ব্যাক্টিরিয়া মোকাবিলায় বিজ্ঞানীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছেন৷ কিন্তু অ্যান্টিবায়োটিকের বদলে ব্যাক্টিরিয়ার প্রতিরোধ ক্ষমতা অকেজো করে দিলে কেমন হয়? জার্মান বিজ্ঞানীরা ঠিক এই দিশায় কাজ করছেন৷
বিজ্ঞাপন
ছত্রাক অবশ্যই রয়েছে৷ কিন্তু রসায়নবিদ স্টেফান সিবার তা থেকে আশ্চর্য কোনো অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির সম্ভাবনায় আর বিশ্বাস করেন না৷ কারণ জীবাণু বার বার মাশরুম থেকে নিঃসারিত পদার্থ শনাক্ত করে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে৷ মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেফান সিবার বলেন, ‘‘আমরা ছত্রাকের মধ্যে কোনো পদার্থ খুঁজছি না, বরং একেবারে নতুন পথে এগোচ্ছি৷ প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিকের বাইরে একেবারে নতুন রাসায়নিক অ্যাক্টিভ এজেন্টের খোঁজ করছি৷''
ছত্রাক, ভাইরাস ও ব্যাকটিরিয়া সম্পর্কে যেগুলো জানা জরুরি
বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ছিল খাদ্য নিরাপত্তা৷ তাহলে দেখা যাক আমাদের খাদ্যে অনুজীবের ভূমিকা কি? ছত্রাক, ভাইরাস, ব্যাকটিরিয়া আপনার খাবারকে যেমন নষ্ট করতে পারে, তেমনি এদের কিছু উপকারিতাও আছে৷
ছবি: imago/Gerhard Leber
ওহ!
এই ছত্রাক দেখে কি মুখ ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছে করছে? তবে এ ধরনের ছত্রাকে ভরা স্যান্ডইউচ কিন্তু ক্ষতিকারক নয়৷ কিছু ছত্রাক বিষাক্ত না হলেও ক্যামেমবার্ট পনিরের মতো অনেক ছত্রাকই ক্ষতিকর৷ ভয়াবহ বিষাক্ত ছত্রাকের সংস্পর্শে এলে মানুষের দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়, এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে৷
ছবি: imago/imagebroker
অনুঘটক হিসেবে ছত্রাক
ছত্রাক অনেক ক্ষেত্রে কার্যকরী৷ অন্য কোনো অনুজীবের তুলনায় ছত্রাক কার্বন হাইড্রেটটস, চর্বি ও আমিষকে দ্রুত ভেঙে ফেলতে পারে৷ বিভিন্ন শিল্পকারখানায় খাবার প্রক্রিয়াকরণ ও ডিটারজেন্ট তৈরিতে এনজাইম হিসেবে ব্যবহৃত হয় এসব ছত্রাক৷
ছবি: BASF
সালামি
সসেজ তৈরির পদ্ধতিতে যদি কোনোরকম ভুল হয় বা মাংস ও সবজি রক্ষণাবেক্ষণের সময় পচন ধরে তাহলে খাবার বিষাক্ত হয়ে যায়৷ ঐ ব্যাকটিরিয়া এমন এক বিষে পরিণত হয় যা জীবননাশক হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অক্সিজেন ছাড়া জীবন
অক্সিজেন না পেলে অর্থাৎ সেরকম পরিবেশে ক্লসট্রিডিয়াম বটুলিনাম ব্যাকটিরিয়া মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে৷ এই ব্যাকটিরিয়া কসমেটিক সার্জারির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ, কেননা ত্বককে মসৃণ করার স্নায়ু এজেন্ট বোটক্স তৈরি হয় এ থেকে৷ কিন্তু খাদ্যে যদি এটি উৎপন্ন হয়, সেটা খেলে মানুষ প্যারালাইজড বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতে পারে৷ প্রথমে শরীরের কিছু অংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়, তারপর ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যায় মানুষ৷
ছবি: picture alliance/OKAPIA
তাজা শাকসবজি সবসময় ভালো নয়
২০১১ সাল পর্যন্ত মেথি’র অঙ্কুর জার্মানদের কাছে স্বাস্থ্যকর খাবার হিসেবে পরিচিত ছিল৷ সে বছর বীজ থেকে ছড়িয়ে পড়া মহামারি ইকোলি ব্যাকটিরিয়ায় মারা যায় ৫৩ জন, অসুস্থ হয়ে পড়ে কয়েক শত৷ এই ব্যাকটিরিয়া অন্ত্রের দেয়ালকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, পরে মস্তিষ্ককে আক্রান্ত করে৷ তাই সবজি ও মাংস রান্না করে খেলে এই ব্যাকটিরিয়াগুলো মরে যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
