খেলাই তাদের খ্যাতি দিয়েছে। অথচ হামেশা তারা খেলার বাইরের জগতে প্রবেশ করে অযথা আলোড়ন তোলেন।
বিজ্ঞাপন
বছর চারেক আগের ঘটনা। ভারতের জনপ্রিয় টিভি শো 'কফি উইথ করণ'-এ এসে হার্দিক পান্ডিয়া ও কে এল রাহুল এমন সব মন্তব্য করেছিলেন, যার ফলে ভারতে বিতর্কের সুনামি উঠেছিল। তারা মেয়েদের নিয়ে, নিজেদের যৌন জীবন নিয়ে সোজাসাপটা নানা কথা বলেছিলেন। মেয়েদের নিয়ে মন্তব্য তো রীতিমতো মর্যাদাহানিকর।
আসলে ভারতে ক্রিকেট খেলে যদি জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া যায়, তাহলে খুব কম বয়সে বিপুল অর্থ ও তার থেকেও বেশি খ্যাতি পাওয়া যায়। আর আজকাল ক্রিকেটের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে গেছে বলিউড, জড়িয়ে গেছে মডেলিংয়ের দুনিয়া। এই দুনিয়ার সঙ্গে বাস্তবের সম্পর্ক নেই বললেই চলে। তারা থাকে নিজের জগতে। যে দুনিয়ার রীতিনীতি, নিয়ম-কানুন আলাদা। আর ক্রিকেটাররা যখন সুযোগ পায়, তখন তাদের বয়স ২২-২৩-এর মতো। ফলে মাথা ঘুরে যাওয়া স্বাভাবিক। সেখানে মাথা ঠিক রেখে বিতর্ক এড়িয়ে কেমনভাবে থাকতে হয়, তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলেন শচিন রমেশ টেন্ডুলকর এবং রাহুল দ্রাবিড়।
নারীঘটিত কেলেঙ্কারি, শিশু গৃহকর্মী, দর্শক, এমনকি সতীর্থ খেলোয়াড়কে মারধরের মতো ঘটনা ঘটিয়েছেন বাংলাদেশের কিছু ক্রিকেটার৷ ছবিঘরে থাকছে সেইসব কথা৷
ছবি: Bdnews24.com
রুবেল হোসেন
২০১৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর নাজনীন আক্তার হ্যাপি নামে এক নারী প্রতারণার অভিযোগে রুবেল হোসেনের বিরুদ্ধে মামলা করেছিলেন৷ এই ঘটনায় ২০১৫ সালের ৮ জানুয়ারি জেলে যেতে হয়েছিল রুবেলকে৷ এরপর বিসিবির সহায়তায় জামিন পেয়ে বিশ্বকাপ খেলতে গিয়েছিলেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/M. Egerton
আল আমিন হোসেন
২০১৫ সালে বিশ্বকাপ চলাকালীন শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছিল তাকে৷ পরের বছর বিপিএলের সময় হোটেলে নারী অতিথি নিয়ে যাওয়ার ঘটনায় তাকে জরিমানা করা হয়েছিল৷ নির্যাতন ও মারধরের অভিযোগ এনে গতবছর আল আমিনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তার স্ত্রী ইসরাত জাহান৷ মামলাটি এখনও চলছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/F. J. Brown
শাহাদাত হোসেন
২০১৯ সালে জাতীয় লিগের ম্যাচ চলার সময় সতীর্থ খেলোয়াড় আরাফাত সানি জুনিয়রকে মারধর করায় পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ হন তিনি৷ তবে নিষেধাজ্ঞার দেড় বছর পর ক্যানসারে আক্রান্ত মায়ের চিকিৎসার খরচ চালাতে ক্রিকেটে ফিরতে বিসিবির কাছে আবেদন করেন শাহাদাত৷ পরে তার নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়৷ এর আগে ২০১৫ সালে শিশু গৃহকর্মী নির্যাতনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল৷ ওই মামলায় প্রায় দুই মাস জেলে থাকতে হয়ে তাকে৷
ছবি: bdnews24/T. Ahammed
আরাফাত সানি
