দেশের রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতারা৷ বরং তারা দমনের কথা বলেছেন৷ অন্যদিকে বিএনপি টানা অবরোধ এবং হরতালের মধ্যে অসহযোগ আন্দোলন শুরুর কথা বলছে৷
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশে বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী ২০ দলীয় জোটের টানা অবরোধের ৩৯ দিন ছিল শুক্রবার৷ আর গত দুই সপ্তাহ ধরে সরকারি ছুটির দিন শুক্র ও শনিবার বাদে মোট ১০ দিন টানা হরতাল পালন করেছে তারা৷ রবিবার থেকে তারা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আরো কঠোর কর্মসূচি দিতে পারে৷ শুক্রবার এক বিবৃতিতে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘‘অবৈধ, অনির্বাচিত, দখলবাজ আওয়ামী সরকার রাষ্ট্রশক্তির চূড়ান্ত অপব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামের এই জনপদকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে৷ অবৈধ সরকারের এহেন শ্বেতসন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে জনগণ অচিরেই আইন অমান্য ও অসহযোগ আন্দোলন শুরু করতে বাধ্য হবে৷'' বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘‘ইদানীং আওয়ামী নেতা-মন্ত্রীরা প্রকাশ্য জনসমাবেশে আন্দোলনকারীদের এনকাউন্টার এবং ক্রসফায়ারে হত্যা করার ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছেন৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বড় কর্তারাও প্রকাশ্যে সভা-সমিতি করে ক্রসফায়ারে হত্যার কৃতিত্ব দাবি করে বেড়াচ্ছেন৷ এ সমস্ত বিকৃত মস্তিষ্কের নেতা-মন্ত্রী ও পুলিশ কর্মকর্তাদের ভবিষ্যৎ পরিণতি গণকারফিউ এবং গণপিটুনিতে নির্ধারিত হওয়ার সমূহ সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যায় না৷ এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রকাশ্য দাম্ভিক ঘোষণা আগামীতে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে বিচারের আওতায় আনা হবে৷'' শনিবার ২০ দলীয় জোট সারাদেশে বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাছান মাহমুদ শুক্রবার বলেছেন, ‘‘জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের সাথে সরকারের কোন আলোচনা হবেনা, তাদের দমন করা হবে৷'' তিনি ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, ‘‘বিদেশিদের কাছে ধরনা দিয়ে লাভ হবে না৷ সরকার কোনো ভাবেই সন্ত্রাসীদের সাথে আলোচনায় বসবে না৷ জাতিসংঘ এসে সমঝোতা করুক, বিএনপির এমন প্রত্যাশাও পূরণ হবে না৷'' রবিবার থেকে ২০ দলীয় জোটের হরতালসহ কঠোর কর্মসূচির হুমকির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘টানা অবরোধ-হরতালের নামে মানুষ পোড়ানোর পর আরও কী কঠোর কর্মসূচি দেবেন সেটা মানুষ বুঝতে পেরেছে৷ বিএনপি-জামায়াত আরও বেশি করে মানুষ পোড়ানোর কর্মসূচি দিতে চান৷'' হাছান মাহমুদ বলেন, ‘‘বাস, ট্রেন, লঞ্চে আগুন দেয়া হচ্ছে ২০ দলীয় জোটের জঙ্গি আন্দোলন৷ দেশের মানুষ ইতোমধ্যেই খালেদা জিয়াকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিয়েছে৷'' আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, ‘‘কার সঙ্গে সংলাপ হবে? আমাদের এখন সমস্যা হল পেট্রোল দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে হত্যা করা৷ সেটা দূর করতে হবে৷ বিএনপি বলছে তারা পেট্রোলবোমা মারছে না৷ তাহলে তো তাদের সঙ্গে সংলাপ করে লাভ নেই৷ তারা যদি মানুষ হত্যার দায় স্বীকার করতো, তাহলে তাদের সঙ্গে সংলাপ করলে সমাধান করা যেত৷ যেহেতু দায় স্বীকার করছে না, তাই তাদের সঙ্গে সংলাপ করে মানুষ পোড়ানো বন্ধ করা সম্ভব নয়৷ এই সন্ত্রাসীদেরকে আইনি ব্যবস্থা দিয়ে দমন করতে হবে৷ সেটাই করছে সরকার৷'' খাবার