ভালো ব্যাকটিরিয়া
তবে সবধরনের ইকোলি ব্যাকটিরিয়া ক্ষতিকর নয়৷ মানবদেহের বৃহদন্ত্রে এ ধরনের ব্যাকটিরিয়া ‘ভিটামিন কে’ তৈরি করে, যা হাড়, কোষ ও রক্তের জন্য খুব উপকারি৷ এছাড়া ইনসুলিন ও গ্রোথ হরমোন তৈরিতে এই ব্যাকটিরিয়া ব্যবহৃত হয়৷
ছবি: Harvard’s Wyss Institute
খাদ্য সংরক্ষণে ব্যবহার
দই, পনির এসব দুগ্ধজাত পণ্য তৈরির জন্য দরকার হয় ব্যাকটিরিয়া৷ হাজার হাজার বছর ধরে ল্যাকটিক এসিড ব্যাকটিরিয়া এসব দ্রব্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হচ্ছে৷
ছবি: ZDF
ভয়াবহ ডায়রিয়ার কারণ
ক্যামপিলোব্যাকটার এবং স্যালমোনেলি দেখতে রডের মতো৷ এসব ব্যাকটিরিয়ার কারণে অসুস্থতা এবং মৃত্যু দুটোই হতে পারে৷ কম রান্না করা গরু, শুকর ও মুরগীর মাংসে এ ধরনের ব্যাকটিরিয়া জন্ম নেয়৷ এটি খাবার পর পাতলা পায়খানা শুরু হয়৷
খাদ্যে পচন
নরোভাইরাস বা পাকস্থলীর ফ্লু বমি এবং মলের মাধ্যমে মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ে৷ মাত্র ১০০টা অতিক্ষুদ্র ভাইরাস মানুষের দেহে সংক্রমণের জন্য যথেষ্ট৷
ছবি: Foto: Gudrun Holland/Robert-Koch-Institut
9 ছবি1 | 9
বিজ্ঞানীরা জানতে চান, ঠিক কোন বিষয়টি জীবাণুকে এত বিপজ্জনক করে তোলে৷ ব্যাক্টিরিয়ার বিষাক্ত পদার্থ ও টক্সিন মানুষকে অসুস্থ করে তোলে৷ চাপের মুখে পড়লে ব্যাক্টিরিয়া বিশেষভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে৷ মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টেফান সিবার বলেন, ‘‘ব্যাক্টিরিয়া মেরে ফেললে তারা সব রকম পথের খোঁজ করে৷ তাকেই প্রতিরোধ বলা হয়, তখন তাদের আর মারা যায় না৷ এই অবস্থায় আপনিও ঠিক তাই করতেন৷ চাপের মুখে পড়লে আপনিও নতুন পথের খোঁজ করতেন৷ আমাদের চেষ্টা হলো, ব্যাক্টিরিয়া যাতে অ্যাক্টিভ এজেন্ট, টক্সিন তৈরি করতেই না পারে, তা নিশ্চিত করা৷''
নতুন এই প্রচেষ্টার মূলে রয়েছে এক প্রোটিন৷ এই প্রোটিন ব্যাক্টিরিয়ার মধ্যে বিষ তৈরির প্রক্রিয়া শুরু করে৷ সিবার-এর টিম এমন এক পদার্থ খুঁজে পেয়েছে, যা সেই প্রোটিনকে বাধা দেয় এবং ব্যাক্টিরিয়াকে বিষ সৃষ্টি করতে দেয় না৷ গবেষকরা ল্যাবে ইঁদুরের উপর এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করেছেন৷ স্টেফান সিবার বলেন, ‘‘উপরের ইঁদুরটি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠেছে৷ কারণ ব্যাক্টিরিয়ার অস্ত্র দ্রুত কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ ফলে আমাদের মতে, ইমিউন সিস্টেম ধীরে ধীরে ব্যাক্টিরিয়া দূর করেছে৷ ফোড়াকে বড়ই হতে দেওয়া হয় নি৷ অন্যদিকে যে ইঁদুরটির চিকিৎসা হয় নি, সেটি তার ফোড়া মোকাবিলা করার ক্ষমতা না থাকায় মারা যেতে পারে৷''
যেগুলো ‘টয়লেট সিট’-এর চেয়েও নোংরা
আপনি হয়ত ভাবছেন ‘টয়লেট সিট’ এই সবচেয়ে বেশি ব্যাকটেরিয়ার বাস৷ কিন্তু গবেষণা বলছে অন্য কথা৷ ছবিঘরে থাকছে বিস্তারিত৷
ছবি: Colourbox
মোবাইল ফোন ও ট্যাবলেট
ব্রিটিশ ওয়াচডগ ‘হুইচ?’ ২০১৩ সালে ৩০টি ট্যাবলেট, ৩০টি মোবাইল ফোন এবং ৩০টি টয়লেট সিট পরীক্ষা করে দেখেছে, ট্যাবলেট আর মোবাইল ফোনে টয়লেট সিটের তুলনায় অনেক বেশি জীবাণু পাওয়া গেছে৷ ট্যাবলেটে পাওয়া ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ ছিল ৬০০ ইউনিট আর মোবাইল ফোনে ১৪০ ইউনিট৷ অন্যদিকে, টয়লেট সিটে ২০ ইউনিটেরও কম ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে৷
