বাংলার নদ-নদীতে এককালে অনেক শুশুক দেখা যেতো৷ এখন তারা বিশ্বের অনেক প্রান্তেই লুপ্তপ্রায় প্রজাতি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ অ্যামাজন নদীতে শুশুকদের কল্যাণে অভিনব এক প্রকল্প চালানো হচ্ছে৷
বিজ্ঞাপন
ডাব্লিউডাব্লিউএফ-এর নেতৃত্বে এক অভিযানের আওতায় এই প্রথম ব্রাজিলের অ্যামাজন অঞ্চলে শুশুকদের পরীক্ষা করা হয়েছে৷ অ্যামাজনের এক শাখানদীতে এক শুশুক মা তার শাবককে ডাঙায় তুলে পরীক্ষা করে তাদের শরীরে জিপিএস ট্রান্সমিটার বসানো হয়েছে৷ অভিযানের প্রধান মার্সোলো অলিভেইরা বলেন, ‘‘গোলাপি রঙের এই শুশুক প্রজাতি সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান খুবই সীমিত৷ তাদের বাসস্থান সম্পর্কে কিছু তথ্য পেলেও তাদের সংখ্যা, স্বাস্থ্য, রক্তের স্তর, প্যারাসাইট, বিষক্রিয়ার আশঙ্কা সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না৷''
শুশুকদের সার্বিক চেকআপের ব্যবস্থা করা হয়েছে৷ পশু চিকিৎসক, মেরিন বায়োলজিস্ট, জেলে ও প্রকৃতি সংরক্ষণকারীরা এই প্রথম একসঙ্গে কাজ করছেন৷ খুব দ্রুত কাজ সারতে হয়, কারণ ডলফিনরা ডাঙার উপর বেশিক্ষণ বেঁচে থাকতে পারে না৷ এর আগে কখনো কোনো গোলাপি শুশুকের উপর আলট্রাসাউন্ড পরীক্ষা চালানো হয়নি৷ পশু চিকিৎসকের জন্যও এটা সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা৷
শুশুকদের ভালো রাখার জন্য প্রকল্প
05:37
মায়ের ডাক্তারি পরীক্ষার সময় তার শাবকের উচ্চতা ও ওজন মাপা হয়েছে৷ প্রায় এক ঘণ্টা পর দু'টি প্রাণীকে আবার নদীতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে৷ জেলেরা সাঁও মানুয়েল জা বারা নামের পাশের গ্রামেই থাকেন৷ এখানকার মানুষ নদীর উপর খুব নির্ভরশীল৷ শুশুকদের মতো তাঁদের জন্যও বিশুদ্ধ পানি অত্যন্ত জরুরি৷ অ্যামাজন অববাহিকায় উপার্জনের পথ খুবই কম৷ তাই অনেকেই গ্রাম ছেড়ে চলে যান৷ বেআইনি হলেও কেউ কেউ সোনার খোঁজে লেগে পড়েন৷
তবে সোনার খোঁজে যে পারদ ব্যবহার করা হয়, তা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক৷ শেষ পর্যন্ত এই পদার্থ মানুষ ও শুশুকের খাদ্যে স্থান পায়৷ তার ফলে এই প্রাণীদের কী হয়, গবেষকরা তা জানতে চান৷
মার্সোলো অলিভেইরা বলেন, ‘‘পশুদের শরীরে পারদের প্রভাব সম্পর্কে খুব কম জ্ঞান রয়েছে৷ মানুষের উপর এর প্রভাব নিয়ে অনেক কাজ হয়েছে৷ মানুষের স্নায়ুতন্ত্র ও শরীরের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের ক্ষয়ক্ষতির কথা জানা আছে৷ তবে প্রকৃতির কোলে প্রাণিজগত সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানা নেই৷ তাই আমরা টিস্যু বিশ্লেষণ থেকে শুরু করে আলট্রাসাউন্ড, ব্লাড কাউন্টের মতো সমান্তরাল পরীক্ষা চালাচ্ছি৷ গবেষণার মাধ্যমে আমরা বিষক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাই৷''
বিশ্বের বিরলতম প্রাণী বাংলাদেশের শুশুক
