অস্তিত্ব রাখতে নির্বাচন, নির্বাচনী চিন্তায় অস্তিত্ব বিসর্জন
মোস্তফা মামুন
৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২
একসময় এক সিনে রিপোর্টারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল৷ এতটাই যে আমরা অনেকদিন হাউসমেট ছিলাম৷ হাউসমেট হওয়ার পর সিনে তারকাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা টের পেলাম৷ একদিন ঢাকাই ছবির এক নামকরা তারকা বাসায় হাজির উপহার আর ফলমূলের পসরা নিয়ে৷
বিজ্ঞাপন
নিজে তখন পুরোদস্তুর ক্রীড়া সাংবাদিক৷ খেলার অঙ্গনের মানুষের সঙ্গে খাতিরও আছে যথেষ্ট কিন্তু সিনে সাংবাদিকের তুলনায় সমাদর এত কম যে মাঝে মধ্যে তাকে ঈর্ষা হত৷ কোনো একদিন আড্ডায় সেটা প্রকাশও করে ফেললাম৷ সিনে সাংবাদিক বন্ধু বললেন, ‘আসলে সিনেমার জগতের মানুষের মন অনেক বড়৷ বড় পর্দা তো৷ সবকিছু বড় করে দেখে৷'
কথাটা মনে ধরেছিল৷ বড় পর্দা৷ তাই এরা সব বড় মানুষ৷ সেই বড় মানুষরা সময়ে ছোট হয়েছে৷ সিনেমা জৌলুশ হারিয়ে এমন অন্ধকারে গেছে যে নিজেই ভালোমতো আর নায়ক-নায়িকাদের চিনি না৷ পত্রিকায় পড়ি, অমুক নায়িকা অতগুলো ছবি করে বসেছেন৷ নিজের অজ্ঞতায় লজ্জা পাই৷ চুপিচুপি বোঝার চেষ্টা করি, তাকে বা তাদের না চেনা আমার চেনার অক্ষমতা নাকি তাদের চেনানোর ব্যর্থতা৷ আশপাশের একে-ওকে জিজ্ঞেস করি, ‘অমুক নায়িকাকে চেনেন?'
‘কী নাম বললে?'
‘নাম শুনেননি! অতগুলো ছবিতে সাইন করেছে৷ অতগুলো মুক্তি পেয়েছি৷'
ঐ পক্ষ ভাবে৷ শেষে হাসে৷ যে হাসির অর্থ এখন ঢাকার সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের না চেনাই স্বাভাবিকতা৷
সেসব নায়ক-নায়িকা বছরে এখন একবার নিজেদের চেনান৷ নির্বাচনে দাঁড়িয়ে৷ অথবা নির্বাচনী উত্তেজনায় অংশ নিয়ে৷ আর নিজেদের চেনাতে গিয়ে যা যা করেন তাতে ভেবে অবাক হই, একসময় এই সিনেমা জগতে কীসব কিংবদন্তিরা ছিলেন! ব্যক্তিত্বের বিস্তৃত ছায়া আর কৃতিত্বের দ্যুতি দিয়ে পুরো দেশকে কেমন চমকাতেন৷ না, এ বড় লজ্জার কথা যে ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের মতো নির্বাচনে নেমে তাদের নিজেদের চেনাতে হয়৷ এবং আরও লজ্জা লাগে যখন দেখি মানেও তারা সেই পর্যায়ে নেমে গেছেন৷ সেভাবেই নির্বাচন জেতার চেষ্টা৷ তীব্র কাদা ছোঁড়াছুড়ি৷ বাংলা সিনেমা নষ্ট হয়েছে অশ্লীলতায়৷ অকথ্য সব সংলাপে মানুষ কানে হাত দিয়েছে৷ এবার নির্বাচন যেন সেরকম পচনেরই প্রতীকী ছবি৷ যেসব কারণে সিনেমা মানুষ থেকে দূরে গেছে সেগুলোর প্রদর্শনী দিয়ে তারা যেন ঢোল পিটিয়ে জানিয়ে দিলেন কেন বর্তমান সিনেমার প্রতি আর কোনো আকর্ষণ থাকা উচিত না৷ রাজনীতির নির্বাচনের মতো টাকা দিয়ে ভোট কেনার অভিযোগ উঠল৷ সেখানকার মতো নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতা হয়তো নেই কিন্তু অশ্লীলতা ঠিকই আছে৷ প্রধান নির্বাচন কমিশনার, যিনি নিজেও একজন অভিনেতা, তিনি নাকি সাধারণ সম্পাদক নারী প্রার্থীর কাছে একটা চরম অশ্লীল দাবি করেছিলেন৷ পতনের মাত্রাটা ভাবা যায়! ধরা যাক, এই অভিযোগ সত্য নয়৷ কিন্তু সত্য যদি না হয় তবুও কথা শেষ হয় না৷ ঘায়েল করার জন্য একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ করছেন! আর সেটাই সিনেমার মানুষ বা সিনেমা শিল্পের প্রতি অনুরাগের বদলে রাগ তৈরির জন্য যথেষ্ট৷
এফডিসি : বিলীয়মান ঢাকাই চলচ্চিত্রের বিবর্ণ সূতিকাগার
