দুর্গা প্রতিমার পায়ের কাছে থাকা অসুর ডাক্তারের সাজে৷ সেই নিয়ে ক্ষোভ৷ মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে সরাতে হলো প্রতীকী প্রতিবাদ৷ তবে প্রশ্নটা তারপরও থাকছে যে, ডাক্তারদের অসুর রূপে দেখানোর পেছনে কি তাঁদের কোনো দায়ই নেই?
বিজ্ঞাপন
মধ্য কলকাতায়, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে একটু এগোলেই মোহাম্মদ আলী পার্ক৷ স্থানীয় ব্যবসায়ীদের উদ্যোগে এখানকার বারোয়ারি দুর্গাপুজো বহু বছরের পুরনো৷ এখনকার পুজোয় প্রথাগত ধারার বাইরে গিয়ে অন্য আঙ্গিক এবং শিল্পশৈলীর দুর্গাপ্রতিমার যে চল হয়েছে, তার শুরু হয়েছিল ১৯৮০'র দশকে এই মোহাম্মদ আলী পার্কের পুজোতেই৷ এবং সেই প্রতিমার অলঙ্করণে একটা সামাজিক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা থাকে প্রতি বছরেই৷ তার মধ্যে চলতি সময়ের গণ-মানসিকতার একটা প্রতিফলন থাকে৷ কিন্তু এবার সেই নিয়ে তুমুল বিতর্ক, কারণ, মোহাম্মদ আলী পার্কে অসুরকে দেখানো হয়েছে ডাক্তারের সাজে৷
ডা. নির্মল হালদার
সম্প্রতি যেভাবে ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায়, বা গাফিলতিতে রোগীর মৃত্যু, চিকিৎসার নামে লাখ লাখ টাকার ব্যবসা, এমনকি ভুয়া ডিগ্রিধারী জাল ডাক্তার ধরা পড়ার ঘটনা সামনে আসছে একের পর এক, তারই প্রেক্ষিতে৷
কিন্তু রাজ্যের চিকিৎসক মহল তাতে অপমানিত বোধ করেন৷ বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন ডাক্তারেরা, সংবাদ মাধ্যমও এই নিয়ে সরব হয়৷ তখন মোহাম্মদ আলী পার্ক পুজো কমিটি ওই ডাক্তাররূপী অসুরের গলা থেকে একটি বোর্ড ঝোলায়, যাতে বলা হয়, অসৎ ডাক্তারদের উদ্দেশেই এই কটাক্ষ৷ যাঁরা সৎ এবং সমাজের সেবায় নিয়োজিত, তাঁদের আহত বা অসম্মানিত করার কোনও উদ্দেশ্য এর মধ্যে নেই৷ কিন্তু তাতেও ডাক্তারদের ক্ষোভ কমে না৷ বরং নানা মহল থেকে অভিযোগ যায় প্রশাসনের কাছে৷ তখন বাধ্য হয়েই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি হস্তক্ষেপ করেন৷ তাঁর নির্দেশে ওই ডাক্তাররূপী অসুরের পরনের সাদা অ্যাপ্রন খুলে নেওয়া হয়, সরিয়ে দেওয়া হয় গলায় ঝোলানো স্টেথোস্কোপ৷
ডা. উদল মুখার্জী
কিন্তু প্রশ্নটা উঠেই গেছে যে, আত্মসম্মানে আঘাত লাগলে ডাক্তাররা প্রতিবাদ করতে পারেন, কিন্তু যখন ডাক্তারদের অসাধুতা ধরা পড়ে, সে জাল ডাক্তারই হোক, বা ভুল চিকিৎসা, তখন কেন তাদের সরব হতে দেখা যায় না? বেসরকারি হাসপাতালে যখন চিকিৎসার বিল ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বাড়িয়ে রোগীর পরিবারকে বেকায়দায় ফেলা হয়, তখন কেন তাঁরা এগিয়ে আসেন না?
