ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন নেটিজেনরা৷ ফেসবুকে তারা এই ঘটনার নিন্দা জানিয়ে হামলাকারী ও এর নেপথ্যে যারা আছে, তাদের শাস্তি দাবি করেছেন৷
বিজ্ঞাপন
ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল একজন জনপ্রিয় লেখকই শুধু নন, একজন জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব৷ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর লেখনী ধারালো হয়েছে৷
শনিবার তাঁরই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনুষ্ঠানে এক দুর্বৃত্তের ধারালো অস্ত্রের হামলায় রক্তাক্ত হয়েছেন তিনি৷ এখন তিনি চিকিৎসাধীন৷ হামলাকারীকে আটক করেছেন শিক্ষার্থীরা৷
এই হামলার ঘটনায় ফুঁসে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম৷ কেউ হতাশা প্রকাশ করেছেন৷ কেউ সোচ্চার হবার সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন৷
চিরকুটের শিল্পী শারমিন সুলতানা সুমি লিখেছেন, ‘‘অস্তমিত নগরে অ্যানেস্থেসিয়া সময়৷ মৃত কোলাহল৷ জোছনা বিষাদে পুড়ে ছাই উৎসব৷ মানুষ ভজলে কবে মানুষ হব৷ কোথায় যাবো, যাব কোথায়!’’
হাসান আহমেদ লিখেছেন, ‘‘মানুষের মত দেখতে কিন্তু...অমানুষ৷ এই ছেলেটিই আঘাত করেছে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালকে৷ এদের যারা মগজ ধোলাই করছে উগ্রতার দিকে৷ তাদের শেষ করতে একতাবদ্ধ হন সব শ্রেণি-পেশার প্রগতিশীল মানুষেরা৷ নতুবা মুক্তিযুদ্ধে পাওয়া বাংলাদেশ তার অস্তিত্ব হারাবে অচিরেই৷’’
ইমরান হোসেন লিখেছেন, ‘‘অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যারের উপর হামলাকারীদের বিচার চেয়ে লাভ নেই৷ বিচারহীনতার সংস্কৃতি এর জন্য দায়ী৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়নি৷ বিচার হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হুমায়ূন আজাদের উপর হামলাকারীদের৷ অতীতের এসব ঘটনার মূলোৎপাটন করলে এই চাপাতি সংস্কৃতি বন্ধ হতো৷ রাষ্ট্র দায় এড়াতে পারে না কিছুতেই৷’’
শরীফুল হাসানের মন্তব্য, ‘‘অধ্যাপক জাফর ইকবালের উপর হামলা হয়েছে৷ সেই চাপাতি৷ সেই পেছন থেকে হামলা৷ পুলিশ, ছাত্রছাত্রী সবার সামনে এমন হামলা৷ মনটা বিষিয়ে আছে৷ আশার কথা স্যার আশঙ্কামুক্ত৷ তবু্ও দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠুন এই দোয়া করি স্যার৷ আর হামলার নেপথ্যে কারা সেটা দ্রুত খুঁজে বের করা হোক৷’’
কেউ কেউ ড. জাফর ইকবাল একজন ‘নাস্তিক’ এমন মন্তব্য করাতেও ক্ষুব্ধ হয়েছেন অনেকে৷ কাজী সাবির লিখেছেন, ‘‘স্যারকে যে কোনো মূল্যে নাস্তিক প্রমাণ করে, হামলাটিকে যথার্থ প্রমাণ করে তবেই এই ঘুমন্ত জাতি আজ ঘুমাতে যাবে!’’
কাজী রত্না লিখেছেন, ‘‘আমার সিরিয়াসলি কান্না পাচ্ছে....যে কোন অফিসিয়িাল নিউজ লিংক এর কমেন্ট দেখে চিৎকার করতে ইচ্ছা করছে৷ এই দেশ আমার না....এই মানুষগুলো আমাদের না..সত্যিই আমাদের না....আমার দেশের মানুষ এত অসভ্য নোংরা হতে পারে না....সত্যিই পারে না...৷’’
সাংবাদিকদের অধিকাংশই অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন৷ শওগাত আলী সাগর লিখেছেন, ‘‘শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবালকে ছুরিকাঘাতকারীকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রোক্টোরিয়াল বডির কাছে হস্তান্তর করতে হবে কেন? খুন করার চেষ্টারত একজন দুর্বৃত্ত তো দ্রুত পুলিশ হেফাজতে নেওয়ার কথা৷ আর পুলিশ কী না এমন ভয়াবহ এক দুর্বৃত্তকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের হাতে দিয়ে দেয়!
বাই দা ওয়ে, জাফর ইকবালকে হত্যাচেষ্টার জন্য ব্যবহৃত ছুরিটি কি পুলিশ উদ্ধার করেছে? সেটি কি সংরক্ষণ করা হয়েছে?