এক সময় বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের প্রাণকেন্দ্র এফডিসির বিভিন্ন ফ্লোরে একসঙ্গে কয়েকটি সিনেমার শুটিং হতো৷ তারকাদের ভিড়ে অন্যরকম প্রাণচাঞ্চল্য দেখা যেতো সেখানে৷ ঢাকাই চলচ্চিত্রের আঁতুড়ঘরের এখন কী অবস্থা দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Rajib Paul
প্রবেশপথে শুরুর ইতিহাস
এফডিসির মূল প্রবেশপথের একপাশের দেয়ালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতির নীচে এক টুকরো ইতিহাস৷ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে তৎকালীন শিল্প, বাণিজ্য ও শ্রমমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমানের পেশ করা ‘চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন’ বিল ১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়৷ তবে এখানে প্রথম শুটিং হয়েছিল ১৯৫৯ সালে৷ স্বাধীন দেশে প্রতিষ্ঠানটির নাম হয় ‘বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন’ ৷
ছবি: Rajib Paul
প্রবেশ ফি ১০৫ টাকা
এক সময় এফডিসির মূল ফটকের সামনে দর্শনার্থীদের জটলা দেখা যেতো৷ রুপালি পর্দার তারকাদের একনজর দেখতে উৎসুক মানুষের ভিড় জমতো৷ এখন এফডিসিতে সাধারণ মানুষদের এত হুড়োহুড়ি নেই৷ প্রবেশপথের ভেতরে ডানদিকে অলস সময় কাটান নিরাপত্তাকর্মীরা৷ বাঁ-দিকের নিরাপত্তা শাখার কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে এফডিসি ঘুরে দেখা যায়৷ দর্শনার্থীদের প্রবেশ ফি জনপ্রতি ১০৫ টাকা৷
ছবি: Rajib Paul
স্মৃতিতে ৩ ও ৪ নম্বর ফ্লোর
সাত একরেরও বেশি এলাকাজুড়ে গড়ে তোলা এফডিসিতে শুটিংয়ের জন্য ৯টি ফ্লোর ছিল৷ কিন্তু ৩ ও ৪ নম্বর ফ্লোরসহ পুরনো এডিটিং ভবন, সুইমিং পুল ভেঙে ফেলা হয়েছে৷ সেই মাটিতে এখন ঘাসের সমাহার৷ এখানেই ৯৪ কাঠা জমির ওপর গড়ে উঠবে আধুনিক স্থাপনা বিএফডিসি কমপ্লেক্স৷ এফডিসির আয় বাড়াতেই এই উদ্যোগ৷ তবে অন্য ফ্লোরগুলোর ব্যাপারে যেন কর্তৃপক্ষ উদাসীন৷ বেশিরভাগ ফ্লোরে ময়লার আস্তর জমে গেছে৷
ছবি: Rajib Paul
বেশিরভাগ ফ্লোরে তালা
বেশিরভাগ ফ্লোর এখন বন্ধ৷ এখানে সাধারণত শিফট অনুযায়ী ফ্লোর কিংবা স্পট ভাড়া দেওয়া হয়৷ সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সকালের শিফট ৷ বিকাল ৫টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত বিকেলের এবং রাত ১১টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত বিশেষ শিফট ৷ চলচ্চিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রে ২ লাখ টাকা জামানত দিয়ে ক্যামেরা ছাড়া সব যন্ত্রপাতি-যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা যায়৷ ক্যামেরাসহ যন্ত্রপাতি-যন্ত্রাংশ ব্যবহার করলে আরো ১ লাখ টাকা দিতে হয়৷
ছবি: Rajib Paul
সবচেয়ে দামি ফ্লোর
একটি ফ্লোর ‘মুক্তিযোদ্ধা চিত্রনায়ক জসিমের নামে৷ আর কোনো অভিনয়শিল্পীর নামে এখনো কোনো ফ্লোর নেই৷ মুক্তিযোদ্ধা বলেই ১৯৯৮ সালের ৮ অক্টোবর মৃত্যুর পর এই সম্মান পেয়েছেন তিনি৷ এফডিসির সবচেয়ে দামি এই ফ্লোরে সেট নির্মাণকালীন প্রতি শিফটের ভাড়া ৫ হাজার ১০০ টাকা৷ এর দোতলায় সেট বানালে প্রতি শিফটে গুণতে হয় বাড়তি ৩ হাজার ৫০০ টাকা৷ শুটিংয়ের সময় ২ নম্বর ফ্লোরের ভাড়া প্রতি শিফটে ১৮ হাজার ৫৪০ টাকা৷
ছবি: Rajib Paul
৭ নম্বর ফ্লোরে ‘জয় বাংলা’
