অযোধ্যা মামলায় রায়ের পর বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব মন্তব্য করলেও নীরব মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়৷ তিনি বা তৃণমূলের কোনো নেতা এ নিয়ে মুখ খোলেননি৷ বরং তাৎপর্যপূর্ণভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজের কবিতা পোস্ট করেছেন তৃণমূল নেত্রী৷
বিজ্ঞাপন
অযোধ্যা মামলার রায় বেরোনোর পর ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হবে, এমনটাই প্রত্যাশিত ছিল৷ সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়াও মিলেছে বিভিন্ন স্তরের মানুষে থেকে৷ তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নীরবতা অনেককেই বিস্মিত করেছে৷ কেন তিনি অযোধ্যা রায় নিয়ে মুখ খুললেন না? এই প্রশ্নে দুটি ভিন্ন মত উঠে আসছে৷ এক পক্ষের মত, শুধুই নির্বাচনী অঙ্কের কথা মাথায় রেখে মুখ্যমন্ত্রী নীরব থেকেছেন৷ আরেক পক্ষের বক্তব্য, সম্প্রীতি অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা৷ লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিস্ময়কর উত্থান হয়েছে বিজেপির৷ ১৮টি আসনে জয়ী হয়েছে তারা৷ হিন্দু জাতীয়তাবাদী দলটি বারবার তৃণমূলের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগ এনেছে৷ ভোটের এই ফল বিশ্লেষণ করে অধ্যাপক বিমলশঙ্কর নন্দ বলেন, ‘‘গত নির্বাচনে হিন্দুদের একাংশের ভোট বিজেপির দিকে চলে গেছে৷ তৃণমূলের সংখ্যালঘু তোষণের জন্যই এই ভোট বিপক্ষে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে৷ তাই অযোধ্যা রায় নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করা মুখ্যমন্ত্রীর পক্ষে কঠিন৷’’
বাবরি মসজিদ: প্রতিষ্ঠা, ভাঙচুর, মামলা, রায়
হিন্দু দেবতা রামচন্দ্রের জন্মস্থান, রাম মন্দির, নাকি মোগল সম্রাট বাবরের আমলে নির্মিত একটি মসজিদ? বিষয়টি নিয়ে ১৮৫৩ সাল থেকে হিন্দু-মুসলমান বিরোধ চলেছে, যা চরমে ওঠে ১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বরে৷
ছবি: dpa - Bildarchiv
১৫২৮ সালে নির্মাণ
রামায়ণ-খ্যাত অযোধ্যা শহর ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের ফৈজাবাদ জেলায় অবস্থিত৷ তারই কাছে রামকোট পর্বত৷ ১৫২৮ সালে সেখানে সম্রাট বাবরের আদেশে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়, যে কারণে জনমুখে মসজিদটির নামও হয়ে যায় বাবরি মসজিদ৷ আবার এ-ও শোনা যায়, গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের আগে এই মসজিদ ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান' বলেও পরিচিত ছিল৷
ছবি: DW/S. Waheed
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
বাবরি মসজিদ নিয়ে সংঘাত ঘটেছে বার বার৷ অথচ ফৈজাবাদ জেলার ১৯০৫ সালের গ্যাজেটিয়ার অনুযায়ী, ১৮৫২ সাল পর্যন্ত হিন্দু এবং মুসলমান, দুই সম্প্রদায়ই সংশ্লিষ্ট ভবনটিতে প্রার্থনা ও পূজা করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. E. Curran
সংঘাতের সূত্রপাত
প্রথমবারের মতো হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সংঘাতের সূত্রপাত৷১৮৫৯ সালে ব্রিটিশ সরকার দেয়াল দিয়ে হিন্দু আর মুসলমানদের প্রার্থনার স্থান আলাদা করে দেয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/D .E. Curran
হিন্দুদের দাবি
আওয়াধ অঞ্চলের বাবর-নিযুক্ত প্রশাসক ছিলেন মির বকশি৷ তিনি একটি প্রাচীনতর রাম মন্দির বিনষ্ট করে তার জায়গায় মসজিদটি নির্মাণ করেন বলে হিন্দুদের দাবি৷
ছবি: AP
বেআইনিভাবে মূর্তি স্থাপন
১৯৪৯ সালের ২৩শে ডিসেম্বর – বেআইনিভাবে বাবরি মসজিদের অভ্যন্তরে রাম-সীতার মূর্তি স্থাপন করা হয়৷
ছবি: DW/S. Waheed
নেহরুর ঐতিহাসিক পদক্ষেপ
রাম-সীতার মূর্তি স্থাপনের পর ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গোবিন্দ বল্লভ পন্থকে চিঠি লিখে হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি অপসারণ করার নির্দেশ দেন, তিনি বলেন ‘‘ওখানে একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে’’৷