ছবি: Robert Kneschke - Fotolia.com
পানির কল
বাথরুমে থাকা পানির কলে টয়লেট সিটের তুলনায় ২১ গুণ বেশি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে৷ আর রান্নাঘরের পানির কলেতো সেই সংখ্যা আরও বেশি, প্রায় ৪৪ গুণ! সুতরাং সবসময় বেসিন পরিষ্কার রাখুন, প্রয়োজনে জীবাণুনাশক ব্যবহার করুন৷
ছবি: CWindemuth/Fotolia
হাতব্যাগ
ব্রিটিশ কোম্পানি ‘ইনিশিয়াল ওয়াশরুম হাইজিন’-এর গবেষণায় দেখা গেছে নারীদের ব্যবহৃত হাতব্যাগ নাকি টয়লেট সিটের চেয়েও বেশি ব্যাকটেরিয়া থাকে! গড়পড়তা একটি ব্যাগে টয়লেট সিটের চেয়ে তিনগুণ বেশি ব্যাকটেরিয়া থাকে৷ আর যে ব্যাগ নিয়মিত ব্যবহার করা হয় সেখানে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ প্রায় ১০ গুণ বেশি থাকে৷
ছবি: Ruslan Kudrin - Fotolia.com
লিফটের বোতাম
ক্যানাডার টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় লিফটের বোতামে টয়লেট সিটের চেয়েও বেশি ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে৷ সৌদি আরবে করা আরেক গবেষণায়ও একই ফল পাওয়া গেছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
কম্পিউটার গেমস কন্ট্রোলার
ইউনিসেফ ও ডোমেসটস-এর উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, কম্পিউটার গেমস কন্ট্রোলারে টয়লেট সিটের তুলনায় পাঁচগুণ বেশি ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে৷ টয়লেট সিটের প্রতি ১০০ বর্গসেন্টিমিটারে যেখানে গড়ে প্রায় ১,৬০০ জীবাণু থাকে, কন্ট্রোলারে সেই সংখ্যাটা প্রায় ৭,৮৬৩৷
বাসার সোফাটি নিয়মিত পরিষ্কার করা প্রয়োজন৷ কেননা সোফার হাতলে টয়লেট সিটের চেয়ে প্রায় ১২ গুণ বেশি জীবাণুর সন্ধান পেয়েছেন গবেষকরা৷
ছবি: Photographee.eu - Fotolia
বাচ্চাদের খেলনা
বাচ্চাদের খেলনা অবশ্য রেফ্রিজারেটর আর গেমস কন্ট্রোলারের চেয়ে পরিষ্কার৷ তারপরও সেখানে টয়লেট সিটের চেয়ে দ্বিগুণ বেশি জীবাণু শনাক্ত করেছেন গবেষকরা৷
ছবি: Colourbox
8 ছবি1 | 8
এই প্রক্রিয়া সফল হয়েছে৷ কিন্তু প্রশ্ন হলো, ব্যাক্টিরিয়া কি অ্যান্টিবায়োটিকের মতো এ ক্ষেত্রেও প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শিখে যাবে? স্টেফান সিবার বলেন, ‘‘এখানে আমরা সহজে সেই সব ব্যাক্টিরিয়া দেখাচ্ছি, অ্যান্টিবায়োটিক যেগুলিকে দূর করে৷ লাল দাগ দিয়ে তা চিহ্নিত করছি৷ এমনও হতে পারে, যে এদের মধ্যে একটি ব্যাক্টিরিয়া স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধের মাধ্যমে বেঁচে গেল৷ তখন সেটি বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পারে৷ ব্যাক্টিরিয়ার সেই নতুন ঝাঁক আগের মতোই বিষ উগরে দেবে, সংক্রমণ ঘটাবে৷ আমাদের কৌশল কাজে লাগিয়ে আমরা প্রতিরোধ শক্তি অকেজো করে দিয়েছি৷ শুধু থেকেই ব্যাক্টিরিয়ার উপর একটা স্তর দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে, যাতে বিষাক্ত পদার্থ সৃষ্টি করা সম্ভব না হয়৷ তখন অ্যান্টিবায়োটিকের মতো রেজিস্টেন্স গড়ে উঠবে না৷''
নতুন অ্যান্টিবায়োটিক পাবার আশা না করলেও স্টেফান সিবার জঙ্গলে ছত্রাক খুঁজে চলেছেন৷ স্টেফান সিবার বলেন, ‘‘আমি ল্যাবের জন্য ছত্রাক খুঁজছি না৷ রান্নাঘরের জন্য খুঁজছি, কারণ তার দারুণ স্বাদ৷''
স্টেফান সিবার-এর আশা, ব্যাক্টিরিয়া মোকাবিলায় তাঁর প্রক্রিয়া হয়তো ১০ বছরেই রোগীদের সাহায্য করতে পারে৷