1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অস্তিত্ব রক্ষার ম্যাচে মহম্মদ সেলিম

গৌতম হোড় মুর্শিদাবাদ | স্যমন্তক ঘোষ মুর্শিদাবাদ
২৯ এপ্রিল ২০২৪

যে ভয়ংকর গরমে মানুষের পাগল পাগল অবস্থা, সেখানে রোদের মধ্যে সমানে প্রচার চলছে মহম্মদ সেলিমের।

মহম্মদ সেলিমকে স্বাগত জানাচ্ছেন এক নারী।
মুর্শিদাবাদে সেলিমের প্রচার চলছে। ছবি: Goutam Hore/DW

তখন মধ্যদুপুর। মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ায় গ্রামের রাস্তায় ৪৩ ডিগ্রি ছুঁই ছুঁই গরমে একটা খোলা জিপের উপর দাঁড়িয়ে সিপিএমের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। মাথায় টুপি। গলায় একটা সাদা গামছা। চারপাশ থেকে হুহু করে ছুটে আসছে গরম হাওয়া। তার হলকা লাগছে গায়ে। রোদ্দুর লাগলে মনে হচ্ছে চামড়া ঝলসে যাবে। তার মধ্যে সিপিএমের এই পোড় খাওয়া রাজনীতিক ঘুরছেন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। সেই প্রচারে তারস্বরে বাংলা ব্যান্ডের একটি জনপ্রিয় গানের সুরে তৈরি করা এখানে সিপিএমের থিম সং বাজছে, ‘এই মুর্শিদাবাদে সেলিমকে চাই।‘

জিপ থেকে হাত নাড়ছেন। মানুষ এগিয়ে এলে হাত মেলাচ্ছেন। একটু বেশি ভিড় থাকলে নেমে পড়ছেন জিপ থেকে। সোজা চলে যাচ্ছেন গ্রামবাসীদের কাছে। তাদের বলছেন, ভোটটা দেবেন কিন্তু। কখনো হাত ধরছেন মানুষের। জিজ্ঞাসা করছেন, তারা কেমন আছেন।

সেলিমের সঙ্গে আছে খুব অল্প কয়েকটা গাড়ি। আর আছেন সিপিএম ও কংগ্রেস কর্মীরা। কেউ বাইকে, কেউ হেঁটে চলছেন। প্রথমে য়খন সেলিমের প্রচার শুরু হয়েছিল, তখন সংখ্যাটা কম ছিল। ক্রমশ তা আড়ে-বহরে বেড়েছে। কয়েকশ মানুষ পতাকা নিয়ে যোগ দিয়েছেন সেই রোড শোতে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারে।

এই জিপে করে প্রচার করছেন সেলিম। জিপের সামনে সিপিএম ও কংগ্রেসের পতাকা। ছবি: Goutam Hore/DW

গাড়ি থামলো একটি গ্রামে। নাম ডেঙ্গাপাড়া। সেলিম জিপ থেকে নামলেন। চশমা খুলে গামছা দিয়ে আগে খুব ভালো করে ঘাম মুছলেন। তারপর একটি বাড়িতে ঢুকে মুখেচোখে ভালো করে জল দিলেন। শুরু হলো বাড়ির মানুষদের সঙ্গে ফটো সেশন, এখনকার প্রচারে যা অত্যন্ত করতেই হয় প্রত্যেক প্রার্থীকে।

মাঝখানে সেলিম জিপ ছেড়ে একটা বোলেরো গাড়িতে উঠেছিলেন। তবে এসি চালাননি। জানলা খোলা রেখে হাত নাড়ছিলেন, হাত মেলাচ্ছিলেন মানুষের সঙ্গে। গাড়িতে এসি কেন চালাচ্ছেন না? সেলিমকে প্রশ্ন করতেই জবাব এলো, ‘'আমার অভ্যাস আছে। অনেকদিন ধরে করছি। আমি ভাবছি, দলের কর্মীদের কথা। তারা যেন অসুস্থ না হয়ে পড়ে।আমি এসি-তে থাকব, আর কর্মীরা, মানুষ বাইরের রোদে থাকবেন, তা হয় নাকি?‘'