একজন স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থায় নাসরিন সুলতানা নামে আরেকজনকে বিয়ে করেছিলেন সানি৷ ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে সানির বিরুদ্ধে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে মামলা করেছিলেন নাসরিন সুলতানা৷ অভিযোগে বলা হয়েছিল, ভুয়া একাউন্ট খুলে সানি তার (নাসরিন সুলতানার) আপত্তিকর ছবি ফেসবুকে ছড়িয়েছেন৷ ঐ মামলায় প্রায় দুই মাস জেল খেটে জামিনে মুক্তি পেয়েছিলেন সানি৷
ছবি: Bdnews24.com
মোহাম্মদ শহীদ
২০১৭ সালে বিসিবির কাছে শহীদের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন স্ত্রী ফারজানা আক্তার৷ অভিযোগে বলা হয়, ২০১১ সালে তাদের বিয়ের সময় শহীদদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিল না, তবে সংসার ছিল সুখের৷ কিন্তু ২০১৫ সালে জাতীয় দলে অভিষেকের পর একাধিক নারী ভক্তের সঙ্গে শহীদের ঘনিষ্ঠতা হয়েছে বলে দাবি করেন ফারজানা৷ সেই সময় ‘ঝামেলা’ মিটিয়ে নেয়ার কথা বলেছিলেন শহীদ৷ পরের বছর সামাজিক মাধ্যমে নতুন বিয়ের ছবি প্রকাশ করেন তিনি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
সাব্বির রহমান
২০১৭ সালে জাতীয় লিগের ম্যাচ চলার সময় কিশোর দর্শককে মারধরের অভিযোগে ২০ লাখ টাকা জরিমানা ও ৬ মাস ঘরোয়া ক্রিকেটে নিষিদ্ধ ছিলেন৷ ২০১৬ সালে বিপিএল চলার সময় হোটেল কক্ষে নারী অতিথি নিয়ে যাওয়ায় তাকে ১৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছিল৷ ২০১৭ সালে মেহেদী হাসান মিরাজকে মারধরের অভিযোগে তাকে দলের বাইরে রাখা হয়েছিল৷ এছাড়া আম্পায়ারকে গালি, নিজ গাড়ির চালককে পেটানোর মতো অভিযোগও উঠেছিল তার বিরুদ্ধে৷
ছবি: picture-alliance/M. Egerton
নাসির হোসেন
সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি টি-টেন লিগে দুর্নীতির অভিযোগ নাসিরসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছে আইসিসি৷ নাসিরের নারীসঙ্গ নিয়ে একসময় অনেক কথাই চালু ছিল৷ নাসিরের মোবাইল সিম ও বান্ধবী সংখ্যা নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন বিসিবি সভাপতিও৷ ২০১৮ সালে নাসিরের এক কথিত মডেল বান্ধবী তাদের সম্পর্ক নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে ‘বোমা’ ফাটিয়েছিলেন তাতে সতীর্থ খেলোয়াড়েরা ছাড়াও ভীষণ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ে গিয়েছিল বিসিবি৷
ছবি: Getty Images/AFP/U. Zaman
তানজিম হাসান সাকিব
জাতীয় দলে নতুন সুযোগ পাওয়া তানজিমের ফেসবুক পেজের বেশ কিছু পুরোনো স্ট্যাটাস নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনা হচ্ছে৷ এর মধ্যে কর্মজীবী নারীদের হেয় করে দেওয়া একটি স্ট্যাটাসই বেশি সমালোচিত হচ্ছে৷ এমন স্ট্যাটাস দেওয়ার ব্যাপারে তানজিম ক্ষমা চেয়েছেন বলে জানান বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা বিভাগের প্রধান জালাল ইউনুস৷
ছবি: Ishara S.Kodikara/AFP/Getty Images
সাকিব আল হাসান