ছবি: Getty Images
মসজিদের তালা খোলার আন্দোলন
১৯৮৪ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মসজিদের তালা খুলে দেওয়ার দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে৷ ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর সরকার ঠিক সেই নির্দেশই দেন৷
ছবি: AFP/Getty Images
দুই সম্প্রদায় মুখোমুখি অবস্থানে
বিশ্ব হিন্দু পরিষদ রাম মন্দির নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করে৷ ১৯৮৬ সালে মসজিদের তালা খুলে সেখানে পূজা করার অনুমতি প্রার্থনা করে হিন্দু পরিষদ৷ অন্যদিকে, মুসলমানরা বাবরি মসজিদ অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন৷
ছবি: AP
‘রাম রথযাত্রা'’
১৯৮৯ সালের নভেম্বরের সাধারণ নির্বাচনের আগে ভিএইচপি বিতর্কিত স্থলটিতে (মন্দিরের) ‘শিলান্যাস'-এর অনুমতি পায়৷ ভারতীয় জনতা পার্টির প্রবীণ নেতা লাল কৃষ্ণ আডভানি ভারতের দক্ষিণতম প্রান্ত থেকে দশ হাজার কিলোমিটার দূরত্বের ‘রাম রথযাত্রা'’ শুরু করেন৷
ছবি: AP
১৯৯২
১৯৯২ সালের ৬ই ডিসেম্বর এল কে আডভানি, মুরলি মনোহর যোশি, বিনয় কাটিয়াসহ অন্যান্য হিন্দুবাদী নেতারা মসজিদ প্রাঙ্গনে পৌঁছান৷ ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপি, শিব সেনা আর বিজেপি নেতাদের আহ্বানে প্রায় দেড় লাখ মানুষ বাবারি মসজিদে হামলা চালায়৷ ছড়িয়ে পড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা৷
ছবি: AFP/Getty Images
সমঝোতার উদ্যোগ
২০০২ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী দু’পক্ষের সমঝোতার জন্য বিশেষ সেল গঠন করেন৷ বলিউডের সাবেক অভিনেতা শত্রুঘ্ন সিনহাকে হিন্দু ও মুসলমানদের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করার দায়িত্ব দেয়া হয়৷
ছবি: AP
শিলালিপি কী বলে
পুরাতাতত্বিক বিভাগ জানায়, মসজিদের ধ্বংসাবশেষে যে সব শিলালিপি আবিষ্কৃত হয়, তা থেকে ধারণা করা হয়, মসজিদের নীচে একটি হিন্দু মন্দির ছিল৷ আবার ‘জৈন সমতা বাহিনী'-র মতে ধ্বংসপ্রাপ্ত বাবরি মসজিদের নীচে যে মন্দিরটির ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে, সেটি ষষ্ঠ শতাব্দীর একটি জৈন মন্দির৷
ছবি: CC-BY-SA-Shaid Khan
বিজেপি দোষী
বিশেষ কমিশন ১৭ বছরের তদন্তের পর ২০০৯ সালে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় প্রতিবেদন জমা দেয়৷ প্রতিবেদনে ভারতীয় জনতা পার্টি বিজেপিকে দোষী দাবি করা হয়৷
ছবি: AP
এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়
২০১০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট তার রায়ে জানান, যে স্থান নিয়ে বিবাদ তা হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ভাগ করে দেয়া উচিত৷ এক তৃতীয়াংশ হিন্দু, এক তৃতীয়াংশ মুসলমান এবং বাকি অংশ নির্মোহী আখড়ায় দেওয়ার রায় দেন৷ রায়ে আরো বলা হয়, মূল যে অংশ নিয়ে বিবাদ তা হিন্দুদের দেয়া হোক৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদন
হিন্দু ও মুসলমানদের আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১১ সালে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হাইকোর্টের সেই রায় বাতিল করে৷ দুই বিচারপতির বেঞ্চ বলেন, বাদী বিবাদী কোনো পক্ষই জমিটি ভাগ করতে চান না৷
ছবি: AP
ইতিহাসের কলঙ্কিত অধ্যায়
ভারতে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের কণ্টকিত ইতিহাসে বাবরি মসজিদে হামলা একটি ‘কলঙ্কিত অধ্যায়’৷ গুটি কয়েক হিন্দু সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী দিনটিকে সূর্য দিবস বলে আখ্যায়িত করলেও বেশিরভাগ ভারতীয় দিনটিকে ‘কালো দিন’ বলে উল্লেখ করেন৷ অনেকেই বলেন, এই ঘটনায় দেশের অসাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি একেবারে ভূলুন্ঠিত হয়েছিল৷