করোনা মহামারিতে থমকে গিয়েছিল এফডিসি৷ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় এখন টুকটাক কাজ হচ্ছে৷ ৭ নম্বর ফ্লোরে গত ২৫ সেপ্টেম্বর থেকে টানা একসপ্তাহ সরকারি অনুদানের ছবি ‘জয় বাংলা’র শুটিং হয়েছে৷ মুনতাসীর মামুনের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কিশোর উপন্যাস অবলম্বনে সাজানো হয়েছে এর চিত্রনাট্য৷ কাজী হায়াতের পরিচালনায় এতে কামাল চরিত্রে বাপ্পি চৌধুরী ও দোলার ভূমিকায় আছেন জাহারা মিতু৷
ছবি: Rajib Paul
শুটিং কমার আরেক কারণ
দেশে একসময় যত চলচ্চিত্র তৈরি হতো তার সত্তর ভাগের কাজ এখানেই করতেন নির্মাতা ও কলাকুশলীরা৷ কিন্তু এখন উত্তরাসহ ঢাকার বিভিন্ন বাড়িঘর ভাড়া নিয়ে শুটিং হয়৷ এফডিসিতে সেট নির্মাণ করে আলাদা বিদ্যুৎ বিল, ক্যামেরা ও লাইট ভাড়া দিতে অনেক টাকা লাগে৷ তাই এফডিসির বাইরে কাজ করেন বেশিরভাগ নির্মাতা৷ অন্যত্র শুটিংয়ের সময় আসবাবপত্রসহ ভাড়া পাওয়া যায়৷ আলাদা বিদ্যুৎ বিলও দিতে হয় না৷
ছবি: Rajib Paul
সেট নির্মাণের তোড়জোর
দুটি ফ্লোর ভেঙে ফেলায় এফডিসিতে ফ্লোর আছে ৭টি৷ এর মধ্যে ১ নম্বর ফ্লোরে সেট নির্মাণের তোড়জোর চোখে পড়েছে৷ বিজ্ঞাপনচিত্রের শুটিংয়ের প্রস্তুতি চলছিল৷ সেট নির্মাণকালে ১, ৫, ৬ ও ৭ নম্বর ফ্লোরের ভাড়া প্রতি শিফটে ২,৫৫০ টাকা৷ ৭ নম্বর ছাড়া এসব ফ্লোরে শুটিংকালীন প্রতি শিফটে গুণতে হয় ৬,৫০০ টাকা৷ ৭ নম্বর ফ্লোরে শুটিংকালীন ভাড়া প্রতি শিফটে ৯,২৭০ টাকা৷ ১, ৫ ও ৬ নম্বর ফ্লোরে শুটিংয়ের জন্য ভাড়া ৬,৫০০ টাকা৷
ছবি: Rajib Paul
টেলিভিশন চ্যানেলের শুটিং বেশি
এফডিসিতে দীর্ঘদিন ধরেই চলচ্চিত্রের চেয়ে বিজ্ঞাপনচিত্র, নাটক কিংবা টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানের কাজ হচ্ছে বেশি৷ ৮ নম্বর ফ্লোর তো অঘোষিতভাবে ‘এটিএন বাংলা ফ্লোর’-এর পরিচিতি পেয়ে গেছে! চ্যানেলটি কয়েক বছর ধরে এখানে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের কাজ করছে৷ সেখানে সেট নির্মাণকালে প্রতি শিফটের ভাড়া ৩,৬৭২ টাকা৷ আর শুটিংকালীন প্রতি শিফটের ভাড়া ৭,৫০০ টাকা৷
ছবি: Rajib Paul
মরচে ধরা নিরাপত্তা নির্দেশিকা
এফডিসির ৮ নম্বর ফ্লোরের করিডোর থেকে নামলেই দেখা যায় মরচে ধরে যাওয়া একটি নিরাপত্তা নির্দেশিকা৷ এর ভেতরে গাছগাছালির সান্নিধ্যে কয়েকটি বসার বেঞ্চ৷ ক্লান্ত হলে অনেকে বেঞ্চে বসে সময় কাটান৷ সাধারণত সিনেমার ‘এক্সট্রা’ শিল্পীদের আনাগোনা দেখা যেতো এখানে৷ তখন লোকেলোকারণ্য থাকতো এফডিসি৷ সব পথেও শুটিং হতো৷ পরিচালক ‘কাট’ না বলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো সবাইকে৷ সুবর্ণ সেই সময় আর নেই বললেই চলে৷
ছবি: Rajib Paul
রূপসজ্জা কক্ষ
এফডিসিতে রূপসজ্জার কক্ষ আছে মোট ১৪টি৷ প্রতিটিই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত৷ আলোকিত আয়নার সামনে বসে সাজগোজের জন্য আছে চেয়ার৷ আরো আছে আলাদা বসার ব্যবস্থা৷ রূপসজ্জা কক্ষগুলোর একেকটির ভাড়া ২ হাজার ১০০ টাকা৷ রূপসজ্জা কক্ষে শুটিং করলে প্রতি শিফটের ভাড়া ২ হাজার টাকা৷ অভিনয়শিল্পীরা শুটিংয়ের ফাঁকে বেশিরভাগ সময় রূপসজ্জা কক্ষেই কাটান৷ কিন্তু এখন এফডিসিতে কাজ কমে যাওয়ায় এগুলো প্রায় সবসময়ই ফাঁকা পড়ে থাকে৷
ছবি: Rajib Paul
‘ভিআইপি’ ক্যান্টিন
এফডিসিতে সবার খাবারের জন্য আছে একটি ক্যান্টিন৷ এর সাইনবোর্ডে লেখা ‘বিএফডিসি-ভিআইপি ক্যান্টিন’৷ ক্যান্টিনটির স্বত্ত্বাধিকারী প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা ভাড়া দেন এফডিসি কর্তৃপক্ষকে৷ শুটিং কম এবং করোনার কারণে ব্যবসায় ভাটা পড়েছে৷ এখানে চা, সিঙ্গাড়া, ভাত, মাছ, মাংস, পিঁয়াজু, পুরি ইত্যাদি মেলে৷ ক্যান্টিনের ঠিক পাশেই বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশন কলা-কুশলী ও কর্মচারী লীগের কার্যালয়৷