সেলিম যে জিপে করে ঘুরছেন, তার একদিকে কাস্তে-হাতুড়ির লাল পতাকা, অন্যদিকে কংগ্রেসের তিনরঙা হাত পতাকা। বাইকে করে যে য়ুবকরা আসছেন সেখানেও কংগ্রেসের ও সিপিএমের পতাকা একসঙ্গে শোভা পাচ্ছে। সিপিএম বা কংগ্রেসের যে কর্মীরা প্রচারে যাচ্ছেন, তাদের হাতেও দুই দলের পতাকা রয়েছে। যে ৩৪ বছর সিপিএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট পশ্চিমবঙ্গ শাসন করেছে, সেখানে প্রধান বিরোধী দল ছিল কংগ্রেস। সেসময় কংগ্রেস সমানে সিপিএমের বিরুদ্ধে গুণ্ডাগিরি, তাদের কর্মীদের হত্যা করা, অত্যাচার করার অভিযোগ করেছে। এই মুর্শিদাবাদেও সিপিএমের হাতে কতজন কংগ্রেসি খুন হয়েছে, তার তালিকা দিয়েছিলেন অধীর চৌধুরী। ফেসবুকে সে তালিকাও ঘুরছে। কিন্তু জীবনের মতো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতি বদলায়। শত্রু বন্ধু হয়ে যায় এবং বন্ধু শত্রু হয়। এখানে কোনো স্থায়ী শত্রু বা বন্ধু নেই। ক্ষমতা ও পরিবর্তন দুটোরই হাতবদল হয়। এটাই বাস্তব। তাই জয়ের কৌশল ঠিক করার তাগিদটাই সেখানে সব।

প্রচারের মধ্য়ে একটি শিশুকে আদর করছেন মহম্মদ সেলিম। ছবি: Goutam Hore/DW

পরে বহরমপুরে দলীয় অফিসে বসে অধীর চৌধুরী বলছিলেন, ‘‘যে সিপিএম নেতারা অত্যাচার করত, তারা তো এখন তৃণমূলে আছে।‘' আর গ্রামে একটি বাড়িতে ঢুকে মধ্যাহ্নভোজে শেষ করে সেলিম বললেন, ‘‘এটা হলো কংগ্রেস নেতার বাড়ি। কংগ্রেস ও সিপিএম হাতে হাত মিলিয়ে এখানে ভোটে লড়ছে। দুই দলের কর্মীরা পুরো মিশে গেছেন।‘'

কোনো সন্দেহ নেই, দুই দলের নিচুতলার কর্মীরা মিশে গেছেন। অনেকদিন পর মুর্শিদাবাদে সিপিএম কর্মী ও সমর্থকরা চাঙ্গা হয়ে কাজ করছেন, মানুষের কাছে যাচ্ছেন। জোরগলায় বলছেন,‘‘আমি সিপিএম করি।‘‘ যেমন বললেন মহম্মদপুরের বয়স্ক মানুষটি। সেখানে তৃণমূল প্রার্থী ইরফান পাঠানের প্রচার শেষ হয়েছে। বাইরে অনেকে ভিড় করে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজেদের মধ্যে কথা হচ্ছিল। গিয়ে দাঁড়াতেই তারা বললেন, ''আপনারা তো ঘুরছেন। বলুন তো কে জিতবেন?' তারপর তারাই জানাতে লাগলেন তাদের মত। সেই সময় ওই বয়স্ক মানুষটি জোরগলায় বললেন, ‘‘আমি সিপিএম করি। আপনাকে বলছি, মহম্মদ সেলিম এবার জিতবেনই। দেখে নেবেন।‘‘ 

