২০ বছর পর ইউরোর দর ডলারের নীচে নেমে গেছে৷ ২৫ বছরের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নে মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে৷ কিন্তু মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধের এমন ফল কি এড়ানোর উপায় ছিল?
বিজ্ঞাপন
অর্থনীতির নিম্নমুখী প্রবণতার এই ধাক্কা বিশ্বের সবদেশেই আঘাত হেনেছে৷ কিন্তু সব দেশের জন্য এটি সমান ফল বয়ে আনেনি৷
জার্মানিতে জ্বালানির জন্য রাশিয়ার ওপর অতি নির্ভরশীলতা নিয়ে আলোচনা কয়েক দশকের৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি পুঁজিবাদী এবং সমাজতন্ত্রী এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে পূর্ব-পশ্চিমে বিভক্ত হয়৷ কিন্তু ১৯৯১ সালে বার্লিন দেয়াল পতনের পর থেকে একদিকে যেমন রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টা ছিল প্রতিটি সরকারের, অন্যদিকে জার্মানদের এক অংশের মধ্যে রাশিয়ার প্রতি সন্দেহের দৃষ্টিও ছিল বরাবরাই৷
সবসময়ই এমন আশঙ্কা ছিল, রাশিয়ার গ্যাসের ওপর জার্মানদের অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা যে-কোনো বিপর্যয়ের সময় ভোগান্তির কারণ হয়ে দেখা দেবে৷ কিন্তু তারপরও সেই নির্ভরশীলতা কমানো হয়নি, বিকল্প কোনো ব্যবস্থার চিন্তাও মাথায় রাখা হয়নি৷ ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় রাশিয়া৷ এরও আগে ২০০৮ সালে জর্জিয়ার দুটো অংশ আবখাজিয়া এবং সাউথ ওশেটিয়াকে একই ভাবে বিচ্ছিন্ন করে রাশিয়া৷ কিন্তু তারপরও আরো বড় কিছু হওয়ার সম্ভাবনা বা আশঙ্কা থেকে জ্বালানি নিরাপত্তার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়নি৷
২০২১ সালেও জার্মানিতে আসা গ্যাসের ৫৫ শতাংশই ছিল রাশিয়া থেকে৷ জার্মান অর্থ মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে, এখন তা ৩৫ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে৷ কিন্তু গ্যাসের এই ঘাটতি পূরণ করতে যেমন টালমাটাল অবস্থায় পড়তে হচ্ছে জার্মানিকে, অন্যদিকে যে-কোনো সময় ৩৫ শতাংশ গ্যাসও রাশিয়া বন্ধ করে দিতে পারে, এমন শঙ্কা দেখা দিয়েছে৷
ইউরোপ, বিশেষ করে জার্মানির অবস্থা এখন শাঁখের করাতের মতো৷ একদিকে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ এবং ইউরোপে পশ্চিমা অংশীদার রাষ্ট্রগুলোকে নিয়মিত হুমকিধামকি দেয়াটা জার্মানির নীতিগত অবস্থানের কারণেই প্রতিবাদ করতে হচ্ছে৷ অন্যদিকে, রাশিয়ার ওপর জ্বালানি ছাড়াও অন্য নানা নির্ভরতার কারণে চাইলেই কড়া পদক্ষেপ নিয়ে রাশিয়াকে একঘরেও করে দেয়া যাচ্ছে না৷
অর্থনীতির ধাক্কায় বিপর্যস্ত কিছু দেশ
করোনা মহামারির ধাক্কা, ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে বিশ্বজুড়ে নানা দেশেই চলছে অর্থনৈতিক অস্থিরতা৷ শ্রীলঙ্কায় তা রূপ নিয়েছে রাজনৈতিক অস্থিরতায়৷ এমন আরো কিছু দেশের বর্তমান পরিস্থিতির কথা থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Ali Khara/REUTERS
আফগানিস্তান