ছবি: Rajib Paul
সমিতির গল্প
ক্যান্টিনের পাশের সরু পথ দিয়ে হেঁটে গেলেই পরিচালক সমিতি৷ চলচ্চিত্র পরিচালকদের সংগঠনের কার্যালয়ের বারান্দায় বসে পরিচালকরা খোশগল্প করেন৷ এফডিসিতে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট মোট সাতটি সমিতির কার্যালয়ের বাকিগুলো হলো- প্রযোজক পরিবেশক সমিতি, শিল্পী সমিতি, চলচ্চিত্র গ্রাহক সংস্থা, সিনে ডিরেক্টোরিয়াল অ্যাসোসিয়েটস অব বাংলাদেশ (সিডাব), ফিল্ম এডিটরস গিল্ড এবং চলচ্চিত্র ব্যবস্থাপক সমিতি৷
ছবি: Rajib Paul
শিল্পী সমিতির সামনে জলাবদ্ধতা
পরিচালক সমিতির পাশেই চলচ্চিত্র অভিনয়শিল্পীদের সংগঠন ‘শিল্পী সমিতি’র কার্যালয়৷ এর সামনে সামান্য বৃষ্টিতেই পানি জমে যায়৷ এ কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয় সংশ্লিষ্টদের৷ বিশেষ করে নারীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয় একটু বেশি৷ পানির কারণে পিছলে থাকা পথে হাঁটতে গিয়ে যেকোনো ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে৷ ভারী বৃষ্টি হলে এফডিসির বেশকিছু জায়গায় এরকম জলাবদ্ধতা দেখা যায়৷
ছবি: Rajib Paul
ফুলের বাগান
শিল্পী সমিতি কার্যালয়ের সামনে রয়েছে একটি বাগান৷ একপাশে কয়েকটি নারিকেল গাছ৷ এখানে সবুজের সমারোহে একসময় অনেক সিনেমার শুটিং হতো৷ বাগানে প্রতি শিফটে ২ হাজার টাকা করে সেট নির্মাণ ও শুটিংয়ের ভাড়া৷ হরেক রকমের ফুল রয়েছে বাগানে৷
ছবি: Rajib Paul
কড়ই তলা
সিনেমা তৈরির কারখানা এফডিসির অন্যতম ব্যস্ত জায়গা ছিল এটি৷ এখন কড়ই তলায় নেই চিরচেনা কর্মচাঞ্চল্য৷ গাছের নীচে কয়েকটি বেড়া পড়ে আছে৷ একপাশে অনেকদিন না চালানো একটি মাইক্রোবাস ও একটি প্রাইভেটকার রাখা৷ গাড়ি দুটিতে ময়লা জমে আছে৷ কড়ই তলায় সেট নির্মাণকালে প্রতি শিফটের ভাড়া ১ হাজার টাকা৷ পাঁচদিনের বেশি লাগলে তা দাঁড়ায় ৩ হাজার টাকায়৷ শুটিং চলাকালে প্রতি শিফটে গুনতে হয় ৩ হাজার টাকা৷
ছবি: Rajib Paul
এফডিসি মানেই শুটিং
বিভিন্ন ভবনের সিঁড়ি, করিডোর, লবি, ছাদ, ৮ ও ৯ নম্বর ফ্লোরের মাঠসহ চারদিকে শুটিং হতো একসময়৷ এখন কালেভদ্রে এসব স্থানে নির্মাতা ও তারকাদের উপস্থিতি দেখা যায়৷ স্পট ভাড়া দেওয়ার পাশাপাশি এফডিসি কর্তৃপক্ষ জনবল সরবরাহ করে৷ নির্মাতার চাহিদার আলোকে ক্যামেরা ও লাইট শাখাসহ অতিরিক্ত জনবল দেওয়া হয়৷ কেউ চাইলে এফডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কক্ষেও শুটিং করতে পারেন৷ এজন্য প্রতি শিফটে গুনতে হয় ১০ হাজার ৩০০ টাকা৷
ছবি: Rajib Paul
জহির রায়হান কালার ল্যাব
এফডিসির কর্মকর্তাদের কর্মস্থল প্রশাসনিক ভবনের নীচতলায় প্রায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে জহির রায়হান কালার ল্যাব৷ ১৯৮৩ সালের ১৪ মার্চ এর উদ্বোধন হয়৷ নেগেটিভ ফিল্মের যুগে চলচ্চিত্রের সূতিকাগার এফডিসির আয়ের সিংহভাগ ল্যাব থেকেই আসতো৷ ডিজিটাল পদ্ধতিতে সিনেমা নির্মাণ শুরুর পর ধীরে ধীরে ল্যাবে কাজ কমতে থাকে৷ এখন আর নেগেটিভ ব্যবহৃত হয় না৷ তাই কয়েক বছর ধরে ল্যাব প্রায় বন্ধ বলা চলে৷
ছবি: Rajib Paul
মান্না ডিজিটাল কমপ্লেক্স