আমি হামলাকারীর দিকে সর্বোচ্চ মনোযোগ দেওয়ার পক্ষে৷ সে কে, কাদের হয়ে জাফর ইকবালকে হত্যার চেষ্টা করেছে, তার পেছনের পৃষ্ঠপোষক কারা- এগুলো জানার জন্য সেই তো একমাত্র যোগসূত্র৷’’ জুলফিকার আলী মাণিক লিখেছেন, ‘‘আমার কিছু ত্বরিত পর্যবেক্ষণ- লেখক জাফর ইকবালের ওপর হামলাকারী যুবকের সুঠাম, সুগঠিত বাহু বলে দেয় নিয়ম করে ব্যায়াম করার অভ্যাস ছিল তার অথবা দারুণ দৈহিক পরিশ্রম করতে হয় এমন কাজে যুক্ত ছিল সে৷ শারীরিক প্রশিক্ষণ ছাড়া আরও কোনো নিয়মিত প্রশিক্ষণ তার থাকাটা স্বাভাবিক৷ না হলে এমন হামলা হুট করে যার তার পক্ষে করা সম্ভব নয়৷ ছেলেটি গোফ ছাটতো, কিন্তু বোগলের লোম ও দাড়ি কাটতো না৷ একটি কট্টর বিশ্বাসের ইঙ্গিত পাই৷ হামলাকারীর মগজ ধোলাইকারী কারা? ঘটনাস্থলে হামলাকারীর সঙ্গে আর কে কে ছিল? হামলাকারী বহিরাগত হলেও ক্যাম্পাসের কারও কারও হাত থাকাটা অস্বাভাবিক নয়৷ হামলার পরিকল্পনাকারী কারা? কবে সিদ্ধান্ত হলো? আমরা যখন ভাবছি সব কিছু নিয়ন্ত্রণে, শান্ত সব, আসলে তখন ওত পেতে আছে ওরা৷
শুধু সহজ সুযোগের অপেক্ষায়৷’’ আরাফাতুল ইসলাম লিখেছেন, ‘‘বাংলাদেশের বিচারহীনতার সংস্কৃতি যে দুর্বৃত্তদের সাহস কতটা বাড়িয়ে দিয়েছে তার নজির আজকের এই হামলা৷ জাফর ইকবাল স্যারের উপর এমন হামলা হতে পারে সেই আশঙ্কা বহু আগে থেকেই ছিল৷ সেই আশঙ্কা আজ সত্যি হলো৷ এই হামলা নিয়ে বর্তমান ‘শক্তের ভক্ত, নরমের যম’ সরকারের ঘোষিত, অঘোষিত প্রতিনিধিদের প্রতিক্রিয়া জানার অপেক্ষায় আছি৷’’
বাংলাদেশে ‘হুমকিতে’ প্রগতিশীলতা
বাংলাদেশে প্রগতিশীলদের প্রাণনাশের হুমকি প্রদান নতুন নয়৷ স্বাধীনতার পরপর একটি কবিতা লেখার জন্য দেশ ছাড়তে হয় একজন কবিকে৷ এখন কেবল হুমকি নয়, খুনও হয় অহরহ৷ কিন্তু এরপরও এসবে জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয় না৷
ছবি: AFP/Getty Images
দাউদ হায়দার
লেখালেখির জন্য মৌলবাদীদের হুমকি-ধমকিতে প্রথম বাংলাদেশ ছাড়তে হয় দাউদ হায়দারকে৷ ‘কালো সূর্যের কালো জ্যোৎস্নায় কালো বন্যায়’ নামে একটি কবিতার জন্য স্বাধীনতার পরপর তার বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল মৌলবাদীরা৷ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কবিতাটি প্রত্যাহার করে দাউদ হায়দার ক্ষমা প্রার্থণা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি৷ তিনি গ্রেপ্তার হন৷ মুক্তির পর তাঁকে কলকাতাগামী বিমানে তুলে দেয়া হয়৷ তিনি জার্মানিতে রয়েছেন৷
ছবি: DW/A. Islam
ড. আহমদ শরীফ
দেশের প্রবীণ শিক্ষাবিদ ড. আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে ১৯৯২ সালের শেষের দিকে মৌলবাদীরা মাঠে নামে৷ ওই বছরের শুরুর দিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ‘একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি’ গঠিত হয়৷ ড. আহমেদ শরীফও ওই কমিটির সদস্য ছিলেন৷ কমিটির আন্দোলনে চাপে পড়ে ‘যুদ্ধাপরাধীদের দল’ হিসেবে পরিচিত জামায়াত৷ সেই পরিস্থিতিতেই আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে ধর্ম অবমানননার অভিযোগ তোলা হয়৷ জামায়াত এ বিষয়ে সংসদেও কথা বলে৷
ছবি: Khandaker Mohitul Islam
তসলিমা নাসরিন
ড. আহমদ শরীফের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরুর কিছুদিনের মধ্যে তসলিমা নাসরিনের নামও সেখানে যুক্ত হয়৷ ১৯৯৪ সালে তসলিমা বিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে৷ আগের বছর প্রকাশিত ‘লজ্জা’ উপন্যাসকে ঘিরেই মৌলবাদী বিভিন্ন সংগঠন ধর্ম অবমাননার অভিযোগে তাঁর ফাঁসি দাবি করে৷ হত্যার ফতোয়া দিয়ে তাঁর মাথার দামও ঘোষণা করা হয়৷ এক পর্যায়ে তাঁকে দেশ ছাড়তে হয়৷
ছবি: AFP/Getty Images
হুমায়ুন আজাদ
‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ নামে একটি বইয়ের জন্য ‘প্রথাবিরোধী’ লেখক হুমায়ুন আজাদের বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে মাঠে নামে বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন৷ এর মধ্যে একই বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার সময় তাঁর উপর হামলা হয়৷ সে বছরেরই আগস্ট মাসে জার্মানির মিউনিখে তাঁর মৃত্যু হয়৷
ছবি: DW/Gönna Ketels
শাহরিয়ার কবির
সাম্প্রতিক সময়ে যাঁরা নানা ধরণের হুমকির শিকার হয়ে আসছিলেন, তাদের মধ্যে শাহরিয়ার কবির অন্যতম৷ দীর্ঘদিন যাবত তিনি একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের হাল ধরে আছেন৷ ২০০১ সালে বিএনপি-জামাত জোট সরকার ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তারও করা হয়৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরুর পর এবং গণজাগরণ মঞ্চে সক্রিয় হওয়ার পর তিনি ও তার সহকর্মীরা অনেকবার হত্যার হুমকি পান৷
ছবি: bdnews24.com/A. Pramanik
জাফর ইকবাল
বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক এবং শিক্ষাবিদ জাফর ইকবালকেও নানা সময়ে মৌলবাদীরা হত্যার হুমকি দিয়েছে৷ ২০১৬ সালের অক্টোবরে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম তাঁকে এবং তাঁর স্ত্রী-কে হত্যার হুমকি দেয়৷ এরা আগের বছরও তাঁকেসহ প্রগতিমনা ২০ জনকে হত্যার হুমকি দেয়৷ মৌলবাদীদের হামলায় নিহত হন রেজাউল করিম সিদ্দিকী এবং একেএম শফিউল ইসলাম নামের দু’জন শিক্ষাবিদ ও বেশ কয়েকজন বিদেশি ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু৷
ছবি: DW/M. Mamun
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী
টাঙ্গাইলের সিদ্দিকী পরিবারের প্রভাবশালী সদস্য আবদুল লতিফ সিদ্দিকী ২০০৯ এবং ২০১৪ সালের মন্ত্রিসভায় দাপটের সাথেই ছিলেন৷ হজ নিয়ে করা মন্তব্যের পর তাঁর ফাঁসির দাবিতে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন সংগঠন মাঠে নামে৷ এক পর্যায়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে ‘ঠোঁটকাটা’ হিসেবে পরিচিত এই মন্ত্রী দলীয় পদ, মন্ত্রিত্ব সবই খোয়ান৷
ছবি: DW
সুলতানা কামাল
সাম্প্রতিক সময়ে মৌলবাদীদের টার্গেটে পরিণত হন মানবাধিকার কর্মী ও মুক্তিযোদ্ধা সুলতানা কামাল৷ একটি টেলিভিশন বিতর্কে পাল্টা যুক্তি দিতে গিয়ে বলা এক কথার পর তাঁর বিরুদ্ধে মাঠে নামে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম৷ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাঁকে গ্রেপ্তার বা দেশ ছাড়া করার দাবিও জানায় তারা৷
ছবি: DW/M. Mamun
কেবল হুমকি নয়, খুনও হচ্ছে
সাম্প্রতিক সময়ে মৌলবাদী ও জঙ্গি সংগঠনগুলোর হুমকি দেয়া শুরু হয় গণজাগরণ মঞ্চ শুরুর পর৷ ২০১৩ সালে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে তরুণ-তরুণীরা শাহবাগে আন্দোলন শুরু করলে মঞ্চকর্মীদের ‘নাস্তিক’ আখ্যা দিয়ে হুমকি দেয়া শুরু হয়৷ এর মাঝে খুন হন মঞ্চকর্মী রাজিব হায়দার৷ একে একে নিহত হন অভিজিৎ, ওয়াশিকুর, অনন্ত, নিলয় ও দীপনসহ অনেকে৷ হুমায়ুন আজাদসহ প্রায় সব হামলায়ই ধারালো অস্ত্র দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP
বাঁচার জন্য দেশত্যাগ
২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর ঢাকার লালমাটিয়ায় হামলা হলেও প্রাণে বেঁচে যান ‘শুদ্ধস্বর’-এর আহমেদুর রশীদ টুটুল৷ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরলেও আতঙ্কে স্বাভাবিক চলাফেরায় ফিরতে পারেননি৷ এক পর্যায়ে তিনি দেশ ছাড়েন৷ তাঁর সঙ্গে আহত হওয়া ব্লগার তারেক রহিমও ওই সময় দেশত্যাগ করেছিলেন৷ গত ৩-৪ বছরে আরও অনেক ব্লগার দেশ ছাড়তে বাধ্য হন৷