গত বছর মার্কিন সৈন্য প্রত্যাহার এবং তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে অর্থনৈতিক ও মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে আফগানিস্তান৷ দেশজুড়ে খাদ্য সংকটের ফলে অপুষ্টি মহামারি আকার নিয়েছে৷ হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তথ্যমতে, দেশটির ৫৫ শতাংশ মানুষ রয়েছেন খাদ্য নিরাপত্তার চরম হুমকিতে৷ দাতাদের নানা ধরনের অর্থ সহায়তা অবরুদ্ধ হওয়ায় এ সংকট দিনদিন আরো তীব্র রূপ নিচ্ছে৷
ছবি: Ali Khara/REUTERS
ভেনেজুয়েলা
ভেনেজুয়েলার অর্থনৈতিক সংকট কয়েক দশক ধরেই চলমান৷ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি- ডাব্লিউএফপি-র মতে দেশটিতে প্রতি তিন জনে একজন ভুগছেন খাদ্য নিরাপত্তার অভাবে৷ করোনার কারণে অর্থনৈতিক ও মানবিক সংকট আরো তীব্র হয়েছে৷ ইউক্রেন যুদ্ধ বাড়িয়ে দিয়েছে জ্বালানি ও খাদ্য সংকট৷ এর ফলে বিদ্যুৎ এবং সুপেয় জলের অভাবও দেখা দিয়েছে৷
ছবি: Roman Camacho/ZUMA Press/imago images
মধ্যপ্রাচ্য
মধ্যপ্রাচ্যের বেশকিছু দেশে দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছে৷ এমনিতেই দেশগুলোর অর্থনীতি টালমাটাল৷ করোনা এবং ইউক্রেন যুদ্ধ এসব দেশকে নিয়ে যাচ্ছে বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে৷ সংকটে থাকা দেশগুলোর মধ্যে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ও ইয়েমেন ছাড়াও রয়েছে লিবিয়া, ইরাক এবং লেবাননও৷ ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট দেশগুলোর নাগরিকদের ঠেলে দিচ্ছে চরম দারিদ্র্যের দিকে৷
ছবি: Essa Ahmed/AFP/Getty Images
সুদান
গত বছরের শেষ দিকে আফ্রিকার এই দেশটিতে সামরিক অভ্যুত্থান হয়৷ এরপর থেকেই ধস নেমেছে দেশটির অর্থনীতিতে ৷ জানুয়ারিতে দেশটির রপ্তানি কমে যায় ৮৫ শতাংশ৷ জাতিসংঘের তথ্য বলছে, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিশ্বজুড়ে খাদ্যের মূল্যবৃদ্ধি ইত্যাদি কারণে দেশটির ৩০ শতাংশের বেশি মানুষ আছেন খাদ্য সংকটে৷ দেশটির ১৮টি প্রদেশে দেড় কোটি মানুষ খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছেন৷
ছবি: Ashraf Shazly/AFP/Getty Images
নেপাল
ব্যাপক আমদানি-নির্ভরতার ফলে নেপালের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে৷ দেশটির বাণিজ্য ঘাটতি বাজেটের প্রায় সমান হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ নেপালের মোট আমদানির দুই-তৃতীয়াংশই আসে ভারত থেকে৷ অন্যদিকে, ভারতের মুদ্রার সঙ্গে একই দর নির্ধারিত থাকায় ভারতীয় টাকার পতনের সঙ্গে নেপালি মুদ্রারও স্বয়ংক্রিয় পতন ঘটছে৷ ইউক্রেন থেকে তেল ও নানা খাদ্যদ্রব্যের আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশটির অর্থনীতিতে ধসের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Diego Azubel/dpa/picture alliance
পাকিস্তান
বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যমতে, মে-জুন মাসের মূল্যস্ফীতিতে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কার পরই রয়েছে পাকিস্তান৷ দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি এক অংকের ঘরে থাকলেও শ্রীলঙ্কায় ৫৬.৬% এবং পাকিস্তানে মূল্যস্ফীতি পৌঁছে গেছে ২১.৩ শতাংশে৷ বিদেশি ঋণ পরিশোধ নিয়ে জটিলতা এবং দ্রুত খালি হয়ে যাওয়া বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ দেশটিকে দ্রুতই অস্থিরতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে৷