সুস্থ বিনোদনমূলক চলচ্চিত্র নির্মাণে সহায়তা ও অনুপ্রেরণা দিতেই প্রতিষ্ঠা করা হয় এফডিসি৷ ডিজিটাল যুগে এখানকার অন্যতম সংযোজন মান্না ডিজিটাল কমপ্লেক্স৷ নায়ক মান্না স্মরণে এর নামকরণ হয়েছে৷ এখানে নীচতলায় আছে ডিটিএস হলরুম৷ ডিজিটাল প্রযুক্তি সংবলিত ভিডিও সম্পাদনা, রঙ বিন্যাস ও রেকর্ডিং স্টুডিওর সুবিধা রয়েছে এতে৷ ২০০৮ সালের ১৭ জুলাই কমপ্লেক্সটির উদ্বোধন হয়৷
ছবি: Rajib Paul
ঝরনা স্পট
এফডিসির এই জায়গাটা বেশ বিখ্যাত! অনেক চলচ্চিত্রে এই স্পট দেখেছেন দর্শকরা৷ কৃত্রিম উপায়ে বানানো ঝরনা থেকে এখন আর পানি ঝরে না৷ দীর্ঘদিন ধরেই অবহেলায় পড়ে থাকা ঝরনা স্পটে শুটিং হয় না৷ এখানে সেট নির্মাণকালে প্রতি শিফটের ভাড়া নেওয়া হয় ২ হাজার ৮০০ টাকা৷ আর শুটিং চলাকালীন প্রতি শিফটের ভাড়া ৪ হাজার টাকা৷ ঝরনা স্পটে এখন বেশকিছু সিমেন্টের বস্তা, বাঁশ ও টিন ফেলে রাখা হয়েছে৷ চারিদিকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আবর্জনা৷
ছবি: Rajib Paul
ঝরনা স্পটের পুকুর
গাছ-গাছালিতে ঘেরা ঝরনা স্পটের পুকুর দর্শকদের বেশ চেনা৷ রুপালি পর্দায় দেখা যাওয়া এই পুকুরের ওপর সবুজ শেওলার আস্তর জমে গেছে৷ ফোয়ারা নেই৷ পুকুরের ওপর ছোট্ট ব্রিজটি অযত্নে পড়ে আছে৷ পুকুর পাড়ের চারপাশে হাঁটাপথের বেহাল দশা৷ চারদিকে সাজিয়ে রাখা সিমেন্টের ছাতাগুলোর ওপর ময়লা জমে মলিন হয়ে আছে৷ কেউ এদিকে ফিরেও তাকায় না৷ পাশেই চলছে মসজিদ নির্মাণের কাজ৷ এ কারণে এই স্পটে ধুলোবালি আরো বেশি জমছে৷
ছবি: Rajib Paul
রঙ-বেরঙের পাথর
অনেক জনপ্রিয় গানের শুটিং হয়েছে এখানে৷ নাচের দৃশ্যের শুটিংয়ের জন্য একসময় এটাই ছিল নির্মাতাদের ‘অটোমেটিক চয়েস’৷ স্বর্ণালি সেই যুগের সাক্ষী এই স্পটে জড়িয়ে আছে শিল্পীদের অনেক স্মৃতি৷ ঝরনা স্পটের একপাশে রঙ-বেরঙের পাথরের ছোট্ট টিলায় ময়লা জমে যাওয়ায় বিবর্ণ লাগছে৷ এক সময় তারকাদের অংশগ্রহণে রোমান্টিক গানের শুটিং হতো টিলার পাশে৷ এখন এই জায়গা নির্জন হয়ে পড়ে থাকে৷ এফডিসির চারপাশেই এমন সুনসান নীরবতা৷
ছবি: Rajib Paul
সাউন্ড ডাবিং থিয়েটার ভবন
ঝরনা স্পটের উল্টো দিকেই ডিজিটাল সাউন্ড ডাবিং থিয়েটার ভবন ও এডিটিং ভবন৷ আগে ধারণকৃত দৃশ্যের সঙ্গে মিলিয়ে অভিনয়শিল্পীরা এখানে ডাবিং করেন৷ শব্দগ্রহণ মেশিনের মাধ্যমে ডাবিং করলে প্রতি শিফটের ভাড়া ৫ হাজার ২৫০ টাকা৷ ডিজিটাল ডাবিংয়ের জন্য নেওয়া হয় ৩ হাজার ১৫০ টাকা৷ ডিজিটাল যুগে এফডিসি বিভিন্ন আধুনিক যন্ত্রাংশ রেখেছে৷
ছবি: Rajib Paul
মাটির চুলায় লাকড়ি দিয়ে রান্না করা খাবার
শুটিংয়ের সময় রোজ দুপুরে এফডিসির খাবার উপভোগ করেন কলাকুশলীরা৷ তারকাদের কাছেও এর কদর আছে৷ এফডিসির কয়েক গজ দূরে গাড়ি মেরামতের গ্যারেজ গলিতে অবস্থিত হোটেল থেকে শুটিং স্পটে খাবার আসে৷ মাটির চুলায় কাঠের লাকড়ি দিয়ে রান্না করা খাবারের তালিকায় থাকে ভাত, গরুর কালাভুনা, মুরগির ঝাল ফ্রাই, ছোট ও বড় মাছ, ডাল ভুনা, পাঁচমিশালি সবজি, আলুভর্তা, কালিজিরা ভর্তা, বেগুন ভর্তা, চিংড়ি ভর্তা, লাউয়ের সবজি, শুঁটকি ভর্তা৷
ছবি: Rajib Paul
24 ছবি1 | 24
দেখতে দেখতে আবছা হয়ে যাওয়া পুরানো দিন বেদনা নিয়ে ভেসে আসে৷ মনে পড়ে প্রথম সিনেমা দেখার স্মৃতিটা৷ কী উৎসব! খুব সম্ভব ছবির নাম ছিল গোলাপী এখন ট্রেনে৷ মফস্বলের সাদামাটা হল, কাঠের চেয়ার, মশা-টশাও ছিল, কিছুই গায়ে লাগেনি৷ অন্ধকার ঘরে যেন অন্য এক পৃথিবী৷ দৈনন্দিন জীবনের যত দুঃখ, যত অপ্রাপ্তি সব কিছু মুক্ত সেই পৃথিবীতে গিয়ে মিলত সত্যিকারের পৃথিবীর সঙ্গে লড়াইয়ের জ্বালানি৷ সেই দিনগুলো কোথায় গেল!
