চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বৈঠকের ফলে দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সম্ভাবনা যথেষ্ট বেড়েছে৷ কিন্তু যে তিনটি ইস্যু ভারতের দুশ্চিন্তার মূল কারণ, তার কোনো আশু সমাধানসূত্র উঠে আসেনি৷
বিজ্ঞাপন
চীনের মনোভাব বোঝা ঈশ্বরেরও অসাধ্য৷ ভারত সফররত চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর মন রক্ষায় মোদী সরকার কোনো খামতি রাখেনি৷ তা সত্ত্বেও এই সফরে যে তিনটি ইস্যু দীর্ঘদিন ভারতের গলার কাঁটা হয়ে আছে, তার সমাধানসূত্র পাওয়া গেল না৷ উল্টে গুজরাটের আমেদাবাদে এবং দিল্লিতে মোদী-শি জিনপিং-এর মধ্যে যখন গুরুত্বপূর্ণ কূটনৈতিক বৈঠক চলছে, ঠিক সেই সময়ে লাদাখে অনুপ্রবেশ ঘটেছে চীনা সেনার৷
নতুন দিল্লিতে চীনা প্রেসিডেন্টের সঙ্গে এক বৈঠকে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী মোদী৷ চীনা মানসিকতায় এই দ্বিচারিতার স্বাদ অবশ্য ভারত আগেও পেয়েছে৷ প্রথম, প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই' জমানায়৷ তাই লাদাখে চীনা সেনার অনুপ্রবেশ এই বার্তাই দিল যে, সীমান্ত বিরোধ দু'দেশের মধ্যে এখনও একটি অসমাপ্ত অ্যাজেন্ডা৷ এটা সহজে মেটার নয়৷ মেটাতে হলে চীনের দেয়া সমাধানে রাজি হতে হবে ভারতকে৷ কারণ চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধের সমাধান করতে পারে একমাত্র চীনই৷ তাছাড়া ভারত তার কূটনৈতিক কৌশলে চীনের ওপর যত বেশি চাপ বাড়াবে, চীনের অবস্থান হবে ততই কড়া৷
নতুন দিল্লি যদি মনে করে যে তারা জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ভিয়েতনামকে সঙ্গে নিয়ে কাজ হাসিল করবে, তাহলে ভুল করবে – এমনটাই মনে করছেন দিল্লির কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা৷ চীনের বিদেশ নীতির মূল কথা হলে, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ তথা সার্বিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা চলুক তার নিজের পথে৷
উল্লেখ্য, চীন-জাপানের দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণ ছুঁয়েছে ৩০ হাজার কোটি মার্কিন ডলার৷ কিন্তু দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যু নিয়ে জাপানকে ল্যাজে খেলাচ্ছে চীন৷ ব্যবসা-বাণিজ্য রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির রক্ষাকবচ হতে পারে না৷ ভারতকেও তাই মনে করিয়ে দিয়েছে ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে বিতর্কিত রাজনৈতিক ইস্যুগুলি গুলিয়ে ফেললে চলবে না, যার মধ্যে আছে সীমান্ত বিরোধ ছাড়াও অরুণাচল প্রদেশ ও ভারত-নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারতীয় নাগরিকদের জন্য স্টেপল ভিসা এবং পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে চীনের স্থাপনা৷
একজন নরেন্দ্র মোদী
উগ্র সাম্প্রদায়িক আদর্শ এবং বিভাজনের রাজনীতির কারণে ভারতের বহু মানুষের কাছে তিনি খলনায়ক৷ ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নিজেকে নতুন মোড়কে সামনে এনে সেই নরেন্দ্র মোদীই শোনাচ্ছেন ভারতকে বদলে দেয়ার মন্ত্র৷
ছবি: dapd
চা ওয়ালা
১৯৫০ সালে গুজরাটের নিম্নবিত্ত এক ঘাঞ্চি পরিবারে জন্ম নেয়া নরেন্দ্র মোদী কৈশরে বাবাকে সাহায্য করতে রেল ক্যান্টিনে চা বিক্রি করেছেন৷ ঘাঞ্চি সম্প্রদায়ের রীতি অনুযায়ী ১৭ বছর বয়সে যশোদাবেন নামের এক বালিকার সঙ্গে তাঁর বিয়ে হয়, যদিও বেশিদিন সংসার করা হয়নি৷ ছাত্র হিসেবে সাদামাটা হলেও মোদী বিতর্কে ছিলেন ওস্তাদ৷ ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএস-এর প্রচারক হিসাবে রাজনীতির দরজায় পা রাখেন মোদী৷
ছবি: UNI
গুজরাটের গদিধারী
১৯৮৫ সালে আরএসএস থেকে বিজেপিতে যোগ দেয়ার ১০ বছরের মাথায় দলের ন্যাশনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পান ১৯৯৫ সালে গুজরাটের নির্বাচনে চমক দেখানো মোদী৷ ১৯৯৮ সালে নেন দলের জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব৷ ২০০১ সালে কেশুভাই প্যাটেলের স্বাস্থ্যের অবনতি হলে দলের মনোনয়নে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে আবির্ভূত হন নরেন্দ্র মোদী, যে দায়িত্ব তিনি এখনো পালন করে চলেছেন৷
