জার্মানিতে অর্গানিক বা জৈব পদ্ধতিতে উৎপাদিত পণ্যের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে ক্রেতাদের৷ এই ধরনের খাদ্যদ্রব্য স্বাস্থ্যকর বলে মনে করছে মানুষ৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, ‘অর্গানিক’ লেখা লেবেল থাকলেই কি এই সব জিনিস স্বাস্থ্যসম্মত?
বিজ্ঞাপন
কোনো প্যাকেটের লেবেলে ‘অর্গানিক' শব্দটি থাকলে ভোক্তারা নিশ্চিত থাকতে পারেন যে, ভেতরের পণ্যটি পরিবেশবান্ধব কোনো কৃষিখামার থেকে এসেছে৷ ‘‘অর্গানিক, ইকোলজিক্যাল বা জৈব লেবেলের একটা সুবিধা হলো এই শব্দটি আইনত নির্ধারিত,'' বলেন জার্মান ভোক্তাসুরক্ষা সংস্থা ফুডওয়াচ-এর আন্ড্রেয়াস ভিংকলার৷ তাঁর ভাষায়, ‘‘প্যাকেটের ওপরে জৈব লেখা থাকলে ভেতরেও কমপক্ষে বায়ো মানের জিনিস থাকবে সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত থাকতে পারি৷ এটা লঙ্ঘিত হয়েছে বলে কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি৷''
পরস্পরবিরোধী প্রবণতা
জার্মানিতে জৈব পণ্যের প্রতি একটা পরস্পরবিরোধী প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়৷ একদিকে গত দশকে এর চাহিদা হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে৷ জৈব খাদ্যদ্রব্য বিক্রির ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে জার্মানি৷ যার আর্থিক পরিমাণ সাত বিলিয়ন ইউরো৷ এই দিক দিয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ বাজারে পরিণত হয়েছে জার্মানি৷ বলেন কৃষি ও খাদ্যের ফেডারেল এজেন্সির প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টোফ আইডেন৷
‘অর্গানিক' – কথাটি শুনলে মনে হবে স্বাস্থ্যকর জীবন৷ ইউরোপীয় জৈব লেবেল নিশ্চয়তা দেয় যে, এতে রাসায়নিক কীটনাশক ও সার ব্যবহার করা হয়নি৷ পশুখাদ্যে জিন পরিবর্তন করা উদ্ভিদ মেশানো হয়নি৷ সংযোজিত বস্তুর পরিমাণও সীমিত৷ গতানুগতিক খাদ্যে যেখানে ৩২০ সংযোজিত বস্তু অনুমোদিত৷ সেখানে জৈবখাদ্যে এই রকম পদার্থ থাকে ৫০টিরও কম৷
জার্মানিতে ভেগানদের জীবনযাত্রা
‘ভেগান’ আসলে ঠিক কি বা কারা, এ সম্পর্কে কয়েক বছর আগ পর্যন্তও মানুষ তেমন জানতো না৷ তবে এখন জার্মানিতে ভেগান বা উদ্ভিদভোজীদের সংখ্যা দিনদিন বেড়েই চলেছে৷
ছবি: Fotolia/Gorilla
ভেগান বা উদ্ভিদভোজী
কয়েক বছর আগ পর্যন্ত যারা দুধ, ডিম, মাংস খেতেন না তাদের অন্য চোখে দেখা হতো৷ সময় বদলেছে এবং এরই মধ্যে ভেগানদের সংখ্যা বেড়েছে অনেক৷ ভেগানরা শুধু নিরামিষাশী নন, তাঁরা প্রাণিজাত কোনো কিছু খান না৷ ভেগানরা শুধু স্বাস্থ্যগত কারণেই উদ্ভিদভোজী হচ্ছেন তা নয়, পরিবেশ রক্ষায়ও তাঁরা অবদান রাখতে চান৷ ভেগানদের জন্য রেস্তোরাঁ, সুপার মার্কেট, রান্নার বই, রান্নার কোর্স এসব বর্তমানে খুবই চলছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