ভেবেছি অনেক৷ খালি আর খোলা চোখে সবাই বলবে, এখন আর সেই সব সিনেমা আছে নাকি! খুব সরলীকৃত বিশ্লেষণ মনে হয়৷ মাঝে মধ্যে টিভি স্যাটেলাইটে পুরনো সেসব ছবি দেখি৷ আবেগের অংশটুকু বাদ দিয়ে নির্ভেজাল বিচারে গেলে মানতে হবে কিছু ভালো ছবি ছিল কিন্তু এমন আহামরি কিছু নয় বেশিরভাগই৷ তাই সিনেমার মান কমে গেছে এটা একমাত্র কারণ নয়৷ যেমন এটাও কারণ নয় যে মানুষ টিভি-স্যাটেলাইট বা ওটিটিতে সব পেয়ে যাচ্ছে বলে আর হলে যেতে চায় না৷ তাই যদি হত, তাহলে তো অ্যামেরিকা-ইউরোপে সব হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা৷ ভারতে কেন আজও লাইন ধরে মানুষ সিনেমা দেখে৷ আকাশ উন্মুক্ত হয়ে যাওয়াতে বাইরের মানসম্পন্ন সিনেমার সঙ্গে লড়তে হয় বলে অসম প্রতিযোগিতার কথা বলেন আরেক দল৷ এটা একটা যুক্তি৷ একমাত্র অবশ্যই নয়৷ তাহলে পৃথিবীতে হলিউড-বলিউড এরকম কয়েকটা প্রতিষ্ঠিত ইন্ডাস্ট্রি ছাড়া সব শেষ হয়ে যেত৷ হয়নি৷
মাঝে মধ্যে মনে হয়, বাংলা সিনেমার সঙ্গে আমাদের ফুটবলের অবিশ্বাস্য মিল৷ দুটোরই সোনালী অতীত, অগোছালো বর্তমান আর অন্ধকার ভবিষ্যৎ৷ এবং দুটোর ক্ষেত্রেই আমাদের খণ্ডিত বোধ আর একপেশে বিশ্লেষণেরও দায় আছে৷ ফুটবলে যেমন আমরা ধরে নেই, পৃথিবীর উন্নত লিগ দেখার সুযোগের কারণেই দেশের ফুটবলের প্রতি এই নিরাসক্তি৷ কিন্তু একটু তলিয়ে দেখি না তা হলে পৃথিবীতে কয়েকটা লিগ ছাড়া আর সব দেশের ফুটবল শেষ হয়ে যেত৷ ওরাও মেসি-রোনালদোকে আমাদের মতো দেখে তবু দেশের ফুটবলে মেতে থাকে৷ ঠিক এমনই, পৃথিবীর সব দেশই কুরোসওয়া- কিয়ারোস্তামি-ফেলিনির ছবি দেখে, তবু নিজেদের সিনেমাকে ফেলনা মনে করে না৷ আসলে দুটো ক্ষেত্রেই, এই নিজেদের জিনিস মনে করার বোধটাই আমরা তৈরি করতে পারেনি৷ সুসময় যখন ছিল তখন অসময়ের কথা কারো মাথায় আসেনি৷ কেউ দূরটা দেখেননি, দূরের দিনের জন্য নিজেদের তৈরি করেননি৷ যখন স্যাটেলাইট প্রথম এল তখন মধ্যবিত্তকে হারিয়ে সিনেমা আশ্রয় খুঁজল শ্রমিক শ্রেণীর মানুষের কাছে৷ আর তাদেরকে রুচিকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করে তৈরি হল অশ্লীল সিনেমা৷ ওদিকে এদের পেছনে তেমন বিনিয়োগ দরকার নেই বলে হলের সুযোগ-সুবিধার কথাও ভাবা হল না৷ ফলে মধ্যবিত্তের সাময়িক মোহ কেটে হলে ফেরার যে সুযোগ ছিল সেটা নষ্ট হল৷ আমাদের যে সমাজ কাঠামো তাতে সাংস্কৃতিক কোনো প্রবাহে মধ্যবিত্ত যুক্ত না থাকলে তাকে ধরে রাখা যায় না৷ মানুষ বা দর্শকের ভোক্তা হয়ে ওঠা বাজারের সময়ের স্বাভাবিক প্রবণতা আর মধ্যবিত্ত দর্শকশ্রেণীকে হারানোয় আবেগের লাইনটা গেল কেটে৷ তাই এখন সিনেমা নিছক পণ্য, সেই পণ্যের জন্য চাই বড় বিনিযোগ৷ ভোক্তা নেই বলে বিনিয়োগ আসে না৷ আবার বিনিয়োগ সীমিত বলে মানসম্মত কাজ হয় না৷ সব মিলিয়ে এমনই দুর্বোধ্য আর দুর্ভেদ্য চক্র যে সিনেমা তাতে হাঁসফাঁস করে মরছে৷