সরবরাহে বাধা দেয়ার অভিযোগ বিএনপির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানরত তাঁর কর্মকর্তা ও নিরাপত্তারক্ষীদের জন্য শুক্রবার দুপুরের খাবার নিতে পুলিশ বাধা দিয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে৷ বিএনপির চেয়ারপার্সনের প্রেস উইংয়ের সদস্য শামসুদ্দিন দিদার অভিযোগ করেন, শুক্রবার দুপুরে একটি ভ্যানে করে বাইরে থেকে দুপুরের খাবার আনা হয়৷ কিন্তু একজন পুলিশ কর্মকর্তা খাবারসহ ভ্যানটিকে ভেতরে ঢুকতে না দিয়ে ফেরত পাঠিয়ে দেন৷ তবে গুলশান থানা পুলিশ এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷ বিএনপির চেয়ারপার্সনের প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, ‘‘বুধবার থেকেই গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানরত খালেদা জিয়ার কর্মকর্তা ও নিরাপত্তারক্ষীদের খাবার আনতে বাধা দেয়া হচ্ছে৷'' তবে খালেদা জিয়ার জন্য বাইরে থেকে খাবার আনায় কোন বাধা নেই৷
অবরোধ-হরতালে বিপর্যস্ত জনজীবন
বাংলাদেশে টানা অবরোধ ও হরতালের ফলে সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে এসেছে চরম দুর্দশা৷ ক্রেতার অভাবে বেচাকেনা প্রায় শূন্যের কোঠায় গিয়ে ঠেকেছে৷ শুধু অর্থনীতি নয়, চলমান রাজনৈতিক সহিংসতায় মুষড়ে পড়েছে পরিবহন ও শিক্ষা ব্যবস্থাও৷
ছবি: DW/M. Mamun
দাউ দাউ করে জ্বলছে আগুন
পুরনো ঢাকার বাবু বাজারে কাগজ বোঝাই একটি ট্রাকে জ্বলছে দুষ্কৃতিকারীদের দেয়া পেট্রোল বোমার আগুন৷ গত এক মাসেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে চলছে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের ডাকা অবরোধ৷ ডাকা হচ্ছে হরতালও৷ অবরোধ-হরতালে সবচেয়ে আলোচিত পেট্রোল বোমা৷ শুধু পেট্রোল বোমার আগুনেই পুড়ে মরেছে কমপক্ষে ৬৫ জন সাধারণ মানুষ৷
ছবি: DW/M. Mamun
পুলিশ প্রহরায় চলছে পরীক্ষা
ঢাকার মতিঝিল আইডিয়িাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে পুলিশ প্রহরা৷ চলমান এ অবরোধ-হরতালে যাঁরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তার মধ্যে শিক্ষার্থীরা অন্যতম৷ বর্তমানে সারা দেশে চলা এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন তাই অনেকটাই অনিশ্চয়তার মুখে৷ টানা অবরোধের মধ্যে ছুটির দিনগুলোতে চলছে পরীক্ষা৷ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরাও৷
ছবি: DW/M. Mamun
দূরপাল্লার বাস নেই বললেই চলে
বিএনপি ও সমমনা রাজনৈতিক দলগুলির ডাকা অবরোধে বাংলাদেশের প্রধান সড়ক ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চিত্ত৷ দুপুর বেলায় তোলা এ ছবিতে মহাসড়কটি প্রায় যানবাহন শূন্য৷ কিন্তু সাধারণ সময়ে এ সড়কটি থাকে যানবাহনে ভরা৷ বাংলাদেশে চলমান অবরোধে দূর পাল্লার গাড়ি চলাচল কমে গেছে বহুলাংশে৷ একের পর এক পেট্রোল বোমার ঘটনায় ঝুঁকি নিয়ে বাস চালাচ্ছেন না অনেক মালিকই৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিজিবি-র টহল পর্যাপ্ত নয়
অবরোধের মধ্যে বাংলাদেশের মহাসড়কগুলোয়, মানে ঢাকার বাইরে বিজিবি-র টহল থাকলেও, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য৷ এছাড়া সম্প্রতি রাত ন’টার পরে বাস চলাচলে সকলকে নিরুৎসাহ করার কারণে বাস মালিকদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঢাকায় অস্বাভাবিক নয় যানজট
বাংলাদেশে চলমান এই অবরোধে ঢাকার ভেতরের সড়কের দৃশ্য অবশ্য আলাদা৷ যান চলাচল অন্যান্য সময়ের চেয়ে তুলনামূলক কম হলেও, অনেক জায়গাতেই যানজট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
চরম দুর্ভোগে পড়েছেন অফিসযাত্রীরা