শহরের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা. নির্মল হালদার ডয়চে ভেলেকে জানালেন, বেসরকারি হাসপাতালে যে চিকিৎসার বিল তৈরি হয়, ডাক্তাররা তার ৮ থেকে ১০ শতাংশ পেয়ে থাকেন, নিজেদের পারিশ্রমিক বা পেশাগত ফি হিসেবে, তার বেশি কিছুতেই নয়৷ কাজেই চিকিৎসার নামে ব্যবসার এই ব্যবস্থাটায় ডাক্তাররা শরিক নন৷ তবু তাঁদেরকেই অসুর বানানো হয়, যেহেতু ক্ষুব্ধ রোগী পরিবারের মুখোমুখি তাঁদেরই হতে হয়৷
আর চিকিৎসায় গাফিলতি, বা ভুল চিকিৎসার অভিযোগের জবাবে ডা. হালদারের বক্তব্য, কীভাবে রোগী মারতে হয়, বা কীভাবে ভুল চিকিৎসা করে পরিস্থিতি জটিল করে তুলতে হয়, এই পাঠ কিন্তু মেডিকেল কলেজে তাঁদের পড়ানো হয় না৷
পশ্চিমবঙ্গের চিকিৎসা ব্যবস্থা
ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী জনতাকে চিকিৎসা পরিষেবা দেওয়ার ভার কেন্দ্রের নয়, রাজ্য সরকারের৷ পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চিকিৎসার সমান্তরালে বিকল্প ব্যয়বহুল পরিষেবা থাকলেও, সিংহভাগ মানুষ সরকারি পরিষেবার ওপরই নির্ভরশীল৷
ছবি: The Week/Gunjan Sharma
মাত্র দু’টাকায় চিকিৎসা
দারিদ্র্যসীমার নীচে বসবাসকারী মানুষরা চিকিৎসার জন্য মূলত সরকারি হাসপাতালের ওপরই নির্ভরশীল৷ হাসপাতালের বহির্বিভাগে মাত্র দু’টাকার বিনিময়ে চিকিৎসার পাশাপাশি কম খরচে পেসমেকার স্থাপন, অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি, আল্ট্রাসাউন্ড বা ইসিজির মতো পরিষেবাও পাওয়া যায়৷
ছবি: DW/P. Samanta
চেতনা বাড়াতে টিভি
প্রসূতির দেখাশোনা বা নবজাতকের প্রতিপালনের নিয়ম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে হাসপাতালের সরকারি হাসপাতালের ন্যাটাল ওয়ার্ডে এখন হাজির টিভি৷ তাতে মেগা সিরিয়ালের বদলে সচেতনামূলক অনুষ্ঠান দেখানো হয়!
ছবি: DW/P. Samanta
সর্বক্ষণের চিকিৎসক
রাতবিরেতে অসুখ-বিসুখে সরকারি হাসপাতালই ভরসা৷ এখানে আপৎকালীন পরিষেবা ছাড়াও ২৪x৭ চিকিৎসক পাওয়া যায়৷ সারা পশ্চিমবঙ্গেই বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় এই ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতাল অনেকটা এগিয়ে৷
ছবি: DW/P. Samanta
উন্নতমানের পরিষেবা
সম্প্রতি সরকারি হাসপাতালে সংকটাপন্ন রোগী ও শিশুদের বিশেষ পরিচর্যার জন্য এসএনসিইউ, সিসিইউ, এইচডিইউ চালু করা হয়েছে, যা এতদিন ছিল কেবল বেসরকারি হাসপাতাল বা নার্সিংহোমেই৷ উপকৃত হয়েছে দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার৷
ছবি: DW/P. Samanta
ন্যায্য মূল্যে ওষুধ
ব্র্যান্ডের থাবা থেকে ওষুধ মুক্তি পেতেই মানুষের মুখে হাসি ফুটেছে৷ চিকিৎসক জেনেরিক নামে ওষুধ লেখার ফলে ন্যায্য মূল্যের ওষুধের দোকানে মানুষের যাতায়াত বেড়েছে৷ এ সব দোকানে ৭৭ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় মেলে৷
ছবি: DW/P. Samanta
নাগালে আধুনিক পরিষেবা