আর রোড শো ও গাড়িতে করে প্রচারের মধ্য সেলিম বললেন, ‘'দেখছেন তো দুই দলের কর্মীরা কতটা উৎসাহ নিয়ে নেমে পড়েছেন ভোটের কাজে।‚' কোনো সন্দেহ নেই, কংগ্রেসের ভরসাতেই অধীর রঞ্জন চৌধুরীর খাসতালুকে এসে ভোটে লড়ছেন সেলিম। মুর্শিদাবাদে অধীরের পুরো সংগঠন সেলিমকে সাহায্য করছে। আবার বহরমপুরে সিপিএমের কর্মী-সমর্থকরা অধীরকে জেতাতে ঝাঁপিয়েছেন। দিবে আর নিবে আর কী। দুজনেই তো এবার তাদের অস্তিত্বরক্ষার লড়াইয়ে নেমেছেন। দুজনেই একে অপরকে ভোট পাওয়ার কাজে যতটা পারছেন সাহায্য করছেন। 

প্রচারে সেলফি-পর্ব চলছে। ছবি: Goutam Hore/DW

মধ্যদুপুরে এগিয়ে চললো সেলিমের গাড়ি। গ্রামের রাস্তার ভিতর দিয়ে। একদিকে বাঁশবাগান, অন্যদিকে সবুজ পুকুর। রাস্তায় নেমে এসেন গৃহবধূরা, অলস দুপুরে সেলিমকে দেখতে এলেন পুরুষরাও। মাঝখানে একজায়গায় ভিড় দেখে সেলিম নামলেন। পথের পাশে সিমেন্টের রকে বসে পড়লেন। একটা বাচ্চাকে কোলে তুলে নিলেন। কিছু মানুষ গাঁদা ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তাদের বললেন, এই দিকে আসুন। পাশে তখন গ্লুকন ডি জলে গোলা হচ্ছে। তার দিকে আঙুল দেখিয়ে সেলিম বললেন, জলে ফুল পড়ে যাবে। এদিকে দিন। নিজের ও কর্মীদের খেয়াল তো রাখতেই হবে সাধারণ সম্পাদককে।

এই মুর্শিদাবাদ তার জায়গা নয়। কিন্তু সেলিম লড়ছেন। ঢুকে যাচ্ছেন মানুষের বাড়িতে। ক্লান্তিহীনভাবে ছবি তুলছেন। নিজেকে দলের ও কংগ্রেস কর্মীদের হাতে সঁপে দিয়েছেন। বললেন, আমি জানি না, কোন দিকে যাব। ওরাই সব ঠিক করছে। এদের কথামতোই চলছি। তবে মাঝখানে সেই কর্মীদের কথাও শুনলেন না তিনি। তার গাড়ি গ্রামে পৌঁছাবার পর কর্মীরা বললেন. অনেক বেলা হয়ে গেছে। এবার মধ্যাহ্নভোজটা সেরে ফেলুন। সেলিম বললেন ‘'না। এতজন কর্মী ও সাধারণ মানুষ অপেক্ষা করছেন। আমি আগে তাদের সহ্গে দেখা করব। আবার পুরো গ্রাম ঘুরলেন। তারপর গেলেন খেতে।‘'

বিকেল পাঁচটা নাগাদ শুরু হলো জনসভা। সেখানে অধীর রঞ্জন চৌধুরীও এলেন। সেলিম-অধীর পরপর ভাষণ দিলেন। সামনের মাঠে তখন কয়েক হাজার মানুষ। দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, প্রয়োজনীয়তা, জয়ের অংক, তৃণমূল ও বিজেপি-র মতো শক্তিশালী দুই বিপক্ষের মোকাবিলা করার জন্য, একদা দশকের পর দশক শাসন করা পশ্চিমবঙ্গে অন্তত একটি লোকসভা আসনে জিতে খাতা খোলার জন্য কত পরিবর্তনই না করতে হয়।

রাজনীতি এরকমই। আর সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক বুঝিয়ে দিচ্ছেন, তিনি লড়াইয়ে আছেন। ভালোভাবেই আছেন।     

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