ভারত-অরুণাচল সীমান্ত নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিনের। বস্তুত, পূর্ব সীমান্তে অরুণাচল এবং পশ্চিম সীমান্তে লাদাখ নিয়ে ভারত ও চীনের একাধিকবার সংঘর্ষ হয়েছে। ২০২০ সালে লাদাখের সংঘর্ষ অভূতপূর্ব। তারপর সীমান্তের একাধিক জায়গায় দুই দেশের সেনার স্ট্যান্ডঅফ চলছে।
এরইমধ্যে একাধিক উপগ্রহ চিত্রে দেখা গেছে, ভারতের পূর্ব সীমান্তে অরুণাচলের খুব কাছে চীন কার্যত গ্রাম তৈরি করে ফেলেছে। এবার চীনের সেই সমস্ত পরিকাঠামো নিয়ে মুখ খুলল ভারতীয় সেনা। ভারতীয় সেনার পূর্ব কম্যান্ডের প্রধান লেফটন্যান্ট জেনারেল আরপি কালিতা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, অরুণাচল সীমান্তে চীন প্রচুর কাঠামো তৈরি করছে। এর মধ্যে বিমানবন্দর, রেল যোগাযোগের নির্মাণকাজ যেমন হয়েছে, তেমনই তৈরি করা হয়েছে গ্রাম। এই গ্রামও সামরিক প্রয়োজনেই চীন তৈরি করছে বলে ভারতীয় সেনার অভিযোগ। শুধু তা-ই নয়, ওই অঞ্চলে চীন ফাইভ জি নেটওয়ার্কের পরিকাঠামোও তৈরি করছে বলে অভিযোগ ভারতীয় সেনার।
বার বার সীমান্তে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে ভারত ও চীনের সেনা। কেন? ভৌগোলিক-রাজনৈতিক সংঘাতের ইতিহাস একনজরে দেখে নেওয়া যাক।
ছবি: Rouf Bhat/Afp/Getty Imagesভারত এবং চীনের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ লাদাখে। বাকি অংশ উত্তর পূর্ব ভারতের সিকিম এবং অরুণাচলে।
ছবি: DW/H. Joshiলাদাখ সীমান্তের একটি বড় অংশে মানুষ বসবাস করে না। এই ভৌগোলিক অঞ্চলকে মূলত আকসাই চীন বলা হয়। ভারত মনে করে আকসাই চীন তাদের অংশ। চীন মনে করে আকসাই চীন তাদের। ১৯৬২ সালের যুদ্ধের পরে যাদের সেনা যেখানে ছিল, সেটাকেই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বলে ধরে নেওয়া হয়। কিন্তু দুই দেশই নিজেদের এলাকা বাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে।
ছবি: picture-alliance/AP Photo১৩৪ কিলোমিটার লম্বা প্যাংগং লেক ১৪ হাজার ফুটে অবস্থিত। নোনতা জলের এই হ্রদকে ঘিরে প্রায় ৭০০ বর্গ কিলোমিটার জমি। প্যাংগংয়ের এক-তৃতীয়াংশ ভারতের দখলে। দুই-তৃতীয়াংশ চীনের। প্রকৃত সীমান্তরেখা এই লেকের উপর দিয়ে চলে গিয়েছে। ভারতের দাবি, চীন সেই সীমান্তরেখা অগ্রাহ্য করে ভারতের জমি দখল করছে এবং সীমান্তের খুব কাছে রাস্তা বানাচ্ছে। চীনের দাবি, ভারত নিয়ন্ত্রণরেখা মানছে না।
ছবি: picture-alliance/dpa/P. Karelগালওয়ানের খুব কাছ দিয়ে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা গিয়েছে। চীন তিব্বতের উপর দিয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত একটি হাইওয়ে তৈরি করেছে। যাকে কারাকোরাম হাইওয়ে বলা হয়। ভারতের অভিযোগ, ওই হাইওয়ের জন্যই লাদাখের একটি অংশের দখল নিতে চায় চীন। তা করতে পারলে আরও সহজ একটি বাইপাস রাস্তা তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু ভারত তা হতে দিতে চায় না। গালওয়ান সমস্যার মূল কারণ এটিই।