ডলফিন সাধারণত লবণ পানিতে বাস করে৷ শুধুমাত্র বাংলাদেশের শুশুক আর আমাজনের ‘বোতো’ এই দুই প্রজাতির ডলফিন সারা বছরই স্বাদু পানিতে থাকে৷ সেদিক দিয়ে শুশুক বিশ্বে খুবই বিরল একটা প্রাণী৷
ছবি: picture-alliance/dpa
খুবই বিরল
ডলফিন সাধারণত লবণ পানিতে বাস করে৷ শুধুমাত্র বাংলাদেশের শুশুক আর আমাজনের ‘বোতো’ এই দুই প্রজাতির ডলফিন সারা বছরই স্বাদু পানিতে থাকে৷ সেদিক দিয়ে শুশুক বিশ্বে খুবই বিরল একটা প্রাণী৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
বিপন্ন প্রাণী
২৫-৩০ বছর আগেও বাংলাদেশের নদীগুলোতে অনেক শুশুক বা ডলফিন দেখা যেত৷ কিন্তু এখন আর সেটা যাচ্ছে না৷ তাই ১৯৯৬ সাল থেকে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় নাম উঠে গেছে শুশুকের৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
মাছ ধরতে শুশুকের তেল
শুশুকের তেল মাছ ধরার জন্য বেশ কার্যকর৷ তাই জেলেরা গণহারে শুশুক ধরছে৷ এছাড়া জাটকা ধরার জন্য যে কারেন্ট জাল ব্যবহার করেন জেলেরা, তাতেও মারা পড়ছে শুশুকের দল৷ ছবিতে এমনই একটি মৃত শুশুক দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Ingrid Kvale
আবাস ও প্রজননস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে
নদীতে বাঁধ দেয়া, সেতু তৈরি ইত্যাদি কারণে নদীর নাব্যতা কমে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে শুশুকের আবাস ও প্রজননস্থল৷ এছাড়া যেখানে সেখানে ফেলে রাখা পলিথিন নদীর পানিতে মিশে গিয়েও নষ্ট করছে শুশুকের আবাস৷ শিল্প-কারখানা দূষিত বর্জ্যও শুশুকের শত্রু৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
অভয়ারণ্য ঘোষণা
শুশুক রক্ষায় সরকার দেড় বছর আগে সুন্দরবনের অন্তর্গত ৩১ কিলোমিটার জলজ এলাকায় অভয়ারণ্য ঘোষণা করেছে৷ তবে বাস্তবায়নের কাজ এখনো শুরু হয় নি৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
বিসিডিপি-র উদ্যোগ
বেসরকারি সংস্থা ‘বাংলাদেশ সেটাসিয়ান ডাইভারসিটি প্রজেক্ট’ বা বিসিডিপি সরকারের বন বিভাগের সহায়তায় অভয়ারণ্য পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিচ্ছে৷
ছবি: shushuk.org
শুশুক মেলা
বিসিডিপি-র উদ্যোগে সুন্দরবন এলাকায় গত চার বছর ধরে শুশুক মেলা হচ্ছে৷ এর মাধ্যমে শুশুক রক্ষায় জনসাধারণকে সচেতন করার চেষ্টা চলছে৷ গত ফেব্রুয়ারিতে মংলায় হয়ে গেলো মাসব্যাপী চতুর্থ শুশুক মেলা৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
শুশুকপ্রেমী রুবাইয়াত মনসুর
তিনি বিসিডিপি’র প্রধান গবেষক৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, জুলাই মাস থেকে অভয়ারণ্য ঘোষিত এলাকার আশেপাশের লোকজনের সঙ্গে আলোচনা শুরু হবে৷ বিশেষ করে জেলেদের বলা হবে তারা যেন মাছ ধরতে এমন জাল ব্যবহার করেন যেটা শুশুকের জন্য ক্ষতিকর হবে না৷
ছবি: Rubaiyat Mansur
বৈদেশিক মুদ্রা আয় সম্ভব
