1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
ব্যবসা-বাণিজ্যবাংলাদেশ

অর্থনীতির গতি ফেরানোর দুরূহতর মিশন

আসজাদুল কিবরিয়া, পরিকল্পনা সম্পাদক, ফিনানশিয়াল এক্সপ্রেস
আসজাদুল কিবরিয়া
২৩ আগস্ট ২০২৪

ছাত্র-জনতা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতন হয়েছে৷ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন গত ৫ আগস্ট৷

অর্থনীতিতে স্বাভাবিক গতিময়তা ফিরিয়ে আনার যে দুরূহতর মিশনে নামতে হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে, তাতে কতটা সাফল্য আসবে, সেটা সময় বলে দেবে৷ছবি: LUIS TATO/AFP

৮ আগস্ট রাতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্র্বতীকালীন সরকার গঠন করা হয়৷

এই সরকার এখন দেশকে একটি স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে তাদের সামনে থাকা অনেকগুলো দুরূহ কাজের মধ্য থেকে৷ এর মধ্যে অর্থনীতির গতি ফেরানোটা অন্যতম দুরূহ ও অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ৷

বস্তুত বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন এক কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ হাসিনা সরকারের অপশাসন, লুটপাট ও মিথ্যাচারের ফলে দেশের ব্যাংকগুলো, তথা আর্থিকখাত ভীষণ নাজুক হয়ে পড়েছে; অব্যাহত চড়া মূল্যস্ফীতি জীবনযাত্রা অত্যন্ত ব্যয়বহুল করে তুলেছে; এবং বেপরোয়াভাবে নেয়া ব্যয়বহুল বিদেশি ঋণের বোঝা ঘাড়ে চেপে বসেছে৷ এসবের সঙ্গে যোগ হয়েছে ছাত্র-জনতা আন্দোলন চলাকালে কল-কারখানার উৎপাদন বন্ধ থাকা এবং হাসিনা সরকারের পতন-পরবর্তী তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কিছু শিল্প-কারখানা ও দোকানপাট আক্রান্ত ও বিনষ্ট হওয়ার নেতিবাচক প্রভাব ৷ এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও ব্যাংকখাতের অবনতি ঠেকানোকে দু'টি প্রথম প্রধান করণীয় হিসেবে বেছে নিয়েছে৷ পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট অন্য বিষয়গুলোতেও ক্রমশ তাদের মনোযোগ বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে৷ কেননা, অর্থনীতির একটি ক্ষেত্র আরেকটির সাথে সম্পৃক্ত৷

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস)-এর হিসেব অনুসারে, চলতি বছর জুলাই মাসে বার্ষিক গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯.৯০ শতাংশ৷ আর এই মাসে এসে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে৷ জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১০ দশমিক ৪২ শতাংশ৷ এক মাসের ব্যবধানে হঠাৎ খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশ খানিকটা বেড়ে গেছে৷ জুলাইয়ে যে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে, তা গত ১৩ বছর ৪ মাস বা ১৬০ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ এর আগে সর্বশেষ সর্বোচ্চ খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ২০১১ সালের এপ্রিলে, ১৪ দশমিক ৩৬ শতাংশ৷ এরপর আর কখনো খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশে ওঠেনি৷