রাঁধুনি আটিলা হিল্ডমান
জার্মানির খ্যাতনামা ভেগান রাঁধুনি আটিলা হিল্ডমান (বাঁয়ে)৷ ভেগান রান্না সম্পর্কে লেখা তাঁর বই তিন লাখ কপি বিক্রি হয়েছে৷ ভেগানদের জীবনধারা মানে তাঁর কাছে প্রাণিজাত খাবার পুরোপুরি বাদ দিয়ে জীবনযাপন – অর্থাৎ তাজা, টগবগে থাকা এবং কোনো ধরণের সমস্যা ছাড়াই সহজে ওজন কমানো৷
ছবি: Jenny Hoff
সুস্থ, স্লিম এবং ফিট
‘ভেগান ফর ফিট’ আটিলা হিল্ডমানের এই বইটি বেস্ট সেলারের তালিকায় ছিলো৷ সহজে, সস্তায় এবং কম সময়ে কিভাবে স্বাস্থ্যকর রান্না করা যায়, স্লিম হওয়া যায় তারই কিছু নমুনা রয়েছে বইটিতে৷ যারা স্লিম হতে আগ্রহী তাঁদের মধ্যে বইটি দারুণ সাড়া ফেলেছে৷
ছবি: Fotolia/Gorilla
পশুপাখীদের বন্দি রাখার প্রতিবাদ
আজকাল ভেগান বা উদ্ভিদভোজী হওয়ার ব্যাপারটা অনেক সহজ হয়ে গেছে৷ বড় শহরগুলোতে ব্যাঙের ছাতার মতো ভেগান রেস্তোরাঁ, সুপার মার্কেট গজিয়ে উঠছে৷ জার্মানির ভেজিটারিয়ান সমিতির হিসেব অনুযায়ী, জার্মানিতে বর্তমানে ভেগানের সংখ্যা আট লক্ষ এবং ক্রমেই তা আরো বাড়ছে৷
ছবি: picture alliance/Augenklick/Kunz
সুপার মার্কেটে সয়া মিল্ক
সয়ার তৈরি কাটলেট কিংবা দুধ ছাড়া পনির, এমনকি কুকুর বেড়ালের জন্যও ভেগান খাবার পাওয়া যাচ্ছে আজকাল৷ সাধারণ ডিসকাউন্ট শপগুলোতেও সয়া মিল্ক রাখা হয়৷ ভেগান জীবনধারা, মানে শুধু খাওয়া দাওয়ার দিক দিয়ে নয়, কাপড়-চোপড়ের ব্যাপারেও ভেগানদের জীবনদর্শন পুরোপুরি আলাদা৷ অর্থাৎ চামড়া বা প্রাণিজাত সবকিছুই পরিহার করা৷
ছবি: imago
বিশ্ব জুড়ে ভেগান আলোচনা
সারা বিশ্বেই রয়েছে অনেক ভেগান৷ অ্যামেরিকা এবং ইংল্যান্ডে ঐতিহ্যগতভাবেই ভেগানের প্রভাব অনেক বেশি৷ একথা বলেন জার্মানির ভেজিটারিয়ান সমিতির প্রধান সেবাস্টিয়ান৷ তাঁর মতে, জার্মানি ধীরে ধীরে ভেগানদের নেতৃত্ব দেওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে৷ তাছাড়া ইউরোপ এবং অ্যাংলোঅ্যামেরিকান দেশগুলোর বাইরে ব্রাজিল এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী দেশগুলোতে ভেগান আন্দোলন বর্তমানে খুব শক্তিশালী৷
ছবি: picture-alliance/dpa
আদর্শ, তবে ধর্ম নয়