ছবি: KARIM ULLAH AFP via Getty Images
তুরস্ক
তুরস্কের পরিসংখ্যান সংস্থা জানিয়েছে, জুন মাসে দেশটির বার্ষিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭৮.৬২%৷ দেশটির মূল্যস্ফীতির এ হার গত ২৪ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ৷ ইউক্রেন যুদ্ধ, পণ্য়ের মূল্যবৃদ্ধি এবং টার্কিশ মুদ্রা লিরার দর কমতে থাকায় এই মূল্যস্ফীতি আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে৷ দেশটির সরকারি তথ্য অনুযায়ী, আগের বছরের তুলনায় এ বছর পরিবহণের খরচ বেড়েছে ১২৩.৩৭ শতাংশ, খাদ্য ও পানীয়ের মূল্য বেড়েছে ৯৩,৯৩ শতাংশ৷
ছবি: Sha Dati/Xinhua/imago images
7 ছবি1 | 7
মুখে কড়া কথা বললেও আদতে কড়া অর্থনৈতিক, সামরিক বা কূটনৈতিক কোনো পদক্ষেপই নিতে পারছে না জার্মানি এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷ শুরু থেকেই ইউক্রেন ইস্যুতে জার্মানির অপেক্ষাকৃত নরম অবস্থানের ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে৷ অস্ত্র বা ভারি সামরিক সরঞ্জাম পাঠানোর সিদ্ধান্ত অন্য দেশগুলোর তুলনায় বেশ দেরিতে নিয়েছে৷
কিন্তু জার্মানি নরমই থাক বা গরম, এককভাবে এখন আর অর্থনীতিকে সামলে রাখার কোনো উপায় নেই৷ রাশিয়ায় গণতন্ত্র নেই৷ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিনের কথাই শেষ কথা৷ ফলে রুবলের দাম কতটা কমলো, রুশ অর্থনীতি কতটা নিম্নগামী হলো, তাতে আসলে পুটিনের তেমন একটা মাথাব্যথা থাকার কথাও না৷ কিন্তু ইউরোপের ক্ষেত্রে ঘটনাটা ভিন্ন৷ জার্মানি-ফ্রান্সের মতো গণতান্ত্রিক দেশে অর্থনীতি নিম্নগামী হতে থাকলে তার প্রভাব সমাজ এবং রাজনীতিতে পড়তে বাধ্য৷
করোনার মহামারিতে এরই মধ্যে বিপর্যস্ত অর্থনীতি ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আরো সংকটের দিকে ধাবিত হচ্ছে৷ যুদ্ধ শুরুর মাসখানেক পরই জার্মানির বাজারে গম ও সূর্যমুখী তেলসহ নানা নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সংকট দেখা দেয়৷ ডোমিনো ইফেক্টের মতো এইসব পণ্যের বিকল্প পণ্য যেমন চাল, জলপাই বা অন্য উদ্ভিজ্জ তেলের দামও বাড়তে থাকে৷
জ্বালানির দাম বাড়তে থাকায় এখন প্রায় প্রতিটি পণ্য ও সেবার খরচ কয়েকগুণ বেড়ে গেছে৷ তারচেয়ে বড় ভয়ের কারণ সামনে শীতকাল৷ ঘর গরম রাখার জন্য পর্যাপ্ত গ্যাস বা তেল না পেলে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে৷
এখনই বাসায় চিঠি আসছে, শিগগিরই ঘর উষ্ণ করার খরচ বাড়তে পারে৷ বার্লিনের একটি প্রতিষ্ঠান গ্যাস বা তেলে ঘর উষ্ণ রাখার খরচ দ্বিগুণ করে দিয়েছে৷ জার্মানির তিন হাজার হাউজিং প্রতিষ্ঠানের সংগঠন জিডিডাব্লিউ জানিয়েছে, আগামী বছরে প্রতিটি বসতবাড়িকে জ্বালানির জন্য তিন হাজার ৮০০ ইউরো বাড়তি খরচ করতে হতে পারে৷ ফেডারেল নেটওয়ার্ক এজেন্সি জানিয়েছে, ঘর উষ্ণ রাখার মাসিক খরচ আগামি বছর অন্তত তিন গুণ হতে পারে৷