সামষ্টিক অর্থনীতির অব্যবস্থাপনাজনিত পদক্ষেপের নেতিবাচক প্রভাব ও প্রতিক্রিয়ায় দেশে উচ্চহারে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়, যা এখনো চলমান৷ হাসিনা সরকার ক্ষমতার শেষ কয়েক মাসে নির্বিচারে টাকা ছাপিয়ে ঋণ গ্রহণ করায় বাজারে মুদ্রা সরবরাহ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতিকে ঊর্ধ্বমুখী করে রাখে৷ ২০২৩-২৪ অর্থ বছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ৯৪ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে, যার বড় অংশই সরাসরি কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বা টাকা ছাপিয়ে৷ আবার ঘাটে ঘাটে চাঁদাবাজির কারণে পণ্য সরবরাহ-ব্যবস্থা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ায় খুচরা বাজারে পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গিয়ে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেয়৷ তথ্য-উপাত্তের গোলমাল ও কারসাজির কারণে বিভিন্ন পণ্য ও সেবার প্রকৃত উৎপাদন, সরবরাহ ও চাহিদার প্রকৃত চিত্র স্পষ্ট না থাকায় মধ্যে চাহিদা-জোগানের ভারসাম্যহীনতা বজায় থেকে মূল্যস্ফীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে৷ এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিভাবে মূল্যস্ফীতিকে কয়েকমাসের মধ্যে উপদেষ্টাদের প্রত্যাশা অনুসারে  যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনতে সক্ষম হবে, তা দেখার বিষয়৷

তবে এটাও মনে রাখতে হবে, মূল্যস্ফীতি নিম্নমুখী হতে শুরু করলে, যা হবে তা হলো: মূল্যস্ফীতির গতি কমবে বা ভোক্তা মূল্য লাফিয়ে বাড়বে না, বাড়বে ধীর গতিতে৷ এতে করে ভোক্তারা বাজারে বেশিরভাগ পণ্যই আর দু-এক বছর আগে যে দামে কিনতে পেরেছিলেন, তা পাবেন না৷ তাঁরা হয়ত ছয় থেকে নয় মাস আগে যে দাম দিয়েছিলেন, তার চেয়ে কিছুটা কম দামে কিনতে পারবেন৷ আর কিছু পণ্যের দাম অপরিবর্তিতই থাকবে৷

দেশের ব্যাংকখাতে বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণের বোঝা গোটা আর্থিক খাতকেই ভীষণভাবে নাজুক করে দিয়েছে৷ চলতি বছরে মার্চ মাসের শেষে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার কোটি টাকা, যা বিতরণকৃত মোট ব্যাংক ঋণের ১১ শতাংশ৷ অন্যদিকে ২০০৮-২০২৩ সময়কালে দেশে ব্যাংকখাতে দু'ডজন কেলেঙ্কারির ঘটনায় ৯২ হাজার কোটি টাকা লোপাট হয়ে গেছে বলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-র এক গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়৷ এই পরিমাণ টাকা দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির (২০২২-২৩ অর্থবছর) দুই শতাংশ এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের ১২ শতাংশ৷

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতায় আসার পর প্রথম মেয়াদেই দেশের সবচেয়ে ভালো একটি ব্যাংক বেসিক ব্যাংকের সর্বনাশ ঘটায় সরকারদলীয় চেয়ারম্যান আবদুল হাই বাচ্চুর মাধ্যমে৷ তিনি একাই দেড় বছরের মধ্যে সাড়ে চার হাজার কোটি নানা অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে সরিয়ে ফেলেন নামে-বেনামে ঋণ নিয়ে৷ এই সময়কালে সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গোষ্ঠী অনিয়মের মাধ্যমে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করে৷ এভাবে বছরের পর বছর ছোট-বড় নানা অনিয়মের মাধ্যমে চলতে থাকে লুটপাট আর তৈরি করা হয় স্বজনতোষী গোষ্ঠী৷ বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রণালয় নীরব দর্শকের ভূমিকা পালনের পাশাপাশি লুটপাটের কিছু উপায়কে বৈধতাও দেয় নিয়ম-কানুন পাল্টে ও শিথিল করে৷ এক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাবের দৌরাত্ম এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, গণমাধ্যমেও কিছু সংবাদ প্রকাশ হওয়া ছাড়া কোনো প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ নেয়া যায়নি৷ আবার ২০১৭ সালে জামাত-শিবিরমুক্ত করার নামে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা-পর্ষদ পাল্টে ফেলা হয় জবরদস্তিমূলকভাবে, কোনো নিয়ম-কানুনেরর তোয়াক্কা না করে৷ চট্টগ্রামভিত্তিক শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রপের দখলে দেয়া হয় দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি ও সফলতম বাণিজ্যিক ব্যাংকটিকে৷ পাশাপাশি আরো কয়েকটি ব্যাংকের মালিকানা প্রায় এককভাবে এই শিল্পগোষ্ঠীর কাছে তুলে দেয়া হয় রাজনৈতিক মদদে৷ ছয় বছরের মধ্যে শুধু ইসলামী ব্যাংক থেকেই প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা নামে-বেনামে ঋণ নিয়েছে এই গোষ্ঠী ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো৷ এর অনেকটাই নানা অনিয়ম ঘটিয়ে নেয়ায় বড় অংশই ফেরত না আসার আশঙ্কা রয়েছে৷ মাঝখান থেকে ব্যাংকটিকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে৷ আরো পাঁচ ব্যাংকে এই শিল্পগোষ্ঠীর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ রয়েছে৷

