ইউরোপ তথা বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী একটি রাষ্ট্র জার্মানি৷ দেশটির অর্থনীতি বিস্তৃত এবং সমৃদ্ধ৷ এই অর্থনীতি এক বদনামেরও ভাগীদার করেছে ইউরোপের দেশটিকে৷
বিজ্ঞাপন
জার্মানিকে অনেকেই মনে করেন ‘অর্থপাচারের স্বর্গরাজ্য'৷ দেশটির বিস্তৃত অর্থনীতিতে ব্যাংকিং ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে হাতে হাতে নগদ লেনদেন এখনো বহুলভাবে প্রচলিত রয়েছে৷ ছোটবড় ব্যবসায়ীরা ক্যাশ ট্রানজেকশন পছন্দ করেন৷ অবস্থা এমন যে কেউ চাইলে একটি বাড়িও কিনে ফেলতে পারবেন ব্রিফকেস ভর্তি টাকা নিয়ে গিয়ে৷
নগদ অর্থের এমন লেনদেন নিয়ন্ত্রণ বেশ কঠিন৷ আর এই সুযোগে দেশটিকে ‘অর্থপাচারের স্বর্গরাজ্য' হিসেবে ব্যবহার করছেন দেশি-বিদেশি অর্থপাচারকারীরা৷ ইটালির মাফিয়ারাসহ অনেকের বিপুল অর্থ জার্মানির নানা খাতে বিনিয়োগ করে বা নানাভাবে লুকিয়ে রাখা হয়েছে৷
জার্মান সরকার অবশ্য ‘অর্থপাচারের স্বর্গরাজ্য' হিসেবে নিজেদের বদনাম ঘোচাতে আগ্রহী৷ এজন্য বছর দুয়েক আগে তিনটি উদ্যোগ নিয়েছে দেশটি৷
০১. অর্থ সংক্রান্ত অপরাধ দমনে নতুন একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ তৈরি
০২. আরো বেশি বিশেষজ্ঞকে প্রশিক্ষণ প্রদান
০৩. সংশ্লিষ্ট সম্পদের তথ্য ডিজিটালাইজ করে তা সংযুক্ত করা
বাণিজ্য ও হুন্ডির আড়ালে টাকা পাচারের যত কৌশল
বৈধভাবে স্থানান্তরের সহজ উপায় না থাকলেও বিদেশে ঠিকই বড় অঙ্কের বিনিয়োগ করছেন অনেক বাংলাদেশি৷ বিপুল টাকা রাখছেন ব্যাংকেও৷ এই অর্থপাচারের কৌশলগুলো কী জেনে নিন ছবিঘরে...
ছবি: Fotolia/Trueffelpix
পণ্যের মূল্য বেশি দেখানো
ধরা যাক শিল্প কারখানার জন্য এক লাখ ডলারের যন্ত্র আমদানির ঋণপত্র খুললেন দেশের কোনো আমদানিকারক৷ কিন্তু এই পণ্যের প্রকৃত মূল্য ৫০ হাজার ডলার৷ মূল্য বাবদ ব্যাংকের মাধ্যমে তিনি এক লাখ ডলার পাঠিয়ে দিলেন বিক্রেতাকে৷ সেই ব্যক্তি তার দামটি রেখে বাকি টাকা আমদানিকারকের বিদেশের কোনো অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিলেন৷ এতে দেশ থেকে ৫০ হাজার ডলার পাচার হয়ে গেল৷ টাকা পাচারের এই কৌশলটি পরিচিত ‘ওভার ইনভয়েসিং’ নামে৷
ছবি: Md Manik/ZUMA Wire/imago images
রপ্তানির মূল্য কম দেখানো
ধরা যাক দেশের কোনো রপ্তানিকারক ৫০ হাজার ডলারের পণ্য বা সেবা রপ্তানির ঘোষণা দিলেন, যদিও তার প্রকৃত মূল্য এক লাখ ডলার৷ পণ্য পৌঁছানোর পর ক্রেতা দেশে ৫০ হাজার ডলার রপ্তানিকারককে পাঠালেন, আর অঘোষিত ৫০ হাজার ডলার তার বিদেশের কোনো অ্যাকাউন্টে পাঠিয়ে দিলেন৷ মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে এভাবে রপ্তানিকারক দেশে অর্জিত ৫০ হাজার ডলার পাচার করলেন৷ টাকা পাচারের এই কৌশলটি পরিচিত ‘আন্ডার ইনভয়েসিং’ নামে৷
ছবি: Yu Fangping/Costfoto/picture alliance
পণ্যের পরিমাণে হেরফের
শুধু টাকার গড়মিল না, আমদানি বা রপ্তানিকৃত পণ্যের হিসাবের গড়মিলের মাধ্যমেও অর্থ পাচার হয়৷ যেমন, কোনো রপ্তানিকারক ৫০ হাজার পিস পোশাক রপ্তানির ঘোষণা দিয়ে এক লাখ পিস রপ্তানি করতে পারেন৷ এর মাধ্যমে অতিরিক্ত ৫০ হাজার পিসের টাকা তিনি বিদেশে পাচার করলেন৷ উল্টোভাবে আমদানিকৃত পণ্যের পরিমাণ অতিরিক্ত দেখিয়ে বেশি দাম পরিশোধের মাধ্যমে টাকা পাচার হতে পারে৷
ছবি: Saudi Press Agency/REUTERS
ভুয়া কাগজপত্র তৈরি