আর এখানেই আবার দেখি চলচ্চিত্র শিল্পের সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা৷ যে চ্যালেঞ্জে পড়েছে সঠিক বোধ আর দূরদর্শী ভাবনা দিয়ে সেখান থেকে বের করার জন্য দরকার মানসম্মত নেতৃত্ব৷ যারা সময় আর প্রয়োজনটা বুঝতেন৷ কেটে যাওয়া সুতাটাকে জোড়া দিতে পারতেন৷ কিন্তু সেই সুতা জোড়ার বদলে যে ফাঁক তৈরি হয়েছে সেই ফাঁকটাই ব্যবহৃত হচ্ছে নেতা হওয়ার সিঁড়ি হিসাবে৷ কাজ-কর্ম কমে গেছে বলে শিল্পীদের বড় একটা অংশ ভুগছেন আর্থিক অনিশ্চয়তায়, সামান্য কিছু সহায়তার সম্ভাবনা দেখিয়ে নেতা হয়ে গেছেন মোটা মাথার কিছু মানুষ৷ দুস্থ শিল্পীদের সাহায্য করা অবশ্যই একটা কাজ, মূল কাজ মোটেও নয়৷ প্রধান কাজ সিনেমাকে জাগানোর চেষ্টা করা, শিল্পের মান বাড়ানোর উদ্যোগ৷ তা হলে শিল্পীদের আর হাত পাতার জায়গায় খাকতে হবে না৷ সমস্যা হলো, জেঁকে বসা এসব নেতাদের আবার সুবিধা শিল্পীরা অসহায় আর শিল্পটা রুগ্ন থাকলেই৷ আর এজন্যই তাদের কাছে এই ভোটটাকে ইউনিয়ন পর্যায়ের ভোট আর শিল্পীদের শিল্পসত্তা ভুলিয়ে ভোটার করে রাখতে পারলেই সুবিধা৷ সেই চর্চা চলে বলেই নির্বাচনটা এমন গ্রাম্য লড়াইয়ে পৌঁছায়৷ অভিনেতারা সব নামেন পাতি নেতা হওয়ার দৌড়ে৷
এক সহকর্মীকে দেখলাম, নির্বাচন নিয়ে প্রচণ্ড উত্তেজিত৷ বারবার খোঁজ নিচেছন, ‘কী বললে নিপুণ এই বলেছে...৷' ‘আচ্ছা, জায়েদ খান জবাব দেবে কখন?'
মনে হল, বাংলা সিনেমা নিয়ে প্রচণ্ড আগ্রহী মানুষ৷ তার সঙ্গে নিশ্চয়ই কথা বলা যায় সিনেমার ভূত-ভবিষ্যৎ নিয়ে৷
তিনি অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি বাংলা সিনেমার ভক্ত কে বলল?'
‘এই যে এমন উত্তেজনা দেখাচ্ছেন৷'
‘আরে এই সময়ই তো যা মজা৷ সবাইকে একসঙ্গে দেখা যায়৷ সিনেমার মতোই ডায়লগ, হুংকার...৷ আগে পর্দায় যা দেখতাম, এখন বাস্তবে দেখি৷'
‘নতুন সভাপতি হলেন, নিশ্চয়ই একটা বদল আশা করা যায়৷ সিনেমার প্রতি মনযোগ হয়তো বাড়বে৷'
‘আমার ভাই ওসবে কোনো আগ্রহ নেই৷ এক বছর পর আবার আরেকটা সিনেমা হবে৷ যাই বলো, এরা সারা বছরের বিনোদনের অভাব এক নির্বাচন দিয়ে পুষিয়ে দেয়৷'
ভাবলাম৷ ভেবে আরও দ্বিধান্বিত হযে গেলাম৷ আমরা সারা বছর তাদের ভুলে থাকি বলেই তারা নির্বাচনের সময় নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে এমন মরিয়া হয়ে হাজির হন নাকি তারা শুধু নির্বাচন আর নেতৃত্ব নিয়ে মেতে থাকেন বলে বাকি বছর আসল কাজ, মানে সিনেমা-অভিনয় দিয়ে আমাদের টানার সময় করে উঠতে পারেন না!