ভেগান জীবনধারা সত্যিই স্বাস্থ্যকর কিনা এনিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে রয়েছে মতপার্থক্য৷ তবে ভেগানরা তুলনামূলকভাবে অসুস্থ হন কম – বিশেষ করে ডাযয়েবেটিস-২ এর মতো অসুখে৷ রাঁধুনি আটিলা হিল্ডমান বলেন, ভেগান জীবনধারা পুরোপুরি মেনে চলা সম্ভব নয়, যতটা সম্ভব ততটাই নেবো৷ তবে ভেগান জীবনযাপন করা মানে কিন্তু কোনো কিছু থেকে বঞ্চিত হওয়া নয়৷ শুধু এটাই যে খাবারের বিকল্পধারাকে মানুষের সামনে তুলে ধরা৷
ছবি: Eilís O'Neill
ভেগান খাওয়াও উপভোগ করা যায়
মাছ, মাংস বাদ মানেই সবকিছু থেকে বঞ্চিত নয়, বরং বেগুন, শাক-সবজি বা ডালের মজার মজার খাবার এবং নানা ধরনের সালাদে মজাদার ড্রেসিং দিয়ে আরো মজা পাওয়া সম্ভব৷ গত কয়েক বছর ধরে খাবারকে একটু অন্যভাবে তৈরি করে আরো সুস্বাদু করা হয়েছে৷
ছবি: Fotolia/koi88
8 ছবি1 | 8
পরিবেশবান্ধব চাষ হয় যে জমিতে
অন্যদিকে জৈবপদ্ধতিতে চাষাবাদের প্রসার খুব একটা চোখে পড়ার মতো নয় জার্মানিতে৷ ১০০-এর মধ্যে মাত্র সাতটি কৃষিজমিতে পরিবেশবান্ধব চাষাবাদ হয়৷ সব মিলিয়ে ২০ হাজার কৃষিখামারে জৈবিক পদ্ধতিতে কৃষিকাজ হয়৷ এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ কৃষকের সংখ্যাও কিছুটা নিম্নমুখী৷ ভোক্তাদের চাহিদা সত্ত্বেও নিজেদের আর্থিক লাভের দিকটিও দেখতে হয় তাঁদের৷
জমির ইজারার হার, উৎপাদনের খরচ ইত্যাদি খুব বেশি৷ জৈব খাদ্যদ্রব্যের দাম অতিরিক্ত হলে ভোক্তারাও হাত প্রসারিত করতে চান না৷ অন্যদিকে অনিয়মের জন্য প্রায়ই জার্মান জৈবখামারগুলি খবরের শিরোনাম হচ্ছে৷ যেমন পশুখাদ্য আনা হয়েছে এমন সব দেশ থেকে, যা ইউরোপীয় মানসম্মত নয়৷
জার্মানিতে বেশ আদৃত
৭০টি জাতীয় অর্গানিক বা জৈব লেবেল ইউরোপীয় মানের সমপর্যায়ের বলে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে৷ নিয়মিতভাবে পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যাবে বায়ো কৃষিখামারগুলি সঠিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করছে কিনা৷
উৎপত্তি যেখানেই হোক না কেন জৈব লেবেল জার্মানিতে বেশ আদৃত৷ জার্মানি ও ইউরোপীয় জৈব লেবেল অনেকটা সমমানের৷ অবশ্য ফুডওয়াচ এত ধরনের সার্টিফিকেটের সমালোচনা করে৷
ভোক্তারা এত বেশি লেবেল দেখে অনেকটা দিশাহারা হয়ে যান, বুঝে উঠতে পারেন না কোনটা সিরিয়াস আর কোনটাই বা বিজ্ঞাপনের চমক৷ ভোজ্যপণ্যের শিল্পকারখানাগুলি নিজেদের ‘ইমেজ' বাড়ানোর জন্য অনেক সময় এই ধরনের লেবেল লাগিয়ে থাকে৷ যেমন ‘প্রিমিয়াম' বা ‘প্রজাতি উপযোগী কৃষিখামার' ইত্যাদি৷
ফুডওয়াচের দাবি, এক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট চিহ্ন থাকতে হবে৷ যেখানে খাদ্যের পুষ্টিগত মান, উৎপত্তি, জিনপ্রযুক্তির প্রয়োগ ইত্যাদির উল্লেখ থাকবে৷