এমনকি বেশ্যালয়ের মালিকানাকে বৈধ করার সপক্ষে মতপ্রকাশ করেছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যদিও এর ফলে মানবাধিকার সংস্থাটিকে বিপুল সমালোচনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
যৌন ব্যবসাকে পুরোপুরি ‘ডিক্রিমিনালাইজ' করা, অর্থাৎ অপরাধ হিসেবে গণ্য না করার সপক্ষে অ্যামনেস্টি৷ মঙ্গলবার ডাবলিনের ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল মিটিং-এ ৭০টি দেশ থেকে আগত ৪০০ প্রতিনিধির এক সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ দৃশ্যত প্রস্তাবটি সমর্থন করেন, যদিও ভোটাভুটির কোনো খুঁটিনাটি দেওয়া হয়নি৷
অ্যামনেস্টি বিভিন্ন যৌনকর্মী সংগঠন ও গোষ্ঠী, এইচআইভি/এইডস ত্রাণকর্মী এবং মানুষ পাচার বিরোধী গোষ্ঠীর সঙ্গে দু'বছর ধরে কথাবার্তা বলার পর এই সিদ্ধান্তে আসে যে, যৌনকর্মীদের মানবাধিকার রক্ষার শ্রেষ্ঠ পন্থা হলো দালালি ও বেশ্যালয়ের মালিকানা সহ সব ধরনের যৌন পরিষেবাকে বৈধ ঘোষণা করা৷ এর ফলে যৌনকর্মীদের মারধোর, যৌন নির্যাতন, অকারণে গ্রেপ্তার, ব্ল্যাকমেল, নারী পাচার ও জোর করে এইডস পরীক্ষার ঘটনা কমবে, বলে অ্যামনেস্টির ধারণা৷ কাজেই মঙ্গলবার অ্যামনেস্টির মহাসচিব সলিল শেট্টি একটি ‘‘ঐতিহাসিক দিনের'' কথা বলেন৷
তবে ডাবলিনের এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার আগে থেকেই অ্যামনেস্টির অভিপ্রায় জ্ঞাত ছিল এবং অপরাপর বহু নারী অধিকার গোষ্ঠী সমালেচনায় মুখর হয়ে উঠেছিল৷ যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ‘কোয়েলিশন এগেইনস্ট ট্র্যাফিকিং ইন উইমেন' বা নারী পাচার বিরোধী জোটের কার্যনির্বাহী পরিচালক তাইনা বিয়্যাঁ-এইম-এর মতে যৌনকর্ম সংক্রান্ত যাবতীয় কার্যকলাপ অপরাধের তালিকা থেকে অপসারণ করার অর্থ, দালালদের ‘‘বিজনেসমেন''-এ পরিণত করা, যা-তে তারা নির্বিচারে অসহায়দের ‘‘বেচতে'' পারে৷
ডাবলিনের ভোটের আগেই নারী পাচার বিরোধী জোট একটি খোলাচিঠিতে সাবধান করে দিয়েছিল যে, এর ফলে অ্যামনেস্টির ভাবমূর্তি ‘‘বিশেষভাবে মলিন'' হবে৷ সিএটিডাব্লিউ-এর অনলাইন পিটিশনে ইতিমধ্যেই হাজার হাজার স্বাক্ষর পড়েছে৷ যারা স্বাক্ষর করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন মেরিল স্ট্রিপ, কেট উইন্সলেট এবং এমা থমসন-এর মতো হলিউড তারকা৷
নারী অধিকার গোষ্ঠী ‘ইকোয়ালিটি নাউ'-এর নারী পাচার বিরোধী কর্মসূচির পরিচালক এশোহে আঘাটিসে বলেছেন: ‘‘বাণিজ্যিক যৌনসম্ভোগের চাহিদা বাড়ার ফলেই নারী পাচার বাড়ে৷ তখন হঠাৎ নীতি বদলে বলতে পারো না যে, যারা সেই চাহিদা বাড়াচ্ছে, চলো তাদেরই সুরক্ষা দেওয়া যাক৷'' তাইনা বিয়্যাঁ-এইম-ও বলেছিলেন: শোষিতদের রক্ষা করার জন্য শোষণকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার কোনো যুক্তি থাকতে পারে না৷ অপরদিকে অ্যামনেস্টি বলছে, ‘ফোর্সড লেবার' বা বেগার খাটানো কিংবা যৌন শোষণের জন্য নারী পাচার ইত্যাদি ব্যাপারে তাদের অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি৷
বিষয়টি এমনই বিতর্কিত যে, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন আইনকানুন চালু রয়েছে৷ আইসল্যান্ড, সুইডেন এবং নরওয়েতে যৌনকর্মীদের পরিবর্তে তাদের গ্রাহকদেরই অপরাধী হিসেবে দেখা হয় – সম্প্রতি ফ্রান্সও যে পন্থা অবলম্বন করার চেষ্টা করছে৷ ইউরোপের বহু দেশে পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ৷ অপরদিকে অস্ট্রিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড এবং আরো কয়েকটি দেশে তা সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রিত৷
বাংলাদেশের যৌনকর্মীদের কথা
পৃথিবীর আদিম এক পেশা পতিতাবৃত্তি৷ বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই চালু রয়েছে এই পেশা৷ বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়৷ কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেমন আছেন বাংলাদেশের যৌনকর্মীরা? এই ছবিঘরে তাঁদের অবস্থা কিছুটা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে৷
ছবি: Getty Images
যেভাবে যৌনপল্লীতে আগমন
বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার হয়ে যৌনপল্লীতে হাজির হন মেয়েরা৷ প্রত্যন্ত অঞ্চলের অতিদরিদ্র্য পরিবারের সদস্যরা কখনো কখনো অর্থের লোভে মেয়েদের বিক্রি করে দেন বলে জানিয়েছে একাধিক আন্তর্জাতিক বার্তাসংস্থা৷ এছাড়া ভালোবাসার ফাঁদে ফেলে কিংবা বিদেশ যাওয়ার লোভ দেখিয়েও মেয়েদের যৌনপল্লীতে আনা হয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/Munir uz ZAMAN
যৌনকর্মীদের জন্য ‘গরুর ট্যাবলেট’
ফরিদপুরের সরকার অনুমোদিত যৌনপল্লীর ছবি এটি৷ অভিযোগ রয়েছে, পল্লীর মালিক নতুন আসা যৌনকর্মীদের স্টেরয়েড ট্যাবলেট সেবনে বাধ্য করেন, যা সাধারণত গরুকে খাওয়ানো হয়৷ গরুর স্বাস্থ্য বাড়াতে ব্যবহার করা এই ট্যাবলেট মানুষের দেহের জন্য ক্ষতিকর৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ‘ইনজেকশন’
বাংলাদেশের এক যৌনপল্লীর মালিক রোকেয়া জানান, স্টেরয়েড ওষুধ প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে ভালো কাজে দেয়৷ কিন্তু অপ্রাপ্তবয়স্ক, বিশেষ করে ১২ থেকে ১৪ বছর বয়সি মেয়েদের ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়৷ অপ্রাপ্তবয়সিদের স্বাস্থ্য ভালো করতে বিশেষ ধরনের ইনজেকশন ব্যবহার করা হয় বলে জানান ৫০ বছর বয়সি রোকেয়া৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
অধিকাংশ যৌনকর্মী ‘স্টেরয়েড আসক্ত’
আন্তর্জাতিক উন্নয়নসংস্থা একশনএইড ইউকে এক সমীক্ষার ভিত্তিতে ২০১০ সালে জানায় যে, বাংলাদেশের প্রায় ৯০ শতাংশ যৌনকর্মী ওরাডেক্সন বা অন্যান্য স্টেরয়েড ট্যাবলেট নিয়মিত গ্রহণ করে৷ তাঁদের গড় বয়স ১৫-৩৫ বছর৷ বাংলাদেশে দু’লাখের মতো যৌনকর্মী রয়েছে বলে ধারণা করা হয়৷
ছবি: picture-alliance/ZUMA Press/M. Candela
সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ
স্টেরয়েড ব্যবহারের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে প্রচারণা চালাচ্ছে একশনএইড৷ সংস্থাটির বাংলাদেশ অংশের কর্মকর্তা লুৎফুন নাহার জানিয়েছেন, ‘‘ওরাডেক্সন গ্রহণ করার পর শুরুতে মেয়েদের শরীরে চর্বির পরিমাণ বাড়তে থাকে৷ কিন্তু এটি নিয়মিত সেবন করলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, চামড়ায় ক্ষতসহ বিভিন্ন রোগ দেখা দেয়৷’’
ছবি: GMB Akash
এইচআইভি সংক্রমণ
বাংলাদেশে যৌনকর্মীদের মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণ বা এইডস রোগ হওয়ার খবর মাঝে মাঝে পত্রিকায় প্রকাশ হয়৷ তবে ঠিক কতজন যৌনকর্মী এইচআইভি আক্রান্ত তার হালনাগাদ কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি৷ অনেকক্ষেত্রে কনডম ব্যবহারে খদ্দেরের অনীহা যৌনকর্মীদের মাঝে যৌনরোগ ছড়াতে সহায়ক হচ্ছে৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: AP
‘অপ্রাপ্তবয়স্ক’ যৌনকর্মী
বাংলাদেশের যৌনপল্লীগুলোতে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের জোর করে যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর অভিযোগ রয়েছে৷ আর এই পেশায় যাঁরা একবার প্রবেশ করছেন, তাঁদের জীবনেও নানা ঝুঁকি থাকে৷ পতিতাপল্লীতে হামলার খবর কিন্তু মাঝেমাঝেই শোনা যায়৷ (ফাইল ফটো)
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
শত বছরের পুরনো পল্লী উচ্ছেদ
মাদারিপুরের পতিতাপল্লীটি ছিল শত বছরের পুরনো৷ গত বছর এই পল্লী উচ্ছেদ করেছেন স্থানীয়রা৷ এমনকি পল্লীটি জোরপূর্বক উচ্ছেদ না করার হাইকোর্টের আদেশও এক্ষেত্রে উপেক্ষা করা হয়েছে৷ সেখানে পাঁচশ’র মতো যৌনকর্মী বাস করতেন৷ কিছুদিন আগে টাঙ্গাইলের একটি পতিতাপল্লীও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে৷ এ রকম উচ্ছেদের আতঙ্কে রয়েছেন আরো অনেক যৌনকর্মী৷
ছবি: M.-U.Zaman/AFP/GettyImages
মধ্যপ্রাচ্যে ‘যৌনদাসী’ বাংলাদেশের মেয়েরা!
বাংলাদেশের বেশ কয়েক নারীকে মধ্যপ্রাচ্যে যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ উঠেছে৷ তাঁদের পাচার করে সিরিয়ায় নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছে একাধিক বার্তাসংস্থা৷ এ সব নারীকে ফিরিয়ে আনতে সরকারি উদ্যোগের কথা বলা হচ্ছে৷ তবে শুধু মধ্যপ্রাচ্য নয়, প্রতিবেশী দেশ ভারতের বিভিন্ন পতিতালয়েও বাংলাদেশি নারীদের জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তিতে নিয়োগ করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে৷