টিভি ক্যামেরার সামনে অশালীন ভঙ্গিতে বাজে ইঙ্গিত করা, স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগে দর্শককে পিটিয়ে আহত করা, আম্পায়ারদের সঙ্গে অসদাচরণ ইত্যাদি৷ এছাড়া অনাপত্তিপত্র না নিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজে সিপিএল খেলতে যাওয়ার মাঝপথ থেকে ফিরিয়ে আনায় টেস্ট ও ওয়ানডে দল থেকে অবসর নেওয়ার হুমকি দিয়ে ছয় মাস নিষিদ্ধ হয়েছিলেন সাকিব৷ এরপর জুয়াড়ির কাছ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর সেটি গোপন করায়ও এক বছর নিষিদ্ধ হন তিনি৷
ছবি: Aijaz Rahi/AP/picture alliance
মোহাম্মদ আশরাফুল
বিপিএলে ম্যাচ পাতানো ও স্পট ফিক্সিংয়ের ঘটনায় জড়িত থাকার কথা ২০১৩ সালে স্বীকার করেছিলেন আশরাফুল৷ এজন্য তাকে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল বিসিবি৷
ছবি: Getty Images
একসঙ্গে ৬ ক্রিকেটারের জাতীয় দল থেকে পদত্যাগ
২০০৮ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর হাবিবুল বাশার, আফতাব আহমেদ, শাহরিয়ার নাফীস, ফরহাদ রেজা, ধীমান ঘোষ ও মোশাররফ হোসেন রুবেল জাতীয় দল থেকে পদত্যাগ করেন৷ পরে জানা যায়, তারাসহ ১৪ জন ক্রিকেটার ইন্ডিয়ান ক্রিকেট লিগের (আইসিএল) নবম দল হিসেবে যোগ হওয়া ঢাকা ওয়ারিয়র্সে খেলবেন৷ ১৭ সেপ্টেম্বর ঐ ১৪ ক্রিকেটারকে ১০ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করেছিল বিসিবি৷
ছবি: MANPREET ROMANA AFP via Getty Images
11 ছবি1 | 11
তারা কখনো এমন কিছু করেননি যাতে তাদের ভাবমূর্তি খারাপ হতে পারে। শচিন অনেকবার বলেছেন, তার দিকে তাকিয়ে থাকে ভারতের যুবসমাজ। তাই তাকেও সেইভাবে চলতে হয়।
কিন্তু সকলে তো সচিন বা রাহুল নন, তাই তারা হামেশা বিতর্ক ডেকে আনেন। যেমন এনেছিলেন হার্দিক ও কে এল রাহুল। করনের শো-তে হার্দিক মেয়েদের সম্পর্কে বলেছিলেন, ''আই হ্যাভ টু সি হাউ দে(গার্লস) মুভ ফার্স্ট। আই হ্যাভ টু ইমাজিন দ্য পিকচার।''
কে এল রাহুল বলেছিলেন, তার যখন ১৮ বছর বয়স, তখন তার মা কনডম পান। তারপর বকুনি। মা চলে যাওয়ার পর বাবা এসে বলেছিলেন, তুমি যে ওটা ব্যবহার করছ, তা দেখে আমি খুশি। নিজেকে নিরাপদ রাখাটা জরুরি।
আর হার্দিক বলেছিলেন, তিনি যেদিন কৌমার্য হারিয়েছিলেন, সেদিন বাড়িতে ঘোষণা করেছিলেন, 'আজ করকে আয়া।'
হার্দিক ও রাহুলের কথা আর দীর্ঘ করব না। এরপর বিসিসিআই জানায় কমিটি অফ অ্যাডমিনিস্ট্রেটরের সুপারিশ মেনে দুজনকে সাসপেন্ড করা হচ্ছে। বিদেশ সফর থেকে তাদের ফেরত আনা হয়। সেসময়ের অধিনায়ক বিরাট কোহলি জানান, দল তাদের মন্তব্যের সঙ্গে একমত নয়।
এখন অবশ্য সেসব অতীত। হার্দিক এখন টি২০-তে অধিনায়কত্ব করছেন। কে এল রাহুলও সহ-অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন।
ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। জনপ্রিয় বললে ভুল হবে। ক্রিকেট মানে এখন উন্মাদনা। বিশেষ করে আইপিএল আসার পর থেকে তো একদিকে টাকা, অন্যদিকে চায়-ছয় ও গ্ল্যামারের বন্য়া বইছে। তবে আইপিএল আসার আগেও ক্রিকেটারদের নিয়ে উন্মাদনা কম হয়নি। একটা সময় ভিভ রিচার্ডসের সঙ্গে নীনা গুপ্তার সম্পর্ক বা সোবার্সের সঙ্গে অ়ঞ্জু মহেন্দ্রর প্রেম নিয়ে কম লেখালিখি হয়নি।
