অশান্ত ভাঙড়, রণক্ষেত্র ক্যানিং, বীরভূম, এ কীসের যুদ্ধ?
১৪ জুন ২০২৩
পঞ্চায়েতে মনোনয়ন নিয়ে ভয়ংকর অবস্থা পশ্চিমবঙ্গে। দেখে মনে হচ্ছে, যেন যুদ্ধ হচ্ছে। শুধু বোমা, গুলি, লাঠি, বাঁশ দিয়ে মার।
বিজ্ঞাপন
মঙ্গলবার সারাদিন ধরে ভাঙড় ছিল অশান্ত। আইএসএফ প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র পেশ করতে গেলে বিডিও অফিসের কাছে মুড়ি-মুড়কির মতো বোমা পড়ে, গুলি চলে। সেই সঙ্গে চলে বাঁশ, লাঠি, বোতলের ব্যবহার। সবকিছুই হয়েছে পুলিশের সামনে।
বুধবার আবার ভাঙড়ে একই ছবি। এদিন ভাঙড়এক নম্বর ব্লকে আইএসএফ নেতা শওকত মোল্লা মনোনয়নপত্র জমা দেবেন বলে ঠিক ছিল। আর সকাল থেকে দলে দলে তৃণমূল কর্মী লাঠি, হাঁসুলি, বাঁশ ইত্যাদি নিয়ে প্রস্তুত ছিল। তাদের প্রথম রাগ গিয়ে পড়ে সংবাদমাধ্যমের উপর।
টিভি৯-এর সাংবাদিক সায়ন্তকে বাঁশপেটা করা হয়। চিত্রসাংবাদিককে হাঁসুলি দিয়ে মারার চেষ্টা করা হয়। মুখে কালো কাপড় বাঁধা একদল যুবক সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের ঘিরে ধরে। দাবি, তারা কোনো খবর দেখাতে পারবেন না।
আনন্দবাজার জানাচ্ছে, ভাঙড়ে তৃণমূল নেতা শাজাহান মোল্লার নেতৃত্বে মিছিল বের হয়। সেখানে অনেকের হাতেই ছিল লাঠি, বাঁশ। মিছিল থেকে বোমা ছোড়া হয় বলে অভিযোগ। ভাঙড়ে এদিন প্রচুর পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও এই গোলমাল সমানে চলছে।
ভানু বাগ এলাকায় বোমা সম্রাট নামে পরিচিত ছিল
একের পর এক বাজি কারখানায় বিস্ফোরণ। এগরায় বেআইনি কারখানায় কি তৈরি হতো বোমা? গ্রাম ঘুরে ডিডাব্লিউ-র তদন্তমূলক রিপোর্ট।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মিনতি বাগ
এগরায় যেখানে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেই গ্রামেরই বাসিন্দা মিনতি। ডিডাব্লিউকে তিনি জানিয়েছেন, বরাবর ওই কারখানাটিকে ফুলঝুরির কারখানা হিসেবে জেনে এসেছেন তিনি। এর বাইরে আর কিছু জানেন না।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আরতি পাল
এই বাজির কারখানা অনেক বছর ধরে আছে। মৃত ভানু বাগ এই এলাকার জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন।গ্রামের সব অনুষ্ঠানে বাজি পোড়ানো হতো। কিন্তু কারখানার ভিতরে কখনো ঢুকিনি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মধুমিতা ওঝা
এখানে বাজি বানানো হতো অনেক বছর ধরে। লোকের মুখে শুনেছি, বাজি ছাড়াও বোমা তৈরি হতো এখানে। অনেকেই একথা বলতেন। আমার বাড়ি পাশের গ্রামে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
শত্রুঘ্ন মাইতি
সবাই জানে এখানে হাত বোমা বানানো হতো। বিভিন্ন পুজোয় এবং চড়কে হাত বোমা ফাটানো হতো। হাতবোমা টেস্ট করতে গিয়েই বারুদের স্তূপে আগুন লেগেছে বলে শুনেছি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রবীন্দ্র বাগ
এই কারখানা থেকে প্রত্যেকদিন সকালে ৭টা ৪৫ এর বাসে হাওড়ায় মাল যেত। সারা বছর কি বাজির সাপ্লাই হয়? তাহলেই বুঝুন আর কোন মাল যেত? ভানু যে কাজ করেছে তার জন্য আমাদের মাথা হেঁট হয়ে যাচ্ছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রতন বাগ
