ব্যক্তি স্বাধীনতার সংজ্ঞা অনেক৷ ঠিক যেমন অনুশাসনের৷ একে অপরের মতকে শ্রদ্ধা জানালেই সমস্যা থাকে না৷
বিজ্ঞাপন
দুই বন্ধুর কথা খুব মনে পড়ছে৷ দুইজনেই কলেজের৷ একজনের নাম পূজা অন্যজন আফরোজা খাতুন৷ গোঁড়া হিন্দু পরিবারের মেয়ে পূজা আসলামকে বিয়ে করে এখন দুবাই নিবাসী৷ ধর্ম পরিবর্তন হয়েছে৷ বদলেছে নামও৷ ছেলের নাম আমন৷ নাসিমা খিদিরপুরে থাকে এখনো৷ বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন ওর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল, ততদিনে বিয়ে হয়ে এক সন্তানের মা৷
সম্প্রতি ফেসবুকে পূজা বোরখা পরা ছবি পোস্ট করেছে৷ পুরনো বন্ধুর প্রশ্নের উত্তরে একলাইনের উত্তর-- ‘কেউ চাপিয়ে দেয়নি, নিজের ইচ্ছায় পরেছি৷ ঠিক যেমন মা শাঁখা-সিঁদুর পরতেন৷' বটেই তো! শাঁখা-সিঁদুর, লোহা-পলা পরার জন্য হিন্দু নারীকে গোঁড়া হতে হয় না৷ বছরের পর বছর ধরে এ রেওয়াজ চলে আসছে৷ বহু নারী সেই রেওয়াজ ভেঙেছেন৷ প্রতিবাদও করেছেন৷ আবার মনেপ্রাণে প্রগতিশীল হয়েও অনেকে পরিবারের কথা ভেবে রেওয়াজ মেনে নিয়েছেন৷ পূজার সঙ্গে আড্ডায় সেই কথাগুলিই বার বার উঠে আসছিল৷ পূজা বলছিল, দুবাইয়ে কোনো কোনো অনুষ্ঠানে ডিজাইনার বোরখা পরে যেতে ওর ভালো লাগে৷
আফরোজার সঙ্গে প্রথম আলাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে৷ জিন্স-টপ পরিহিতা আফরোজা ক্যান্টিনের বেঞ্চে উঠে ডাফলি বাজিয়ে স্লোগান দিচ্ছিলেন৷ আপাদমস্তক বামপন্থি আফরোজার সঙ্গে প্রথম আলাপেই বন্ধুত্ব৷ এহেন বিশ্ববিদ্যালয়ের নেত্রীর সঙ্গে একদিন তার বাড়ি যাওয়া সাব্যস্ত হলো৷ খিদিরপুরের কার্ল মার্কস সরণিতে বাস পৌঁছানোর পর আফরোজা বলল, পরের স্টপেই নামতে হবে৷ যদিও আমরা জানি, তার বাড়ি তখনো বেশ কয়েক স্টপ দূরে৷ বাস থেকে নেমে আমাদের দাঁড় করিয়ে, পাঁচ মিনিটের জন্য উধাও হলো আফরোজা৷ ফিরে এলো এক অন্য মানুষ৷ মাথা থেকে পা পর্যন্ত বোরখায় ঢাকা৷ বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা আফরোজা পরিবারের নির্দেশ তখনো ভাঙতে পারেননি৷
দক্ষিণ ভারতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া হিজাব-কাণ্ড নিয়ে আফরোজার মতামত ভিন্নধর্মী৷ সে মনে করে, ইউনিফর্মে ধর্মের রং থাকা অনুচিত৷ যে কোনো ধর্মীয় পোশাক অথবা চিহ্ন যদি ব্যক্তি স্বাধীনতার পরিপন্থি হয়, তাহলে বর্জনের পক্ষে আফরোজা৷ পূজা নয়৷
হিজাব-কাণ্ডে পূজার বক্তব্য, ধর্মীয় পোশাক পরে কলেজে যাওয়া ব্যক্তি স্বাধীনতা৷ রাষ্ট্র বা সমাজ সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারে না৷
ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা একেকজনের কাছে একেকরকম৷ বিভিন্ন সমাজ এবং রাষ্ট্রের কাছেও ভিন্ন৷ সকলেই নিজের নিজের মতো করে তার সংজ্ঞা তৈরি করে৷ কালে কালে এমনটাই হয়ে এসেছে এবং ভবিষ্যতেও নিশ্চয় তা-ই হবে৷ সমস্যা অসহিষ্ণুতায়৷ দুঃখজনক সত্যি হলো সেইটেই এখন বাস্তব৷
গত কয়েকবছরে একের পর এক অসহিষ্ণুতার ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটেই চলেছে বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের এই ভারতবর্ষে৷ পোশাক নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, খাবার নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, ভাষা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, সাজসজ্জা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে৷ কেউ কারও কথা শুনতে নারাজ৷ সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ, সমাজ পরিচালিত রাজনীতি গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো একমুখী আচরণ করছে৷ আর সেজন্যই প্রতিদিন নতুন নতুন বিতর্ক মুখ তুলছে-- কখনো হিজাবে, কখনো দাড়িতে, কখনো বা গেরুয়া কাপড়ে৷
পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৫৬টি দেশের নারীরা তাদের পোশাক খুব বেশি ধর্মীয় অথবা খুব বেশি ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ায় সামাজিক হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ জার্মানি, ভারতসহ পাঁচ দেশের নারীদের দুই অভিজ্ঞতাই হয়েছে৷
ছবি: Karim Sahib/AFP