ছবি: AP
মন্দিরের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের রায়
ভারতের অযোধ্যার এক বিতর্কিত জমি নিয়ে কয়েক দশক অপেক্ষার পর ৯ নভেম্বর রায় ঘোষণা করেছে দেশটির সর্বোচ্চ আদালত৷ রায়ে ওয়াকাফ বোর্ডের আর্জি এবং নির্মোহী আখড়ার জমির উপর দাবি দুটোই খারিজ করে দেন বিচারকরা৷ বিতর্কিত সেই জমিতে একটি ট্রাস্টের অধীনে মন্দির নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত৷ পাশাপাশি, একটি মসজিদ গড়তে কাছাকাছি অন্য কোথাও মুসলমানদের পাঁচ একর জমি দিতেও বলা হয়েছে রায়ে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/B. Armangue
17 ছবি1 | 17
পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘু ভোট এক চতুর্থাংশের বেশি৷ তাদের ভোট মূলত তৃণমূলের পক্ষেই যায়৷ অধ্যাপক নন্দের মতে, "মুখ্যমন্ত্রী অযোধ্যা রায়কে স্বাগত জানালে সংখ্যালঘুরা বিরক্ত হতই৷ আবার উষ্মা প্রকাশ করলে এই রায় ঘিরে হিন্দুদের মধ্যে যে উন্মাদনা তৈরি হয়েছে, তাতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হত৷ তাই মুখ্যমন্ত্রী নীরব থাকাই শ্রেয় মনে করেছেন৷'' এই সুযোগে বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ কটাক্ষ করেছেন মমতাকে৷ তাঁর বক্তব্য, "কোনো ভাল জিনিস তৃণূল দেখতে পারে না৷ ৩৭০ ধারা বিলোপ কিংবা সার্জিকাল স্ট্রাইক যাই হোক না কেন, তৃণমূলের তোষণের রাজনীতি করার প্রয়োজন রয়েছে৷’’
যদিও মমতা পুরোপুরি নীরব থেকেছেন, এটাও ঠিক নয়৷ তিনি সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি কবিতা পোস্ট করেছেন রায় বেরোনোর পর৷ যার একাধিক লাইন বেশ তাৎপর্যপূর্ণ৷ মুখ্যমন্ত্রী লিখেছেন, ‘‘অনেক সময় কথা না বলেও অনেক কথা বলা হয়ে যায়৷ কিছু বলার থেকে না বলাটা আরো শক্তিশালী বলা৷’’ এই কবিতায় অযোধ্যা বা রাম মন্দিরের উল্লেখ না থাকলেও, এখানে যে সেই ইস্যুতেই বার্তা দেওয়া হয়েছে, তা নিয়ে অনেকেই নিশ্চিত৷ রাজনৈতিক বিশ্লেষক শিবাজীপ্রতিম বসু ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নীরবতার মধ্যেই একটা প্রচ্ছন্ন বার্তা আছে যে তিনি রায়কে স্বাগত জানাচ্ছেন না৷ আবার সমালোচনা থেকেও বিরত থাকছেন৷ ভোটের অঙ্ক তো তাঁকে মাথায় রাখতেই হয়৷ তবে এই কবিতার প্রেক্ষাপটে সাম্প্রতিক অতীতে জয় শ্রী রাম স্লোগানের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রীর যে তীব্র প্রতিক্রিয়া আমরা দেখেছিতা থেকে ওঁর অবস্থান আঁচ করা যায়৷ একইসঙ্গে সম্প্রীতি বজায় রাখার স্বার্থে তিনি সরাসরি মন্তব্য এড়িয়েছেন৷’’
‘ধর্ম নিয়ে রাজনীতি দুই দিকের ধারবিশিষ্ট তরোয়ালের মত’
লোকসভা নির্বাচনের আগে থেকেই পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের প্রভাব বৃদ্ধির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে৷ রামনবমী, হনুমান জয়ন্তী পালন করা হচ্ছে ঘটা করে৷ কলকাতা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একাধিক অতিকায় হনুমান মূর্তি৷ এছাড়া রয়েছে রাম ও হনুমানের মন্দির৷ এর সঙ্গে অযোধ্যা নিয়ে মমতার নীরবতা নির্বাচনে আরো কতটা প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে ভিন্নমত দুই বিশ্লে্ষকের৷ অধ্যাপক নন্দের মতে, ‘‘ধর্ম নিয়ে রাজনীতি দুই দিকের ধারবিশিষ্ট তরোয়ালের মত৷ আপনি যেদিকেই যান, ক্ষতি হবে পারে৷ যে সংখ্যালঘুরা ভেবেছিল, মমতা এই রায়ের সমালোচনা করবেন, তারা অখুশি হবে৷ সেই ভোটের একাংশ বাম বা কংগ্রেসের দিকে চলে গেলে তৃণমূলের ক্ষতি৷’’ কিন্তু অধ্যাপক বসুর বক্তব্য, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে ভোটের বিভাজন হয়ে গেয়েছে৷ তিনি রায়ের সমালোচনা করলে মুসলিমদের নিশ্চয়ই ভালো লাগত৷ কিন্তু তাঁর রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার কথা সংখ্যালঘুরা জানে৷ তাই তাদের ভোট তৃণমূল থেকে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই৷’’