মাঝে দীর্ঘ দিন শান্ত ছিল উত্তর পূর্ব ভারত। নতুন করে সেখানে শুরু হলো জঙ্গি তৎপরতা। রোববার অরুণাচলের চাংলাং অঞ্চলে সেনা বাহিনীর জলের ট্যাঙ্কারে আক্রমণ চালায় জঙ্গিরা। ঘটনাস্থলেই নিহত হয়েছেন এক সেনা জওয়ান। আর এক জওয়ানকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
রোববার চাংলাং অঞ্চলে সেনা শিবির থেকে গ্রামে জল ভরতে যাচ্ছিল সেনা বাহিনীর ট্যাঙ্কারটি। সূত্র জানাচ্ছে, রাস্তায় জঙ্গলের ভিতর লুকিয়ে ছিল জনা ২০ জঙ্গি। ট্যাঙ্কারটি সেখানে পৌঁছতেই প্রথমে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। তারপর এলোপাথাড়ি গুলি চালানো হয়। সেনা জওয়ানরা কিছু করে ওঠার আগেই গা ঢাকা দেয় জঙ্গিরা। প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য, ট্যাঙ্কারটির সামনে আরও একটি অসামরিক গাড়ি ছিল। সেটিতেও বেশ কিছু গুলি লাগে। তবে গাড়িতে থাকা যাত্রীরা আহত হননি।
বার বার সীমান্তে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ভারত ও চীনের সেনা। কেন? ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সংঘাতের ইতিহাস একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
ছবি: Rouf Bhat/Afp/Getty Imagesভারত এবং চীনের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ লাদাখে। বাকি অংশ উত্তর পূর্ব ভারতের সিকিম এবং অরুণাচলে।
ছবি: DW/H. Joshiলাদাখ সীমান্তের একটি বড় অংশে মানুষ বসবাস করে না। এই ভৌগোলিক অঞ্চলকে মূলত আকসাই চীন বলা হয়। ভারত মনে করে আকসাই চীন তাদের অংশ। চীন মনে করে আকসাই চীন তাদের। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পরে যাদের সেনা যেখানে ছিল, সেটাকেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু দুই দেশই নিজেদের এলাকা বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo১৩৪ কিলোমিটার লম্বা প্যাংগং লেক ১৪ হাজার ফুটে অবস্থিত। নোনতা জলের এই হ্রদকে ঘিরে প্রায় ৭০০ বর্গ কিলোমিটার জমি। প্যাংগংয়ের এক-তৃতীয়াংশ ভারতের দখলে। দুই-তৃতীয়াংশ চীনের। প্রকৃত সীমান্তরেখা এই লেকের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে। ভারতের দাবি, চীন সেই সীমান্তরেখা অগ্রাহ্য করে ভারতের জমি দখল করছে এবং সীমান্তের খুব কাছে রাস্তা বানাচ্ছে। চীনের দাবি, ভারত নিয়ন্ত্রণরেখা মানছে না।
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Karelগালওয়ানের খুব কাছ দিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা গিয়েছে। চীন তিব্বতের উপর দিয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত একটি হাইওয়ে তৈরি করেছে। যাকে কারাকোরাম হাইওয়ে বলা হয়। ভারতের অভিযোগ, ওই হাইওয়ের জন্যই লাদাখের একটি অংশের দখল নিতে চায় চীন। তা করতে পারলে আরও সহজ একটি বাইপাস রাস্তা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ভারত তা হতে দিতে চায় না। গালওয়ান সমস্যার মূল কারণ এটিই।
ছবি: Getty Images/AFP/M. Vatsyayanaদারবুক, শাইয়োক হয়ে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করে ফেলেছে ভারত। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলে দৌলত বেগ ওল্ডিতে ১৬ হাজার ৬১৪ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের উচ্চতম এয়ার স্ট্রিপ তৈরি করেছে ভারত। এই এয়ার স্ট্রিপ এবং সিয়াচেন পর্যন্ত রাস্তা নিয়ে চীনের আপত্তি আছে।
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Khawer১৯১৪ সালে ব্রিটিশ আমলে উত্তর পূর্ব ভারত এবং তিব্বতের সীমান্ত নির্দিষ্ট হয়েছিল ম্যাকমোহন লাইনের মাধ্যমে। সিমলা চুক্তির মাধ্যমে এই লাইন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তাতে চীনকে নেওয়া হয়নি। সেই তখন থেকেই অরুণাচল নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে অরুণাচল অন্যতম কারণ ছিল। ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৬ সালে এই সমস্যার সমাধানে দুই দেশ আলোচনা করেছে। তবে চীন এখনও মনে করে অরুণাচল তাদের।
ছবি: Prabhakar Maniসীমান্ত সমস্যার জেরে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ হয়েছিল। এরপর সরাসরি দুই দেশের মধ্যে আর কোনও যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু ১৯৬৭ সালে সিকিমের নাথু লা-য় দুই দেশের সৈন্য সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালে অরুণাচলের তুলু লা-তে ফের সংঘর্ষ হয় দুই দেশের সেনার। যদিও কোনওটাই দীর্ঘ সংঘর্ষ বা যুদ্ধের স্তরে পৌঁছয়নি। তবে জুন মাসে গালওয়ানের ঘটনা নজিরবিহীন।
ছবি: DW অরুণাচলের কোনো জঙ্গি গোষ্ঠী এখনো পর্যন্ত ঘটনার দায় স্বীকার করেনি। তবে মনে করা হচ্ছে, পরেশ বড়ুয়ার আলফা স্বাধীন এবং নিকি সুমির খাপলাং শাখার জঙ্গিরা এই ঘটনা ঘটিয়েছে। শুক্রবারই অরুণাচলের তিরাপ, চাংলাং, লংডিং জেলাকে অশান্ত এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করার মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। তারপরেই জঙ্গিরা এই আঘাত হানল বলে মনে করা হচ্ছে। এর আগে গত বছর মে মাসে ওই অঞ্চলে একবার সেনার উপর আক্রমণ চালিয়েছিল জঙ্গিরা। নাগাল্যান্ডেও আক্রমণ চালানো হয়েছিল।
বেশ কিছু দিন আগে মায়ানমারে ঢুকে জঙ্গিদের আশ্রয় শিবির ধ্বংস করেছিল ভারতীয় সেনা। তারপর অরুণাচল, নাগাল্যান্ডে আরও কোনো নাশকতার ঘটনা ঘটেনি। বস্তুত, দীর্ঘ দিন ধরেই ভারত সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনা চলছে ওই অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের। অনেকেই অস্ত্র সমর্পন করে আলোচনার টেবিলে বসতে রাজি হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, গত কয়েক বছরে উত্তর পূর্ব ভারত নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের কিছু সিদ্ধান্তের জেরে নতুন করে গোটা অঞ্চলে উত্তেজনা শুরু হয়েছে। এনআরসিকে কেন্দ্র করে গত বছরের শেষ থেকে গোটা উত্তর পূর্ব ভারতই অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। ফের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আলোচনার টেবিলে বসানোর প্রক্রিয়া শুরু করতে না পারলে অশান্তি আরও বাড়বে বলেই মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। একই সঙ্গে চীনও জঙ্গিদের উস্কানি দিচ্ছে বলে কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ মনে করছেন। অরুণাচলের সীমান্তে চীন সেনাও বাড়িয়েছে। অরুণাচলকে অশান্ত করে দিয়ে চীন তার সুযোগ নিতে পারে বলে তাঁরা মনে করছেন।
এসজি/জিএইচ (পিটিআই)