ছবি: Reuters
দাঙ্গার কালিমা
মোদীকে নিয়ে আলোচনায় ২০০২ সালের দাঙ্গার প্রসঙ্গ আসে অবধারিতভাবে৷ স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে ভয়াবহ সেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গুজরাটে প্রায় ১২০০ মানুষ নিহত হন৷ মোদীর বিরুদ্ধে অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়েও তিনি দাঙ্গায় উসকানি দেন৷ তিনি এ অভিযোগ স্বীকার করেননি, আদালতও তাঁকে রেহাই দিয়েছে৷ তবে দাঙ্গার পক্ষে কার্যত সাফাই গেয়ে, হিন্দুত্ববাদের গান শুনিয়েই তিন দফা নির্বাচনে জয় পান মোদী৷
ছবি: AP
রূপান্তর
দাঙ্গার পর নিজের ভাবমূর্তি ফেরানোর উদ্যোগ নেন নরেন্দ্র মোদী৷ একজন বিতর্কিত নেতার বদলে উন্নয়নের কাণ্ডারি হিসাবে তাঁকে প্রতিষ্ঠা দিতে শুরু হয় ‘গুজরাট মডেল’-এর প্রচার৷ ২০০৭ সালের পর নিজেকে একজন সর্বভারতীয় নেতা হিসাবে তুলে ধরতে নতুন প্রচার শুরু করেন এই বিজেপি নেতা, প্রতিষ্ঠা করেন ‘ব্র্যান্ড মোদী’৷গুজরাটের উন্নয়নের চিত্র দেখিয়ে কলঙ্কিত ভাবমূর্তিকে তিনি পরিণত করেন ভারতের ত্রাতার চেহারায়৷
ছবি: UNI
ভারতের পথে পথে
ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌঁড়ে নরেন্দ্র মোদী পাড়ি দিয়েছেন তিন লাখ কিলোমিটার পথ৷ সারা ভারতে পাঁচ হাজার ৮২৭টি জনসভায় তিনি অংশ নিয়েছেন, নয় মাসে মুখোমুখি হয়েছেন পাঁচ কোটি মানুষের৷ কট্টর হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে শুরু করলেও এবার তিনি হিন্দুত্ব নিয়ে প্রচার এড়িয়ে গেছেন সচেতনভাবে, যদিও বাংলাদেশের মানুষ, ভূখণ্ড এবং ধর্ম নিয়ে নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপি নেতাদের বক্তব্য নতুন সমালোচনার জন্ম দিয়েছে৷
ছবি: AP
নতুন ইতিহাস
ভারতীয় জনতা পার্টি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটই যে এবার ভারতে সরকারগঠন করতে যাচ্ছে, বুথফেরত জরিপ থেকে তা আগেই স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল৷ ৬৩ বছর বয়সি মোদীর নেতৃত্বে এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে তৃতীয়বারের মতো সরকার গঠন করতে যাচ্ছে হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি৷ ৭ই এপ্রিল থেকে ১২ই মে অনুষ্ঠিত ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ৮১ কোটি ৪০ লাখ৷ তাঁদের মধ্যে রেকর্ড ৬৬ দশমিক ৩৮ শতাংশ ভোট দিয়েছেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শেষ হাসি
নির্বাচনে বিজেপির প্রতিশ্রুতি ছিল – মোদী প্রধানমন্ত্রী হলে দেশের অর্থনীতি নতুন গতি পাবে, গুজরাটের আদলে তিনি ভারতকে বদলে দেবেন৷ অবশ্য সমালোচকরা বলছেন, ‘কলঙ্কিত ভাবমূর্তি’ ঢাকতে এসব মোদীর ফাঁপা বুলি৷ তাঁর স্বৈরাচারী মেজাজ, শিক্ষা ও অর্থনীতির জ্ঞান নিয়েও ঠাট্টা-বিদ্রুপ হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, ভোটাররা টানা তৃতীয়বার কংগ্রেসকে চায়নি বলেই বিজেপি জয় পেয়েছে৷ যদিও শেষ হাসি দেখা যাচ্ছে নরেন্দ্র মোদীর মুখেই৷
ছবি: dapd
7 ছবি1 | 7
এরপরও ভারত ও চীনের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে বৃহস্পতিবারের বৈঠকের পর স্বাক্ষরিত হয় ১২টি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি৷ তার মধ্যে আছে ভারতীয় রেলের আধুনিকীকরণ, রেল স্টেশনগুলির উন্নতিসাধন ও দ্রুতগতি সম্পন্ন ট্রেন চালানো, শিক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা, কৈলাশ মানস সরোবর তীর্থ যাত্রার নতুন রুট চালু করা, গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে চীনের শিল্প তালুক গড়ে তোলা ইত্যাদি৷
এছাড়া আগামী পাঁচ বছরে ভারতে ২০০০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে চীন৷ বৈঠক শেষে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সীমান্ত ইস্যুর শান্তিপূর্ণ সমাধান ভারতের কাম্য৷ দিল্লি চায় ৩৪৮৮ কিলোমিটার সীমান্তে শান্ত থাকলে দু'দেশের সুসম্পর্ক হবে মসৃণ৷ বর্তমানে ভারত-চীন দ্বিপাক্ষিক ব্যবসা-বাণিজ্যে চীনের দিকে পাল্লা ভারি৷ তাই একটা ভারসাম্য থাকা জরুরি৷ চীনের প্রেসিডেন্ট নাকি আশ্বাস দিয়েছেন, এটা দূর করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হবে শীঘ্রই৷