এদের বাজি কলকাতা হয়ে দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়তো বলে শুনেছি। এখানে বেশ কিছু পুরনো ধরনের বাজি তৈরি হতো। তাই অনেক চাহিদা ছিল। ভানু বাগের জল বোমা বিখ্যাত ছিল। ভানু তৃণমূলের সদস্যও ছিলেন।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মানিক পাত্র
সাধারণ আতসবাজিতে কখনো এমন বিস্ফোরণ হয়? এখানে বড় ধরনের কিছু তৈরি হতো। ২০০৩ সাল থেকে এই কারখানা দেখছি। শুনেছি এখানে বোমাই বেশি বানানো হতো।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বিষ্ণুপদ জানা
এই বেআইনি কারখানাটি ২৫ বছর ধরে চলছে। সকলের নাকের ডগায়। কেউ কোনোদিন প্রশ্ন করার সাহস পায়নি। আতসবাজি তৈরি হতো। কিন্তু এখানে যে মানুষ মারার বোমা তৈরি হতো, তা এই গ্রামে সবাই জানেন। কেউ মুখ খোলার সাহস পাননি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
সজল কর
২০০২ সাল থেকে এদের ব্যবসার রমরমা। এখানে সব ধরনের বোমাই বানানো হতো। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় সেই বোমা চালান হতো। যত দিন গেছে, এদের ব্যবসা ততই ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কলকাতা বীরভূমে নিয়মিত মাল যেত। পুলিশকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দেওয়া হতো বলে শুনেছি। ভানু এখানে বোমাসম্রাট বলে পরিচিত ছিল।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
9 ছবি1 | 9
ভাঙড়ের তৃণমূল কর্মীরা বিডিও অফিসের সামনে লাঠি, বাঁশ নিয়ে ঘুরছে। টিভি-র ক্যামেরায় তৃণমূল কর্মীরা বলেছেন, তাদের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়েছে। তারা এখন আইএসএফ নেতার পিঠের চামড়া তুলে নেবেন। অ্যাকশন হবে। আইএসএফ প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র পেশ করতে দেয়া হবে না।
সাড়ে দশটা থেকে বেলা সওয়া একটা পর্যন্ত ভাঙড় ছিল মুক্তাঞ্চল। আইএসএফের প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র পেশ করতে দেয়া হয়নি। সওয়া একটার পর পুলিশের বিশাল দল ও অফিসাররা সেখানে যায়।
তারপরেও তৃণমূল কর্মীরা বিডিও অফিসের সামনে দল বেঁধে দাঁড়িয়েছিল।
ক্যানিংয়ে গুলি
দক্ষিণ ২৪ পরগনার ক্যানিংয়ে তৃণমূলের দুই গোষ্ঠীর মধ্যে তুমুল লড়াই হয়। বাসন্তী হাইওয়েতে দুই দলের মধ্যে বোমা ও গুলির লড়াই চলে। একজন গুলিবিদ্ধ হন। রাস্তা অবরোধ শুরু হয়। এত বেশি বোমা পড়ছিল যে, দেখে মনে হচ্ছিল ক্যানিং যেন একটা যুদ্ধক্ষেত্র।
এই লড়াই আদি তৃণমূল বনাম যুব তৃণমূলের মধ্যে বলে অভিযোগ।
ক্যানিংয়ে সিপিএমের একটি অফিসও ভেঙে দেয়া হয়।
ইন্দাসে গোলমাল
বাঁকুড়ার ইন্দাসে বিজেপি প্রার্থীরা মিছিল করে মনোনয়নপত্র জমা দিতে যান। পাল্টা জমায়েত ছিল তৃণমূলের। সেসময় পুলিশ বিজেপি কর্মীদের উপর লাঠি চালায় বলে অভিযোগ।
ইন্দাসে দুইটি গাড়ি থেকে প্রচুর বোমা উদ্ধার। জরুরি তলব পেয়ে এই বোমা নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল বলে পুলিশ মনে করছে।
বীরভূমের আমেদপুরোও বিজেপি কর্মীদের রাস্তায় ফেলে মারা হয়েছে বলে অভিযোগ।