ঢাকার ফার্মগেটে অফিস শেষে গাড়ির অপেক্ষায় বাড়িমুখী মানুষের ভিড়৷ টানা অবরোধে গণ পরিবহন ব্যবস্থা বেহাল হলেও, অর্থাৎ গাড়িঘোড়ার চলাচল কম থাকাতে দুর্ভোগ বেড়েছে অফিসমুখী ও অফিস ফেরত মানুষের৷ অফিসে যেতে বা অফিস থেকে বাড়ি ফিরতে সাধারণ মানুষ তাই পড়ছেন দুর্ভোগে৷
ছবি: DW/M. Mamun
অবরোধে নদীপথের ভিন্ন চিত্র
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নদীবন্দর ঢাকার সদরঘাটের চিত্র এটি৷ গত একমাসেরও বেশি সময়ের এই অবরোধে দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া উল্লেখযোগ্য বড় কোনো সহিংসতা ঘটেনি নদীপথে৷ তাই নদীপথে যান চলাচল প্রায় স্বাভাবিকই আছে৷ ঢাকা থেকে প্রধানত দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোয় নৌ-যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
যাচ্ছে না দূরপাল্লার বাসগুলো
বিএনপি ও সমমনা দলের জোটসমূহের ডাকা হরতাল-অবরোধে ঢাকার অন্যতম প্রধান বাস স্টেশন গাবতলীর দৃশ্য এটি৷ বেশিরভাগ দূর পাল্লার রুটের বাসই এ স্টেশনে পার্ক করে রাখা৷ হরতাল-অবরোধে দূর পাল্লার বাস চলাচল অনেকাংশেই বন্ধ আছে বাংলাদেশে৷
ছবি: DW/M. Mamun
খদ্দেরহীন এক রেস্তোরাঁ
ঢাকার গাবতলী বাস স্টেশনের খদ্দেরশূন্য মোহাম্মাদীয়া রেস্তোরাঁ৷ অবরোধের কারণে এ রেস্তোরাঁর লোকবল ১৬ জন থেকে ৮ জনে নামিয়ে আনা হয়েছে৷ বাকি যে আটজন আছেন তাঁদেরও নিয়মিত বেতন পরিশোধ করতে পারছেন না মালিক৷ গাবতলী স্টেশন থেকে দূর পাল্লার বাস চলাচল কম থাকায় এ রেস্তোরাঁটি দিনের বেশিরভাগ সময় খালি থাকছে৷
ছবি: DW/M. Mamun
বাড়ি ফেরা নিয়ে উদ্বিগ্ন মানুষ
অবরোধ আর হরতালকারীদের প্রধান লক্ষ্য সড়কে চলাচলকারী বাস আর ট্রাক৷ বাংলাদেশে এ পর্যন্ত যতগুলো হামলার ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগেই যাত্রীবাহী বাস কিংবা ট্রাকে৷ এতে কমপক্ষে ৬০ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটলেও, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ইউনিটে পোড়ায় ক্ষত শরীর নিয়ে কাতরাচ্ছেন আরো শতাধিক সাধারণ মানুষ৷
ছবি: DW/M. Mamun
কমলাপুর রেল স্টেশনে অপেক্ষায় যাত্রীরা
অবরোধে ঢাকা থেকে দেশের বিভিন্ন রুটে ট্রেন চলাচল করলেও, সময়সূচি ঠিক রাখতে পারছে না রেল কর্তৃপক্ষ৷ বিভিন্ন সময়ে অবরোধকারীদের রেল লাইনের ‘ফিশপ্লেট’ খুলে ফেলার কারণে কয়েকটি ট্রেনের লাইনচ্যুতির ঘটনায় ট্রেনের গতি কমিয়ে চালাতে হচ্ছে৷ তাই বেশিরভাগ ট্রেনই স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কমপক্ষে তিন-চার ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়ে যাচ্ছে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন৷
ছবি: DW/M. Mamun
খেটে খাওয়া মানুষের দুর্দশা
টানা অবরোধ-হরতালে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন ফুটপাথের ভ্রাম্যমাণ দোকানদাররা৷ স্বল্প পুঁজির এ সব ব্যবসায়ীদের বিক্রি কমে যাওয়ায় পথে বসার উপক্রম হয়েছে অনেকেরই৷
ছবি: DW/M. Mamun
পুঁজি ভেঙে চলছে যাঁর সংসার
ঢাকার বায়তুল মোকাররম মসজিদ এলাকার ফুটপাথে কম্বলের ব্যবসা করেন গাজীরুল ইসলাম৷ দুপুরবেলা পর্যন্ত এ দিন তাঁর বিক্রি হয়েছে মাত্র ১৭’শ টাকার একটি কম্বল৷ তাও তার কেনা দামের থেকে ৩০০ টাকা কম৷ লাভ তো দূরের কথা সংসার চালাতে এখন পুঁজি টুকুনিই ভরসা৷
ছবি: DW/M. Mamun
অগ্নি নির্বাপক যন্ত্রই যখন ভরসা
ঢাকার নবাবপুর থেকে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র নিয়ে ফিরছেন এক গাড়ি চালক ও তাঁর সহকারী৷ টানা অবরোধ-হরতালে পেট্রোল বোমার ঘটনা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ায় সতর্কতা হিসেবে নিজেদের গাড়িতে এখন থেকে অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র রাখবেন তাঁরা৷