পোশাকের কারণে হয়রানি
যুক্তরাষ্ট্রের থিংক ট্যাংক পিউ রিসার্চ সেন্টার বলছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৫৬টি দেশের নারীরা তাদের পোশাক খুব বেশি ধর্মীয় অথবা খুব বেশি ধর্মনিরপেক্ষ হওয়ায় সামাজিক হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ মৌখিক কটূক্তি থেকে শুরু করে শারীরিক আঘাত, এমনকি হত্যা এমন হয়রানির মধ্যে পড়ে৷ প্রতিবেদনটি পড়তে উপরে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: picture-alliance/PYMCA/Liat Chen
হিজাব পরায় হয়রানি, না পরায়ও হয়রানি
৫৬টি দেশের মধ্যে ৪২টি দেশে নারীরা ধর্মনিরপেক্ষ পোশাক রীতি লঙ্ঘন করায়, অর্থাৎ হিজাব বা অন্যান্য ধর্মীয় পোশাক পরায় হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ আর ১৯টি দেশের নারীরা ধর্মীয় পোশাক রীতি না মানায়, অর্থাৎ হিজাব না পরায় কিংবা ধর্মীয় রীতির সঙ্গে মেলে না এমন পোশাক পরায় হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ জার্মানি, ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ইসরায়েল ও রাশিয়ায় নারীদের দুই অভিজ্ঞতাই হয়েছে৷
ছবি: DW
সবচেয়ে বেশি ইউরোপে
৫৬টি দেশের মধ্যে ইউরোপের দেশ ২২টি৷ এর মধ্যে ২০টি দেশে নারীরা হিজাব বা অন্য ধর্মীয় পোশাক পরায় হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ আর দুটি দেশে হিজাব না পরায় নারীদের হয়রানি হতে হয়েছে৷ ২০১৮ সালে ডেনমার্কে এক চালক হিজাব পরা এক মুসলিম নারীকে গাড়ি পার্কিংয়ের জায়গা ছেড়ে দিতে অস্বীকার করেন৷ জার্মানিতে এক নারী একজন মুসলিম নারীকে মেরে তার হেডস্কার্ফ খুলে ফেলার চেষ্টা করেন৷
ছবি: Imago/R. Peters
এশিয়া-প্যাসিফিক
এই অঞ্চলের ১৬ দেশে নারীরা হয়রানিতে পড়েছেন৷ ২০১৮ সালে হেডস্কার্ফ না পরায় এক নারীকে হামলা করায় মালয়েশিয়ায় এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল৷ ২০১৬ সালের কিরঘিস্তানে বিলবোর্ডে বিভিন্ন রকম ইসলামি পোশাক পরিহিত নারীর ছবি বিতর্ক তৈরি করেছিল৷
ছবি: Chong Voon Chung/Xinhua/picture alliance
সাব-সাহারা আফ্রিকা
এই অঞ্চলের সাত দেশের নারীরা পোশাকের কারণে হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ ২০১৮ সালে কেনিয়ার কিছু অংশে নারী শিক্ষকদের হিজাব পরার নিয়ম করা হয়েছিল৷ আর লাইবেরিয়ায় হেডস্কার্ফ পরায় মুসলিম নারীরা কর্মক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Dai Kurokawa
অ্যামেরিকা
ছয়টি দেশে নারীদের হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়েছে৷ ২০১৮ সালে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে এক হিন্দু স্কুলে এক মুসলিম নারীকে হিজাব না খুললে স্কুল থেকে চলে যেতে বলা হয়েছিল৷ ২০১৬ সালে ক্যানাডায় এক নারী এক হিজাব পরিহিতার দিকে থুতু ছুড়ে তার হিজাব ও চুল ধরে টান দিয়েছিলেন৷
ছবি: imago images/tagesspiegel/K. Heinrich
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা
পাঁচ অঞ্চলের মধ্যে একমাত্র এই অঞ্চলের দেশগুলোতে নারীরা হিজাব বা ধর্মীয় পোশাক পরার চেয়ে না পরায় বেশি হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ ২০১৬ সালে কাতারে এক মুসলিম নারী হিজাব না পরে খবর উপস্থাপনা করায় সমালোচিত হয়েছিলেন৷ ২০১৮ সালে ইসরায়েলের একদল অর্থডক্স ইহুদিকে তাদের দৃষ্টিতে ‘অভদ্র’ পোশাক পরায় এক তরুণীর দিকে চিৎকার ও তাকে ধাওয়া করতে দেখা গিয়েছিল৷
ছবি: Karim Sahib/AFP
যেভাবে তথ্য সংগ্রহ করেছে পিউ রিসার্চ
ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতির উপর সরকার ও সমাজের বিধিনিষেধ নিয়ে প্রতিবছর রিপোর্ট করে পিউ রিসার্চ৷ এ লক্ষ্যে প্রথমে কয়েকটি প্রশ্ন ঠিক করা হয়৷ তারপর মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন সংস্থার প্রকাশিত ১৯টি রিপোর্টে থাকা প্রতিটি দেশের তথ্যের মধ্যে ঐ প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা হয়৷ এভাবে ‘সরকারি বিধিনিষেধ সূচক’ ও ‘সামাজিক হয়রানি সূচক’ প্রকাশ করা হয়৷ ছবিঘরের তথ্যগুলো ২০২০ সালে প্রকাশিত হয়েছে৷