বাণিজ্যের আড়ালে টাকা পাচারের আরেকটি উপায় হলো ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করা৷ কোনো পণ্য আমদানি না করেই ভুয়া ঋণপত্র এবং শুল্ক ও বন্দর কর্তৃপক্ষের ভুয়া ছাড়পত্র দেখিয়ে ব্যাংকের মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার হয়৷ অনেক সময় একই পণ্যের আমদানির বিপরীতে একাধিক ঋণপত্র খুলে সেই পণ্যের নামে একাধিকবার টাকা পাঠানো হয়৷ সহজে যাতে ধরা না পড়েন তার জন্য বিভিন্ন ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেন টাকা পাচারকারীরা৷
ছবি: imago/blickwinkel
টাকা পাঠানোর ভিন্ন চ্যানেল বা হুন্ডি
প্রবাসীরা জটিলতা এড়াতে স্বীকৃত পদ্ধতির বদলে অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলে টাকা পাঠান, যা হুন্ডি নামে পরিচিত৷ এই পদ্ধতিতে তারা বিদেশে কোনো ব্যক্তির কাছে বা কোনো মাধ্যমে টাকা হস্তান্তর করেন৷ হুন্ডি পরিচালনাকারী নেটওয়ার্ক সমপরিমাণ টাকা প্রবাসীর পরিবারকে পরিশোধ করে দেয়৷ এতে পরিবার টাকা বুঝে পেলেও প্রবাসীর অর্জিত মূল্যবান অর্থ দেশে পৌঁছে না৷ টাকা পাচার করতে চান- এমন কারো বিদেশি অ্যাকাউন্টে হয়ত তা চলে যায়৷
ছবি: Imago/Steinach
কর স্বর্গে ছায়া কোম্পানি
পাচার করা অর্থ বিদেশে রাখা ও কর ফাঁকি দেয়ার আরেকটি প্রচলিত উপায় হলো ‘কর স্বর্গ’ হিসেবে পরিচিত দেশগুলোতে বেনামে কোম্পানি খোলা৷ এই কোম্পানিগুলোর সাধারণত কাগজ-কলমেই অস্তিত্ব থাকে৷ কয়েক স্তরে এমনভাবে এর মালিকানা আড়াল করা হয় যে প্রকৃত ব্যক্তির নাম জানা কঠিন হয়ে পড়ে৷ অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ জমা রাখা, নিজ দেশের বড় অংকের কর ফাঁকি দেয়া ও পাচারকৃত টাকা আড়াল করতে এই ধরনের কোম্পানি ব্যবহারের অভিযোগ আছে৷
ছবি: Imago/M. Bäuml
বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব
বিনিয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি মেলে৷ উন্নয়নশীল বা স্বল্পোন্নত দেশের ধনী ও দুর্নীতিগ্রস্তরা এই সুযোগ লুফে নেন৷ ক্যারিবীয় দ্বীপরাষ্ট্র ছাড়াও ইউরোপের মাল্টা, বুলগেরিয়া, সাইপ্রাস, লুক্সেমবুর্গে বিদেশিদের জন্য এমন স্কিম আছে৷ এই ‘গোল্ডেন ভিসা স্কিম’-এর মাধ্যমে ইইউ দেশগুলো গত দশকে আড়াই হাজার কোটি ডলার আয় করেছে৷ এর সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী সাইপ্রাস ও স্পেন৷
ছবি: DW/A. de Loore
কর স্বর্গে বাংলাদেশিরা
পানামা, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড কিংবা হংকংয়ের মতো কর স্বর্গে বিভিন্ন সময়ে কোম্পানি খুলেছেন বাংলাদেশিরাও৷ অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক কনসোর্টিয়াম আইসিআইজে-র ফাঁস হওয়া চারটি নথিতে বাংলাদেশ সংশ্লিষ্ট ১০২ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম পাওয়া যায়৷ এর মধ্যে হাইকোর্টের নির্দেশে দুদক ২০২১ সালে পানামা ও প্যারাডাইস পেপার্স কেলেঙ্কারিতে উঠে আসা ৪৩টি ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা আদালতে জমা দিয়েছে৷
ছবি: Fotolia/Trueffelpix
বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের আড়ালে পাচার
বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিনান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ২০২১-২২ অর্থবছরে শতকরা ২০ থেকে ২০০ শতাংশ অতিরিক্ত আমদানি মূল্যের ৮,৫৭১টি অর্থপাচারের ঘটনা শনাক্ত করে৷ এই সংখ্যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে ৬২.৩৩ শতাংশ বেশি৷ ২০২৩ সালে তৈরি পোশাক রপ্তানির আড়ালে ৩৩টি গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠানের ৮২১ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর৷ ঘটনাগুলো ঘটেছে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৩ সালের মে মাস পর্যন্ত৷
ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS
বছরে চার হাজার কোটি টাকার ক্ষতি
ট্যাক্স জাস্টিস নেটওয়ার্কের হিসাবে, বিদেশে অর্থ স্থানান্তর করে কর ফাঁকির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতি বছর ৩৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার বা প্রায় চার হাজার ৩৫৭ কোটি টাকা হারাচ্ছে৷ এই অর্থ বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বাজেটের ৩১ শতাংশ ও শিক্ষার ছয় শতাংশের বেশি৷ মাথাপিছু হিসাবে দুই ডলার বা ২০০ টাকার উপরে৷ এর মধ্যে বহুজাতিক কোম্পানিগুলো ৩৭ কোটি ডলার ও ব্যক্তি পর্যায়ে ফাঁকির পরিমাণ দুই কোটি ৬০ লাখ ডলার৷
ছবি: Syed Mahamudur Rahman/NurPhoto/IMAGO
গোল্ডেন ভিসায় বাংলাদেশিরা
বিনিয়োগের মাধ্যমে নাগরিকত্ব বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি নেয়ার পদ্ধতি পরিচিত গোল্ডেন ভিসা স্কিম নামে৷ গত কয়েক বছরে ক্যানাডা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশিদের এই সুযোগ নেয়ার খবর উঠে এসেছে৷ যেমন মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম প্রকল্পে ন্যূনতম এক লাখ ২৫ হাজার ডলার বিনিয়োগ করতে হয়৷ দেশ থেকে বৈধভাবে এত টাকা স্থানান্তরের সুযোগ না থাকলেও বাংলাদেশের নাগরিকেরা এই স্কিম ব্যবহারে উপরের দিকে আছেন৷
ছবি: bdnews24.com
পরিসংখ্যানে অর্থ পাচার
কোন দেশ থেকে কত টাকা পাচার হয় তা বোঝার একটি কৌশল আমদানি-রপ্তানি করা দেশ ও গন্তব্যের পরিসংখ্যান তুলনা করা৷ তার ভিত্তিতে ওয়াশিংটনভিত্তিক গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি জানাচ্ছে, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সালে বাংলাদেশ থেকে বছরে সম্ভাব্য ৮২৭ কোটি ডলার বা ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে৷ অন্যদিকে, ২০২১ সালে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমান ছিল ৮৭ কোটি সুইস ফ্রাঁ বা আট হাজার কোটি টাকার বেশি৷
ছবি: Stefan Klein/imagebroker/picture alliance
12 ছবি1 | 12
ইতোমধ্যে নিয়ন্ত্রণ খাতে সংস্কার এনেছে জার্মানি এবং অর্থনীতি সংক্রান্ত অপরাধের অভিযোগ তদন্তে আগের চেয়ে গতি এসেছে৷ তবে তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷ তাদের মতে, জার্মানির বিভিন্ন খাতে অবৈধ অর্থ বিনিয়োগের সুযোগ বন্ধে আরো কঠোর উদ্যোগ নিতে হবে৷
প্রাথমিক আপত্তি সত্ত্বেও জার্মানি শেষমেষ ৫০০ ইউরোর নোট বাজার থেকে তুলে নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ নগদ টাকা জমিয়ে রাখতে এবং একসঙ্গে অনেক টাকা পাচারের জন্য পাচারকারীদের কাছে এই নোট বেশ জনপ্রিয় ছিল৷ যদিও এই নোট এখনো বাতিল করা হয়নি, তবে তুলে নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে পুরোদমে৷ অর্থাৎ কেউ এই নোট ব্যাংকে জমা দিলে সেটা আর ফেরত দেওয়া হচ্ছে না৷ ব্যাংকও ৫০০ ইউরোর নোট আর বাজারে ছাড়ছে না৷
পাশাপাশি, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) জুড়ে নগদ টাকায় লেনদেন সর্বোচ্চ দশ হাজার ইউরোর মধ্যে রাখার উদ্যোগ নিয়েছে জোটটি৷ ইইউর সব সদস্য রাষ্ট্র এটি অনুমোদন করলে অর্থপাচার কমাতে সেটি ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷ সদস্য রাষ্ট্রগুলো চাইলে নিজ নিজ দেশে নগদ টাকায় লেনদেনের সীমা আরো কমিয়েও রাখতে পারবে৷
এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, ব্যাংকের চেয়ে ঘরে টাকা রাখতে এবং নগদ টাকায় লেনদেনে আগ্রহী জার্মানরা এসব উদ্যোগে কতটা সাড়া দেন৷