ছবি: Getty Images/AFP/M. Vatsyayanaদারবুক, শাইয়োক হয়ে সিয়াচেন হিমবাহ পর্যন্ত রাস্তা তৈরি করে ফেলেছে ভারত। শুধু তাই নয়, এই অঞ্চলে দৌলত বেগ ওল্ডিতে ১৬ হাজার ৬১৪ ফুট উচ্চতায় বিশ্বের উচ্চতম এয়ার স্ট্রিপ তৈরি করেছে ভারত। এই এয়ার স্ট্রিপ এবং সিয়াচেন পর্যন্ত রাস্তা নিয়ে চীনের আপত্তি আছে।
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Khawer১৯১৪ সালে ব্রিটিশ আমলে উত্তর পূর্ব ভারত এবং তিব্বতের সীমান্ত নির্দিষ্ট হয়েছিল ম্যাকমোহন লাইনের মাধ্যমে। সিমলা চুক্তির মাধ্যমে এই লাইন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তাতে চীনকে নেওয়া হয়নি। সেই তখন থেকেই অরুণাচল নিয়ে ভারতের সঙ্গে চীনের দ্বন্দ্ব। ১৯৬২ সালের যুদ্ধে অরুণাচল অন্যতম কারণ ছিল। ১৯৯৬ সালে এবং ২০০৬ সালে এই সমস্যার সমাধানে দুই দেশ আলোচনা করেছে। তবে চীন এখনও মনে করে অরুণাচল তাদের।
ছবি: Prabhakar Maniসীমান্ত সমস্যার জেরে ১৯৬২ সালে ভারত-চীন যুদ্ধ হয়েছিল। এরপর সরাসরি দুই দেশের মধ্যে আর কোনও যুদ্ধ হয়নি। কিন্তু ১৯৬৭ সালে সিকিমের নাথু লা-য় দুই দেশের সৈন্য সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। ১৯৭৫ সালে অরুণাচলের তুলু লা-তে ফের সংঘর্ষ হয় দুই দেশের সেনার। যদিও কোনওটাই দীর্ঘ সংঘর্ষ বা যুদ্ধের স্তরে পৌঁছয়নি। তবে জুন মাসে গালওয়ানের ঘটনা নজিরবিহীন।
ছবি: DW লেফটন্যান্ট জেনারেল অবশ্য জানিয়েছেন, ভারতও হাত গুটিয়ে বসে নেই। তারাও দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চলে পরিকাঠামো তৈরির কাজ জারি রেখেছে। তবে দুর্গমতার কারণে সেই কাজ করতে সময় লাগছে। তবে কাজে আরো গতি আনার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি।
২০২০ সালের জুন মাসে লাদাখে ভারত ও চীনের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। বহু ভারতীয় সেনার মৃত্যু হয় তাতে। পরবর্তীকালে জানা যায়, চীনেরও বেশ কিছু সেনা অফিসারের ওই ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে। তারপর থেকেই লাদাখ অঞ্চলে বেশ কিছু জায়গায় ভারত ও চীনের সেনার স্ট্যান্ড অফ শুরু হয়। একাধিক বৈঠকের পর বেশ কিছু অঞ্চলে স্ট্যান্ড অফ উঠলেও এখনো কিছু অঞ্চলে স্ট্যান্ড অফ চলছে। এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে পূর্ব কম্যান্ডের সেনাপ্রধান জানান, ''ম্যাকমোহন লাইন নিয়ে সমস্যা আছে। নির্দিষ্ট সীমান্ত নিয়ে ধোঁয়াশা আছে। চীন যা দাবি করে, ভারত তা মানতে নারাজ। সে কারণেই সীমান্তে সংঘাত আছে।'' সেনাপ্রধানের বক্তব্য, বিভিন্ন চ্যানেলে এ নিয়ে আলোচনা চলছে। আলোচনা জারি থাকবে।
তবে লেফটন্যান্ট জেনারেল জানিয়েছেন, ভারতীয় সীমান্তে চীন ঢুকে পড়েছে বলে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সূত্রে যে দাবি করা হয়, তা ঠিক নয়। ভারতীয় ভূখণ্ডে চীন ঢুকতে পারেনি।
এসজি/জিএইচ (পিটিআই, এনডিটিভি)