এমনকী সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে নাগমার সম্পর্ক নিয়েও তো কম গুঞ্জন ওঠেনি। অনেক পরে নাগমা একবার মুখ খুলেছিলেন। ২০২০ সালে তিনি যখন সামাজিক মাধ্যমে সৌরভকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানান, তখনও আলোড়ন কম হয়নি। সৌরভ অবশ্য আগাগোড়া নীরব থেকেছেন। কিছুদিন আগে সৌরভের সঙ্গে বিরাট কোহলির ঝগড়া তো অসম্ভব খারাপ মোড় নিয়েছিল। তখন বোর্ড প্রেসিডেন্ট সৌরভকে কার্যত মিথ্যাবাদী বলেছিলেন বিরাট। বিরাটের সঙ্গে গৌতম গম্ভীরের ঝগড়াও তো টিভির কল্যাণে সকলে দেখে ফেলেছেন।
তেমনই কম হইচই হয়নি ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফিক্সিং দুর্নীতিতে ডুবে থাকার অভিযোগ নিয়ে। দ্রুতগতির বোলার শ্রীসন্থকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। জেলে যেতে হয়েছিল। অজয় জাদেজার ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের নির্বাসনের নির্দেশ দেয়া হয়। ভারতের সাবেক অধিনায়ক ও শিল্পী ক্রিকেটার আজহারউদ্দিনের নামও বেটিং কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িয়েছিল। তবে আদালত পরে জানায়, তার বিরুদ্ধে কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ নেই। ক্রিকেটাররা যদি কিছু পয়সার লোভে ম্যাচ ফিক্সিংয়ে জড়ান, তাহলে আর কী বাকি থাকে!
একেবারে হালের ঘটনায় আসা যাক। মহম্মদ শামির সঙ্গে তার স্ত্রী হাসিন জাহানের সম্পর্ক। হাসিন জাহান অভিযোগ করেন, শামি তাকে নির্যাতন করেছেন, শামি অন্য মেয়েদের প্রতি আসক্ত ইত্য়াদি। এই অভিযোগের পর শামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল। মামলা এখনো আদালতে চলছে। ২০১৪ সালে শামির সঙ্গে হাসিনের বিয়ে। চার বছর পরেই হাসিন অভিযোগ করা শুরু করেন। হাসিন ফেসবুকে শামির বিয়ে-বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে পোস্ট করেছেন। বিস্ফোরক কথা বলেছেন। যেহেতু বিষয়টা বিচারাধীন, তাই ফয়সালা না হলে কিছু বলা যাচ্ছে না।
ক্রিকেটাররা যদি ক্রিকেটের বাইরের বিষয়ে বেশি নজর দেন, অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন হয়েও যদি অনুশীলনে ফাঁকি দেন, তাহলে কী হয়, তার উদাবহরণ হিসাবে আমাদের সামনে আছেন বিনোদ কাম্বলি। শচিনের একদা ঘনিষ্ঠ বন্ধু, যাকে একসময় তার মতোই প্রতিভাধর মনে করা হত, সেই কাম্বলি তো ক্রিকেট দুনিয়া থেকেই হারিয়ে গেলেন।
আসলে যেখানে এত বিপুল অর্থের হাতছানি, যেখানে ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িয়ে যায় বলিউড, যেখানে ক্রিকেটারদের দেখলেই অন্ধের মতো ছুটে যায় মানুষ, সেখানে এই খ্যাতি, যশ, অর্থের মধ্যে মাথা ঠিক রাখাও কঠিন। ফলে প্রতিনিয়ত একটা পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাদের। সীমার মধ্যে থাকার পরীক্ষা। কেউ তা পারেন, কেউ পারেন না। না পারলেই তখন বিতর্ক তাড়া করে তাদের। কারণ, এটা এমন দুনিয়া, যেখানে হিরো থেকে জিরো হতে বেশি সময় লাগে না।