ঢাকাই চলচ্চিত্রের একাল-সেকাল
এক সময় বাংলাদেশে মধ্যবিত্তের বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম ছিল চলচ্চিত্র, যাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে হাজারো হল, রমরমা শিল্প৷ সময়ের পরিক্রমায় ঢাকাই সিনেমা পর্দার বাইরের কাহিনিতেই বেশি আলোচিত৷
ছবি: Rajib Paul
স্বর্ণ যুগ
বাংলাপিডিয়ার তথ্য অনুযায়ী, বিশ শতকের ৯০-এর দশকে প্রতিবছর গড়ে ৮০টির মতো পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে বাংলাদেশে৷ বিশাল অঙ্কের পুঁজি লগ্নি হতো তখন এই শিল্পে৷ পনেরশোটির মতো প্রেক্ষাগৃহে ১০ লাখেরও বেশি দর্শক ছবি দেখতেন প্রতিদিন৷ চলচ্চিত্রকে কেন্দ্র করে রমরমা ছিল সংগীতসহ অন্যান্য শিল্পও৷
ছবি: Colourbox
চলচ্চিত্র মুক্তি
বাংলাদেশে চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৬ সালে, একটি ছবি মুক্তির মধ্য দিয়ে৷ ষাটের দশকে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২০টিতে, যা ৯০-এর দশকে গড়ে প্রায় ৮০টিতে উন্নীত হয়৷ কোনো কোন বছর ১২০টিরও বেশি সিনেমা নির্মাণ হতো৷ ২০২১ সালে সেখানে মুক্তি পেয়েছে মোটে ৩০টি৷
ছবি: bdnews24
ব্যবসাসফল ছবি
বাংলাদেশে সিনেমা কত ব্যবসা করে তার নির্ভরযোগ্য তথ্য নেই৷ ১৯৮৯ সালে নির্মীত ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ সবচেয়ে ব্যবসাসফল বলে ধারণা করা হয়, যা আনুমানিক ২০ কোটি টাকা আয় করে৷ নব্বই দশকে সালমান শাহ অভিনীত কয়েকটি চলচ্চিত্র ১০ কোটি বা তার কাছাকাছি পৌঁছে৷ দীর্ঘ মন্দার পর ২০০৯ সালে মনপুরা সেই পর্যায়ে যায়৷ এরপর আয়নাবাজিসহ বেশ কয়েকটি সিনেমা সুপারহিট হলেও কোনটিই এত আয় করতে পারেনি বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: imdb.com
বিতর্কিত যুগ
২০০০ সালের পর থেকে ঢাকার চলচ্চিত্রের দুর্দশা ঘনিয়ে আসে৷ কমতে থাকে চলচ্চিত্র মুক্তির সংখ্যা৷ গল্পের প্রয়োজন ছাড়াই যৌন উত্তেজক দৃশ্যের ছড়াছড়ি, এমনকি হলে প্রদর্শনীর সময় ‘কাটপিছ’ দৃশ্য জুড়ে দেয়া হতো৷ এই সময়ে শুরু হয় পাইরেসির প্রকোপও৷ চলচ্চিত্র ব্যবসায় নামে ধস৷ বন্ধ হতে থাকে হলগুলো৷ ২০০৭ সালে সরকার টাস্কফোর্স করে এ ধরনের সিনেমার বিরুদ্ধে অভিযানে নামে৷
ছবি: DW/M. Mamun
সিনেমা হল
একটা সময়ে দেশের প্রতিটি শহরে একাধিক সিনেমা হল ছিল৷ হলে গিয়ে সিনেমা উপভোগ মানুষের বিনোদনের প্রধান অনুষজ্ঞ ছিল৷ বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির হিসাবে ১৯৯৮ সালে এক হাজার ২৩৫টির মতো সিনেমা হল ছিল দেশে৷ পরবর্তী দুই যুগে কমতে কমতে হলের সংখ্যা ঠেকেছে ১২০টিতে৷ তবে চালু আছে ৬০টির মতো৷
ছবি: DW/M. Mamun
আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ
২০০০ সালের পর ঢাকায় আধুনিক প্রেক্ষাগৃহ চালু হয়৷ বর্তমানে ঢাকায় বেশ কয়েকটি আধুনিক মাল্টিপ্লেক্স চালু থাকলেও রাজধানীর বাইরে বিভিন্ন শহরেও এখন নির্মাণ হচ্ছে মাল্টিপ্লেক্স৷ তবে তাতে ঢাকাই চলচ্চিত্রের কতটা সুবিধা হবে সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে৷ বিদ্যমান মাল্টিপ্লেক্সগুলোতে মূলত বিদেশি চলচ্চিত্রেরই আধিপত্য৷ এই লেখার সময় স্টার সিনেপ্লেক্সে প্রদর্শনীর তালিকায় থাকা ছয়টি চলচ্চিত্রের চারটিই ছিল বিদেশি৷
ছবি: DW/M. Mamun
বিদেশ পাড়ি
বাংলাদেশের এক সময়কার জনপ্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রীদের অনেকেই চলচ্চিত্র ছেড়ে পাড়ি জমিয়েছেন বিদেশে৷ ২০০০ সালের পর থেকে ঢাকাই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে ব্যবসাসফল ছবির নায়ক শাকিব খান৷ গত বছর তিনি যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ডের আবেদন করেন বলে সংবাদ মাধ্যমে খবর বের হয়৷ শাকিব খান অবশ্য পরে জানিয়েছেন, তিনি দেশটিতে স্থায়ীভাবে বসবাসের পরিকল্পনা করেননি৷
ছবি: Sazzad Hossain
নির্বাচন হাঙ্গামা
চলচ্চিত্র দুর্দশায় থাকলেও সম্প্রতি চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতির নির্বাচন সারা দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে৷ ভোটের আগে থেকে শুরু করে ভোটের পরেও এই নির্বাচন ঘিরে বিতর্ক চলেছে, যা শেষ পর্যন্ত আদালতেও গড়িয়েছে৷