উচ্চবিত্তরা কোনোভাবে এ খরচ সামাল দিলেও, নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের জন্য করোনার পর এই বাড়তি খরচ হবে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা৷ কিভাবে এই পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছেন জার্মান রাজনীতিবিদরা? সম্ভবত, পরিস্থিতি তাদের হাতে খুব একটা নেই৷ শীতকালে বাঁচতে এখন থেকেই সবাইকে বিদ্যুৎ বাঁচানোর চেষ্টা করার আহ্বান জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী রবার্ট হাবেক৷
আর নির্বাচনে জিতেই একীভূত জার্মানির সবচেয়ে বড় সংকট মোকাবিলার দায়িত্ব পাওয়া চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎস কী বলছেন? জানিয়েছেন, বিশ্বের কোনো দেশই দামবৃদ্ধির সংকট এড়াতে পারবে না৷ ফলে, ‘‘সবকিছুতে আমরা ভর্তুকি দিতে পারবো না৷’’
তাহলে ভবিষ্যৎ কী? অচিরেই যদি পুটিনকে ঠেকিয়ে ইউক্রেন পরিস্থিতি শান্ত করার মাধ্যমে বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যের চাকা জোরেসোরে চালু না করা যায়, তাহলে ভয়াবহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কা রয়েছে৷
রাশিয়ার সরবরাহ করা গ্যাস পুরোপুরি বন্ধ হলে ঠিক কী ঘটতে পারে, এ নিয়ে জুনে এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে অর্থনৈতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান প্রোগনোস৷ সেখানে দেখা গেছে, চার সপ্তাহ পরই সবার জন্য গ্যাস সরবরাহ করা সম্ভব হবে না৷ আইন অনুযায়ী, বসতবাড়ি, সমাজসেবা প্রতিষ্ঠান এবং হিটিং সরবরাহকারীদের গ্যাস দিতেই হবে৷ ফলে গ্যাস বন্ধের প্রথম প্রভাব পড়বে শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উপর৷ ইস্পাত, অপরিশোধিত লোহা, রাসায়নিক এবং কাচের কারখানায় উৎপাদন অর্ধেকে নেমে আসবে৷
সমগ্র অর্থনীতিই এর ফলে সংকটে পড়বে৷ প্রোগনোস ধারণা করেছে, রাশিয়ার গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হলে বছরের শেষে জার্মানির অর্থনীতি ১২ দশমিক সাত শতাংশ সংকুচিত হতে পারে৷
গত ৩০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি হয়েছে জার্মানিতে৷ কয়েক দশকের মধ্যে এই প্রথম রপ্তানির চেয়ে বেশি আমদানি করছে জার্মানি৷
মানুষের না খেয়ে-পরে থাকলে পুটিনের কিছু যায় আসে কিনা জানি না৷ কিন্তু জার্মানি এবং ইউরোপকে নৈতিক কারণে নিজের জনগণের পাশাপাশি বিশ্বের কথাও ভাবতে হবে৷ এই কথাটা পুটিন জানেন বলেই জ্বালানি ও খাদ্যকে প্রয়োজনে‘যুদ্ধের অস্ত্র’ হিসাবেও তিনি ব্যবহার করতে প্রস্তুত৷
রাশিয়ার অর্থনীতিতে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব
ইউক্রেনে হামলার কারণে নানামুখী নিষেধাজ্ঞায় পড়েছে রাশিয়া৷ দেশটি বলছে অর্থনীতিতে এর প্রভাব যতটা পড়বে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল ততটা পড়েনি৷ তবে বিশ্লেষকদের মতে, প্রকৃত পরিস্থিতি নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে৷
ছবি: Pavel Bednyakov/SNA/IMAGO
নিষেধাজ্ঞার বহর
