হাসতে হাসতে একদিনের কারাবাস মেনে নিয়েছিলেন৷ তবে সাম্প্রদায়িক গণ্ডগোলের আশংকা উড়িয়ে দিয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অমূল্য গাঙ্গুলি ডয়চে ভেলেকে বললেন, মুসলিমরাও বুঝতে পারছে, এটা সংঘ পরিবারের এক ধরনের ভাঁওতাবাজি ছাড়া আর কিছুই না৷