রুবাইয়াত মনসুর বলছেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ডলফিনের খেলা দেখিয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছে৷ বাংলাদেশও চাইলে শুশুক দিয়ে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে বলে মনে করেন তিনি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
9 ছবি1 | 9
প্রাণীদের জন্য আরেকটি বিপদ হলো নতুন বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্প৷ মার্সোলো বলেন, ‘‘বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি যেভাবে জলপ্রবাহ বিচ্ছিন্ন করছে, সেটাই মূল সমস্যা৷ এর ফলে বিভিন্ন প্রজাতির মধ্যে জিনগত আদানপ্রদান ব্যাহত হয়৷ বাঁধের কারণে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে বংশবৃদ্ধির পথে বাধা আসে৷''
প্রথমবার এক শুশুকের শরীরে ট্রান্সমিটার বসানো হয়েছে৷ জালে শুশুক ধরতে মাঝে মাঝে কয়েক ঘণ্টা সময় লাগে৷ প্রায়ই তারা পালাতে সমর্থ হয়৷ কলম্বিয়া ও বলিভিয়ায়ও ডলফিন পরীক্ষা করা হচ্ছে৷ এলাকার অন্যান্য দেশেও এমন পরীক্ষা চালানো হবে৷ ডাব্লিউডাব্লিউএফ এর মাধ্যমে গোটা অ্যামাজন এলাকায় ডলফিনদের সার্বিক অবস্থার চিত্র পাবার আশা করছে৷ সেখানে বেশিরভাগ প্রাণী অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের, তাদের ওজনও বড় কম৷ ৭০ কিলোগ্রামের বেশি ওজনের প্রায় কোনো ডলফিন নেই৷
নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস ও হৃৎস্পন্দনের উপর একটানা নজর রাখা হচ্ছে৷ এ যাত্রায় সব কাজ দ্রুত হয়েছে৷ আধ ঘণ্টাও সময় লাগে নি৷ জিপিএস ট্রান্সমিটারও চালু হয়ে গেছে৷ সেটি পাখনায় বসিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ প্রকল্পের অন্যতম গবেষক মিরিয়াম মারমন্টেল বলেন, ‘‘আমরা তাদের সঙ্গে কী করছি, প্রাণীরা ঠিক তা বুঝতে পারে৷ তবে বায়োপ্সি করা বা ট্রান্সমিটার বসানোর সময় আমরা শরীরের সেই অংশ আগে অসাড় করে দেই৷''
পরীক্ষার শেষে শুশুকটিকে দ্রুত আবার পানিতে ছেড়ে দেওয়া হয়৷ ডাব্লিউডাব্লিউএফ-এর আশা, এই প্রকল্পের মাধ্যমে গোলাপি রংয়ের নদীর এই শুশুককে লুপ্তপ্রায় প্রজাতির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে৷ সেটা হলে তাদের ইকোসিস্টেমের জন্য আরও বেশি সুরক্ষার ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে৷
নিকোলাউস তারুকেলা-লেভিটান/এসবি
শুশুকের মৃত্যু আমাদের নাড়া দেয় কেন
জাপানের তাইজি-তে শুশুক মারা সারা বিশ্বে যারা জীবজন্তু ভালোবাসেন, তাঁদের মধ্যে প্রতিবাদের সৃষ্টি করেছে৷ এই অদ্ভুত জলচর জীবগুলোকে ভালো লাগে, সেটা কি তাদের ক্লিক আওয়াজ করা, তাদের ‘হাসিমুখ’ না তাদের অসাধারণ বুদ্ধির জন্য?
ছবি: picture-alliance/dpa
শুশুক প্রেম
সামুদ্রিক কচ্ছপ? তিমি মাছ? হাতি সীল? এদের দেখলে চমকে যেতে হয় বটে, কিন্তু শুশুকদের মতো এরা আমাদের মন কাড়তে পারে না৷ প্রাণিবিজ্ঞানীরা শুশুকদের অতীব বুদ্ধিমান জীব বলে মনে করেন, সেই জন্যে কি? নাকি তাদের দেখতে অতো বন্ধুসুলভ বলে?