সরকারি হাসপাতালে ডিজিটাল এক্স-রে, ইউএসজি, সিটি স্ক্যানের মতো আধুনিক পরিষেবা পাওয়া যায়৷ তবে রোগীর চাপে অনেক সময়েই এসব যন্ত্রপাতি দীর্ঘদিন বিকল হয়ে পড়ে থাকে৷
ছবি: DW/P. Samanta
নানারকম প্রকল্প
পশ্চিমবঙ্গে সরকারি স্তরে স্বাস্থ্য পরিষেবায় নানা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে৷ জননী শিশু সুরক্ষার মতো প্রকল্প এখন বেশ জনপ্রিয়৷ এর সাহায্যে মায়ের প্রসবকালীন মৃত্যুর হারও কমিয়ে ফেলা গেছে৷
ছবি: DW/P. Samanta
সরকারি হাসপাতাল প্রাঙ্গণ
বেশিরভাগ সময়েই তিল ধারণের জায়গা থাকে না৷ তবুও পরিষেবার খোঁজে দৈনিক কত না মানুষের জমায়েত হয় সরকারি হাসপাতালে! তৃতীয় বিশ্বের জনবহুল দেশে এটাই দস্তুর৷
ছবি: DW/P. Samanta
অতিথি দেবঃ ভব
সরকারি হাসপাতাল আগের থেকে পরিচ্ছন্ন হয়েছে, সুলভে মিলছে পরিষেবা: কিন্তু কিছু ছবি এখনও বদলায়নি: যেমন বিভিন্ন ওয়ার্ডে চারপেয়েদের অবাধ বিচরণ৷
ছবি: DW/P. Samanta
স্বাস্থ্য যখন পণ্য
যাঁদের হাতে টাকা রয়েছে, তাঁরা সরকারি হাসপাতালে ভিড় এড়াতে বেসরকারি পরিষেবার সুযোগ নেন৷ যদিও কলকাতার এমন বেসরকারি ক্লিনিকেও এখন ভালো ভিড় নজরে পড়ে৷
ছবি: DW/P. Samanta
যেখানে বিশ্বাস
অ্যালোপ্যাথির পাশাপাশি এ রাজ্যে হৈ হৈ করে হোমিওপ্যাথি বা আয়ুর্বেদ চিকিৎসাও চলছে৷ এর খরচ কম, তাছাড়া ব্যয়সাপেক্ষ পরীক্ষার ঝামেলা থাকে না বলে অনেকেই এ সবের উপর আস্থা রাখেন৷
ছবি: DW/P. Samanta
নার্সিংহোম দিকে দিকে
এখন পশ্চিমবঙ্গে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল চালু হয়েছে৷ তবুও নার্সিংহোমের রমরমা কিন্তু কমেনি৷ সার্জারি, ডায়ালিসিস ইত্যাদির জন্য মানুষ এখনও এদের ওপর নির্ভরশীল৷
ছবি: DW/P. Samanta
বহুরূপে সম্মুখে
কলকাতা সহ সর্বত্রই রক্তসহ নানা পরীক্ষাগার বা প্যাথোলজি ল্যাব গজিয়ে উঠেছে৷ গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও দিব্যি তারা লাভজনক ব্যবসা করছে৷ উল্টোদিকে গ্রামীণ এলাকায় অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনো ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান নেই৷
ছবি: DW/P. Samanta
13 ছবি1 | 13
বরং উল্টোটাই হয়৷ তাঁরা সবসময় চান ১০০ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাক৷ কিন্তু সব সময় সেটা হয় না৷ সেটা ব্যর্থতা এবং খুবই স্বাভাবিক৷ তার জন্য ডাক্তারদের দোষারোপ করা অযৌক্তিক৷
কলকাতার এক বিশিষ্ট শল্য চিকিৎসক ডা. উদয় মুখার্জি অন্য একটি সমস্যার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেন৷ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডাব্লিউএইচও'র নিয়ম অনুযায়ী, নাগরিক এবং চিকিৎসকের যে অনুপাত থাকা উচিত, ভারতে সেটা নেই, বরং বিস্তর অভাব আছে ডাক্তারের৷ ডা. মুখার্জির মতে, এটা সম্পূর্ণত পরিকাঠামোগত সমস্যা এবং সরকারের ব্যর্থতা৷ সম্ভবত সেই সমস্যার থেকে নজর ঘোরাতেই প্রতি ক্ষেত্রে ডাক্তারদের ভিলেন হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, যার পরিণতি এই ডাক্তাররূপী অসুর!