২২ ফেব্রুয়ারির পর থেকে রাশিয়ার উপর ৮,২২৫টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বিভিন্ন দেশ৷ আমদানি-রপ্তানি, ঋণ প্রদান, লেনদেন ব্যবস্থা সুইফট থেকে বাদ দেয়াসহ নানা নিষেধাজ্ঞা ঝুলছে দেশটির উপরে৷ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ঝুঁকি ও নিষেধাজ্ঞা নিয়ে কাজ করা কাস্টেলাম-এর হিসাবে সবচেয়ে বেশি দুই হাজার ২৬টি নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র৷ এরপর আছে সুইজারল্যান্ড, ক্যানাডা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, জাপান৷
ছবি: Torsten Sukrow/SULUPRESS.DE/picture alliance
রুবলের উল্লম্ফন
নিষেধাজ্ঞার পরও রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা পদক্ষেপে দেশটির মুদ্রা দুর্বল হওয়ার বদলে শক্তিশালী হয়েছে৷ জানুয়ারির পর থেকে মে পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে রুবল ৪০ শতাংশ শক্তিশালী হয়েছে৷ জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য, রাশিয়া থেকে আমদানি পণ্যের মূল্য রুবলে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা এর পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে৷
ছবি: Jakub Porzycki/NurPhoto/picture alliance
বেড়েছে মূল্যস্ফীতি
জুনের হিসাবে এক বছর আগের তুলনায় রাশিয়ায় মূল্যস্ফীতি বা জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১৭ শতাংশ৷ তবে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার কারণে যতটা মূল্যস্ফীতি হবে বলে ধারণা করা হয়েছে, প্রকৃতপক্ষে বছর শেষে তা আরো কম হবে৷ যে কারণে মূল্যস্ফীতির পূর্বাভাস ১৮ থেকে ২৩ শতাংশের বদলে ১৪ থেকে ১৭ শতাংশে নামিয়ে এনেছে তারা৷
ছবি: Alexey Malgavko/REUTERS
খরচ কমিয়েছেন ভোক্তারা
জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির কারণে কেনাকাটা কমিয়ে দিচ্ছেন রাশিয়ার মানুষ৷ পণ্যের মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের হিসাব থেকে এমন তথ্যই মিলছে৷ গত এপ্রিলে যা ৫৪ শতাংশ কমেছে বলে রাশিয়ার দৈনিক কমারস্যান্টকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে রয়টার্স৷ ফেডারেল স্ট্যাটিস্টিকস সার্ভিসের হিসাবে একই মাসে খুচরা বিক্রি কমেছে ৯.৭ শতাংশ৷ ব্যবসা ও ভোক্তা ব্যয়ে ‘চাহিদা সংকট’ রয়েছে বলে স্বীকার করেছেন অর্থমন্ত্রী ম্যাক্সিম রেশেটনিকভও৷
ছবি: Peter Kovalev/TASS/dpa/picture alliance
প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাসে পরিবর্তন
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদন অনুযায়ী রাশিয়ায় এপ্রিলে জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমেছে তিন শতাংশ৷ মে মাসে দেশটির সরকার থেকে জানানো হয়েছিল চলতি বছর জিডিপি সাত দশমিক আট শতাংশ কমতে পারে৷ তবে অর্থমন্ত্রী ম্যাক্সিম রেশেটনিকভ সম্প্রতি বলেছেন, এই হার পাঁচ থেকে ছয় শতাংশে সীমাবদ্ধ থাকবে৷ অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সের পূর্বাভাস, বিদেশি বিনিয়োগ ও শিল্পোৎপাদন কমায় জিডিপি কমবে ১৫ শতাংশ৷
ছবি: Gavriil Grigorov/dpa/picture alliance