ছবি: picture-alliance/dpa
মাতৃদুগ্ধ
হয়ত শুশুকরা আমাদের মতো উষ্ণ রক্তের স্তন্যপায়ী জীব বলেই আমাদের তাদের ভালো লাগে৷ শুশুকদেরও প্রতিবার একটি করে সন্তানেরই জন্ম হয়৷ আর সেই ক্ষুদে শুশুকদের দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শুশুক শিকার
এই সামুদ্রিক জীবগুলির প্রতি আমাদের ভালোবাসাই হয়ত তাদের বাঁচানোর জন্য আমাদের আকুলতার উৎস৷ তাইজি জাপানে ধীবরদের একটি শহর৷ সেখানে শুশুক শিকার একটা ঐতিহ্য, কিন্তু প্রতিবছরই সারা বিশ্বে প্রতিবাদের সৃষ্টি করে৷ শুশুকদের একটা খাড়িতে ঢুকিয়ে সেখানে তাদের মারা হয়৷
ছবি: Reuters
মরণের ডঙ্কা
শুশুকরা পানির মধ্যে শব্দ-সংকেত ব্যবহার করে৷ জাপানি ধীবররা জলের নীচে লোহার পাইপ পিটিয়ে আওয়াজ করে শুশুকদের বিভ্রান্ত করে খাড়িতে নিয়ে আসে৷ শুশুকরা যেহেতু দঙ্গলে থাকে, সেহেতু এভাবে একটা গোটা দঙ্গলকে ধরা চলে৷
ছবি: CC2.0/lowjumpingfrog
পানিতে রক্তকাণ্ড
শুশুকের রক্তে তাইজি-র খাড়ির জল লাল হয়ে যেতো৷ লোকের নজর এড়ানোর জন্য তাইজি-র শুশুক শিকারীরা তাই আজ শুশুকগুলোকে মাথায় লোহার শিক ঢুকয়ে মারে এবং সেই ক্ষত ছিপি দিয়ে আটকে রক্ত বের হওয়া বন্ধ করে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
শৌখিন খাদ্য
অনেক শুশুককেই মারা হয় তাদের মাংসের জন্য৷ সারা বিশ্বে শুশুকের মাংসের গ্রাহক আছে৷ একটি বটলনোজ গোত্রীয় শুশুকের দাম দেড় লাখ ডলার, আবার একটি দুষ্প্রাপ্য শ্বেত শুশুক-শাবকের বিক্রয়মূল্য পাঁচ লাখ ডলারও হতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বন্দি শুশুক
মেরিন এন্টারটেইনমেন্ট শো-গুলোতে বটলনোজ শুশুকগুলোর খুব চাহিদা৷ তারা খুব তাড়াতাড়ি নানা খেলা শেখে, দর্শকদের খুশি করতে পারে৷ কিন্তু এই শুশুকরাই আবার মানসিক বিষাদে ভোগে এবং বন্দি অবস্থায় অত্যন্ত কমবয়সে মারা যায়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
অতিশয় বুদ্ধিমান
শুশুকদের মস্তিষ্ক সুবৃহৎ এবং জটিল৷ তাদের চেনার এবং যোগাযোগ করার ক্ষমতা অসাধারণ৷ কিন্তু তাদের দুঃখকষ্টের খবর ক’জন রাখেন?
ছবি: picture-alliance/dpa
সিনেমা-টেলিভিশনের তারকা
শুশুকরা ছবিতে অভিনয়ে ওস্তাদ, যেমন জার্মান হিট ছবি ‘দ্য ডলফিন মিরাকল’-এ৷ কিন্তু প্রখ্যাত টেলিভিশন সিরিজ ‘ফ্লিপার’-এর এক শুশুক-অভিনেতা নাকি আত্মহত্যা করেছিল৷ তার ট্রেনার রিচার্ড ও’ব্যারি আজ শুশুকদের অধিকারের প্রবক্তা৷
ছবি: picture-alliance/dpa
গোপন অস্ত্র
মার্কিন মিলিটারি জলের নীচে মাইনবোমা নিষ্ক্রিয় করার জন্য – আবার শত্রুর জাহাজে মাইনবোমা লাগানোর জন্যও শুশুকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে৷ ভালোমানুষ এই জীবটিকে নিরাপত্তার বিপদ বলে আর কে মনে করবে!