মালদহ থেকেও প্রচুর বোমা ও আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে।
বিস্ফোরণের গ্রাম বলছে, বোমা তৈরি হতো বাজি কারখানায়
এগরা থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরে খাদিকুল গ্রাম। সেখানেই বাজি তৈরির কারখানায় মঙ্গলবার ভয়ংকর বিস্ফোরণ হয়েছে। কারখানাটি ভানু বাগের। অভিযোগ, তিনি তৃণমূলের সঙ্গে যুক্ত। উপরের ছবিটি ভানু বাগের কারখানার। এই কারখানায় বেআইনিভাবে বাজি বানানো হতো বলে অভিযোগ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
মৃতদেহ ছিটকে পড়ে রাস্তায়
বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই বেশি ছিল যে, মৃতদেহগুলি ছড়িয়ে পড়ে রাস্তায়। কারখানা থেকে বেশ কিছুটা দূরে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বাজি না বোমা?
বিস্ফোরণের তীব্রতা দেখে সাবেক পুলিশ কর্তা সলিল ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন, বাজি থেকে এরকম হয় না। বোমা থেকে হয়।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
'বোমা তৈরি হতো'
স্বামী শক্তিপদ বাগের সঙ্গে মালতী বাগ ওই কারখানায় কাজ করতেন। স্বামী মারা গেছেন। সেদিন মালতী দেরি করে যাবেন ঠিক করেছিলেন বলে বেঁচে গেছেন। ডিডাব্লিউকে তিনি বলেছেন, ''ওরা সবরকম বোমা বানাতো। অভিযুক্ত ভানু বাগও আগে বোমা বানাতো। আমি চাই দোষীদের শাস্তি হোক।''
ছবি: Satyajit Shaw/DW
একই কথা প্রাণকৃষ্ণের
গ্রামবাসী প্রাণকৃষ্ণ মাইতি ডিডাব্লিউকে বলেছেন, বিশাল আওয়াজ হয়। আমরা তো প্রথমে ঢুকতে পারিনি। পরে দেখি, পুকুরে দেহ ভাসছে। তার দাবি, এখানে আগেও তিনবার আগুন লেগেছে। মানুষ মারা গেছে। কারখানায় বোমা বানানো হতো।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
চৈতন্য ভুইঞাঁর অভিযোগ
গ্রামবাসী চৈতন্য ভুইঞাঁ ডিডাব্লিউকে বলেছেন, পুকুরে দেহ পড়ে। এক দেড় ঘণ্টা পরে পুলিশ আসে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বেলারানি যা বললেন
গ্রামের বাসিন্দা বেলারানি মাইতি ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, আমাদের বাড়ির কাচ ভেঙেছে। প্রচণ্ড শব্দের পর শুধু কালো ধোঁয়া দেখতে পাই। আমরা বাড়ি ছেড়ে চলে আসি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
ভানু বাগ গ্রেপ্তার
বিস্ফোরণ-কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত ভানু বাগকে ওড়িশার কটক থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তার করা হয়েছে তার ভাইপো এবং ছেলেকেও। গত ৩০ বছর ধরে সে বাজি বানাতো। ২০১১-র পর থেকে তার সঙ্গে তৃণমূলের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয় বলে অভিযোগ।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
বাংলাদেশে যেত ভানুর বাজি
ভানু বাগ সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ভানু বাগকে কালীপুজোর সময় গ্রেপ্তার করা হয়। কিন্তু সে জামিন পেয়ে যায়। ওড়িশা সীমানার কাছে সে বেআইনিভাবে বাজি কারখানা চালাত। মমতা বলেছেন, আমি শুনেছি, ও বাংলাদেশে এবং ওড়িশাতে বাজি সরবরাহ করতো। উপরের ছবিতে ভানু বাগের বাড়ি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