আমদানি কমেছে অনেক
যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞায় বিনিয়োগ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ও শিল্প উৎপাদন কমায় রাশিয়ার আমদানি ব্যাপকভাবে কমেছে৷ রাশিয়ার বাণিজ্যিক ব্যাংক ওটক্রিতির তথ্য দিয়ে দ্য মস্কো টাইমস জানিয়েছে, এপ্রিলে ৫০০ কোটি থেকে এক হাজার কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে দেশটি৷ যেখানে ফেব্রুয়ারিতে আমদানি হয়েছে দুই হাজার ৭৫০ কোটি ডলারের পণ্য৷ তবে সরকারের পক্ষ থেকে সবশেষ মাসের আমদানি, রপ্তানি বিষয়ক তথ্য প্রকাশ করা হয়নি৷
ছবি: Yuri Smityuk/TASS/dpa/picture alliance
চাঙা জ্বালানি রপ্তানি
দ্য ইকোনোমিস্ট-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জ্বালানি রপ্তানি থেকে এখনও দৈনিক ১০০ কোটি ডলার আয় করে চলেছে রাশিয়া৷ হেলসিংকিভিত্তিক দ্য সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিয়ার এয়ার-এর তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন হামলার পর প্রথম ১০০ দিনে জ্বালানি রপ্তানি থেকে ৯৭ বিলিয়ন ডলার আয় করেছে মস্কো৷ এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল-এর তথ্য অনুযায়ী, বছরের প্রথম পাঁচ মাসে দেশটির তেল রপ্তানি থেকে আয় ১২ শতাংশ বেড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Y. Aleyev
গাড়ি বিক্রিতে ধাক্কা
অ্যাসোসিয়েশন অব ইউরোপিয়ান বিজনেসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চাহিদা কমে যাওয়া এবং কাঁচামাল সংকটের কারণে মে মাসে গাড়ি বিক্রি রেকর্ড ৮৩ শতাংশ কমেছে৷ রুশ পরিসংখ্যান দপ্তর রসস্ট্যাট-এর তথ্য অনুযায়ী, গাড়ির দাম ৫০ শতাংশ বেড়েছে৷ গাড়ি শিল্পের ক্ষতি কাটাতে প্রণোদনার উদ্যোগ নিতে ১৬ জুন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন ভ্লাদিমির পুটিন৷
ছবি: Stanislav Krasilnikov/TASS/dpa/picture alliance
সার্বিক প্রভাব কতটা?
রুশ অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘‘প্রথম প্রান্তিকের (অর্থনৈতিক) ফলাফল এবং এপ্রিল-মে মাসের পূর্বাভাস বলছে, যতটা খারাপ আশঙ্কা করা হয়েছিল পরিস্থিতি ততটা খারাপ হবে না৷’’ তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান এলভিরা নাবিউলিনা সেন্ট পিটার্সবার্গের অর্থনৈতিক ফোরামে বলেছেন, বিদেশি চাপে রুশ অর্থনীতি যে চাপে পড়েছে, তা অনির্ধারিত সময় ধরে চলমান থাকার শঙ্কা রয়েছে৷ পরিস্থিতি আগের অবস্থায় আর ফিরবে না বলেও আশঙ্কা তার৷
ছবি: picture-alliance/dpa/V. Belousov
প্রকৃত পরিস্থিতি
আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাশিয়ার প্রকৃত পরিস্থিতি কী সেটি এখনও পরিস্কার নয়৷ দীর্ঘমেয়াদে দেশটির অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে যাচ্ছে, তা জানতে অপেক্ষা করতে হবে৷ বিশেষ করে রাশিয়া ছাড়ার ঘোষণা দেয়া বিভিন্ন বিদেশি কোম্পানিগুলো কর্মীদের বেতন দেয়া বন্ধ করলে তা মানুষের আয়ে প্রভাব ফেলবে৷ তবে কর্মসংস্থান, আমদানি, রপ্তানিসহ অর্থনীতির সাম্প্রতিক বিভিন্ন পরিসংখ্যান প্রকাশ বন্ধ রেখেছে দেশটির সরকার৷