বস্তুত বাংলাদেশের গোটা ব্যাংক খাত এখন যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে করে এতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং খেলাপি ঋণ আদায় করে ব্যাংকগুলোকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ব্যবসা করতে দেয়ার ব্যবস্থা করা দুঃসাধ্যই বটে৷ সরকার অবশ্য একটি ব্যাংক কমিশন গঠন করে এই খাতের সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচর্নার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ এই কমিশন ভবিষ্যৎ করণীয় নিয়ে একটি বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনাও দেবে৷

আবার দেশি-বিদেশি ঋণের বিপুল বোঝাও একটি বিরাট দায় হয়ে রয়েছে৷ বিশেষত বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ আগামী দিনে আরো বাড়বে৷ হাসিনা সরকারের নেয়া বিদেশের ঋণের স্থিতি এখন প্রায় সাত হাজার কোটি ডলার, যা আগামী দিনে বিভিন্ন মেয়াদে পরিশোধ করতে হবে, কোনোটি দ্রুত আর কোনোটি একটু দেরিতে৷ যেমন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের প্রায় এক হাজার ২০০ কোটি ডলারের ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সালের৷ তবে এ সময় আরো দুই বছর পিছিয়ে দেওয়ার জন্য রাশিয়ার সাথে দেন-দরবার চলছে৷

বিদেশি ঋণ যেহেতু বৈদেশিক মুদ্রায়, তথা মার্কিন ডলারে পরিশোধ করতে হয়, সেহেতেু রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হয়৷ রপ্তানি আয়ে শ্লথগতির বিপরীতে প্রকৃত আয়কে কারসাজি করে ফুলিয়ে দেখানোর ফলে লেনদেনের ভারসাম্যের হিসাবে বড় ধরনের গোলমাল সম্প্রতি ধরা পড়েছে৷ প্রকৃত রপ্তানি আয় কম হওয়ায় তা কাগজে-কলমে লুকানো রাখা গেলেও রিজার্ভের পতন ঠেকানো যায়নি৷ আবার রিজার্ভও অনেক বছর ধরে বাড়িয়ে দেখানো হচ্ছিল৷ ফলে, অর্থনীতির চিত্র অনেকটাই বিকৃত আকারে সামনে এসেছে, যার ওপর ভিত্তি করে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ সমস্যা বাড়িয়েছে বৈ কমায়নি৷

সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে একটা স্বাভাবিক গতিময়তা ফিরিয়ে আনার যে দুরূহতর মিশনে নামতে হয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে, তাতে কতটা সাফল্য আসবে, সেটা সময় বলে দেবে৷ আপাতত বেশ কিছুদিন ধৈর্য সহকারে অপেক্ষা করার কোনো বিকল্প নেই৷

আসজাদুল কিবরিয়া ঢাকাভিত্তিক দি ফাইনান্সিয়াল এক্সপ্রেসের পরিকল্পনা সম্পাদক৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