রাজনীতি চলছে
বিস্ফোরণের পরেই রাজনৈতিক নেতারা আসছেন এই গ্রামে। বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী বুধবার এগরায় যান। তিনি অভিযোগ করেছেন, ভানু তৃণমূলের বড় নেতা। ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত সদস্য ছিল। ২০১৮ সালে বৌমাকে সদস্য করে সে। শুভেন্দু এনআইএ তদন্ত দাবি করেন। বৃহস্পতিবার খাদিকুল যেতে পারেন দিলীপ ঘোষ, সুকান্ত মজুমদারেরা। উপরের ছবিতে এগরা হাসপাতাল। আহতদের নিয়ে আসা হয়েছে এখানে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
তৃণমূলের নেতারা
বিজেপি-র পরেই তৃণমূলের নেতারা গ্রামে যান। মন্ত্রী মানস ভুইঞাঁ, বিপ্লব রায়চৌধুরী, বিধায়ক তরুণ মাইতি, দোলা সেন, সৌমেন মহাপাত্ররা যেতেই তাদের ঘিরে বিক্ষোভ দেখানো হয়। মানস জানান, দোষীদের শাস্তি দেয়া হবে। ক্ষতিপূরণও দেয়া হবে। উপরের ছবিতে দেখা যাচ্ছে, বিস্ফোরণের পর গ্রামের বাড়ির কাচ ভেঙে গেছে।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
কেমন করে চলে বেআইনি কারখানা?
মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, কারখানাটি বেআইনি ছিল। স্থানীয় মানুষের প্রশ্ন, তাহলে কী করে এই কারখানা চলতো? কোনো লাইসেন্স ছিল না। তারা বাজি না বোমা বানাচ্ছে, সেটা দেখার জন্যও কোনো নজরদারি ছিল না। উপরে থানার ছবি।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
আরো আছে
স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, এরকম বাজি কারখানা ওই এলাকায় আরো আছে। বাজির চাহিদা আছে। এখন প্রায় সব উৎসবেই বাজি ফাটে। গ্রামের ভিতরে প্রায় কোনো কারখানাতেই লাইসেন্স নেই। এগরার বিস্ফোরণের পর কি এইসব কারখানা বন্ধ হবে? উপরের ছবিতে খাদিকুল গ্রাম।
ছবি: Satyajit Shaw/DW
13 ছবি1 | 13
প্রার্থী ও পরিবারের মানুষকে মার
বীরভূমে সিপিএমের এক নারী প্রার্থী ও তার পরিবারকে মারা হলো। অভিযোগ তৃণমূলের কর্মীরা এই কাজ করেছে। ওই প্রার্থী আসিয়া বিবি ও তার স্বামী এবং অন্যদের বলা হয়, মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করতে হবে। তারা তাতে রাজি না হলে শুরু হয় বেধড়ক মার। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।
মুর্শিদাবাদের ঘটনা
মুর্শিদাবাদের রানিনগরে একইরকমভাবে ভয় দেখিয়ে বিজেপি, কংগ্রেস, সিপিএম প্রার্থীদের মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করানোর চেষ্টা হয়েছে। প্রার্থীদের মারা হয়েছে।
রানিনগরের অবস্থা এমনই যে, তিন বিরোধী দলের প্রার্থীরা একসঙ্গে গাড়ি করে মনোনয়নপত্র জমা দিতে গেছেন।
আদালতে আইএসএফ, সিপিএম
ভাঙড়ের সহিংসতা নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ আইএসএফ ও সিপিএম। এই দুই দলের পঞ্চায়েতে জোট হয়েছে। যেভাবে ভাঙড়ে মঙ্গল ও বুধবার ব্যাপক হাঙ্গামা হয়েছে, বিরোধীদের মনোন.নপত্র পেশ করতে দেয়া হয়নি, তানিয়েই হাইকোর্টের কাছে আবেদন জানিয়েছে দুই বিরোধী দল।