বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে ডনাল্ড ট্রাম্প পরিচিত 'আনপ্রেডিকটেবল' বা তার অপ্রত্যাশিত আচরণের জন্য৷ রক্ষণশীল রাজনীতির ধারায় কিছু কিছু বিষয় বদলায় না৷ সরকারে যেই আসুক না কেন, কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম-নীতি তারা অনুসরণ করে৷ ডনাল্ড ট্রাম্প সেই ধারার রাজনীতিক নন৷ তিনি যা করেন, নিজের খেয়ালে করেন৷ তা সে যতই বিতর্কিত হোক না কেন৷
আর এখানেই নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ট্রাম্পের মিল৷ ভারতের প্রধানমন্ত্রী চারিত্রিক দিক থেকে ট্রাম্পের মতো নন৷ দীর্ঘদিন রেজিমেন্টেড রাজনীতি করেছেন তিনি৷ ফলে দলীয় শৃঙ্খলা, সামাজিক শৃঙ্খলা মেনে চলেন তিনি৷ কিন্তু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে ট্রাম্পের সঙ্গে মোদীর মিল হলো, তারা দুজনেই আনপ্রেডিকটেবল৷ ৭৫ বছরের ভারতীয় রাজনীতি যে বিষয়গুলিতে হাত দেওয়ার সাহস করেনি, মোদী বিতর্কিত সেই বিষয়গুলি নিয়ে একের পর এক পদক্ষেপ নিয়েছেন৷ তা সে বাবরি মসজিদ-রাম মন্দির প্রসঙ্গই হোক অথবা কাশ্মীর৷ মোদীর এই অপ্রত্যাশিত রাজনৈতিক চালকে ট্রাম্প অভিহিত করেছেন 'কিলার' শব্দটি দিয়ে৷ ট্রাম্পের ভাষায় 'কিলার মোদী'৷ আর এই কিলার মানসিকতাই বিশ্বের এই দুই নেতাকে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে৷
জাতীয়তাবাদী লাইন
মোদী এবং ট্রাম্প দুজনেই জাতীয়তাবাদী, সময় সময় তারা অতি জাতীয়তাবাদী রাজনীতির লাইন নেন৷ মোদীর মুখে তাই যেমন কথায় কথায় 'মেক ইন ইন্ডিয়া' শোনা যায়, ট্রাম্পের মুখে শোনা যায় 'অ্যামেরিকা ফার্স্ট৷' অর্থাৎ, আগে দেশ, পরে পররাষ্ট্র৷ জো বাইডেনের শাসনকালে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি ভারসাম্য রেখে চলেছে৷ দক্ষিণ এশিয়ায় ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য ভারতকে ঠিক যতটা গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন ছিল, বাইডেন প্রশাসন ঠিক ততটাই দিয়েছে৷ যেখানে যেখানে ভারতের উপর চাপ তৈরি করার প্রয়োজন ছিল, বাইডেন প্রশাসন তা করতে পিছুপা হয়নি৷ কিন্তু যা ঘটেছে, তা প্রত্যাশিতভাবে ঘটেছে৷
ট্রাম্প এলে কী ঘটবে, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই সন্দিহান৷মনে রাখা দরকার, বড় অংশের ভারতীয় কোনো না কোনো ভাবে অ্যামেরিকার কাজের বাজারের সঙ্গে যুক্ত৷ বলা হয়, মার্কিন তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পের সাপোর্ট সিস্টেম ভারতীয় মেধা৷ বিরাট অংশের ভারতীয় অ্যামেরিকায় বসে কাজ করেন৷ বিরাট অংশের ভারতীয় সংস্থা ভারত থেকে অ্যামেরিকার তথ্য প্রযুক্তি শিল্পকে সাহায্য করে৷ প্রথমবার সরকারে এসে এই বিষয়টি নিয়ে বার বার প্রশ্ন তুলেছিলেন ট্রাম্প৷ আউট সোর্সিং কমিয়ে দেওয়ার কথা বার বার বলেছেন তিনি৷ কাজ সংক্রান্ত ভিসা প্রদানের ক্ষেত্রে অনেক বেশি কড়া পদক্ষেপ নিয়েছিল ট্রাম্প প্রশাসন৷ ট্রাম্পের অভিবাসন নীতি অনেক বেশি রক্ষণশীল৷ এবারেও সেই একইরকম বার্তা দিতে তিনি শুরু করেছেন৷ যা ভারতীয় চাকরিজীবীদের জন্য খুব সুখবর নয়৷
পররাষ্ট্র সম্পর্ক
বিশ্ব রাজনীতিতে ভারত বরাবরই ভারসাম্যের কূটনৈতিক কৌশল অবলম্বন করে৷ অ্যামেরিকার যথেষ্ট বন্ধু হয়েও ভারত রাশিয়ার সঙ্গে ঐতিহাসিক বন্ধুত্বের সম্পর্ক পালন করে৷ ট্রাম্প আসার পরেও ভারতের সেই নীতিতে কোনো বদল ঘটবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ খেয়াল রাখা জরুরি, রাশিয়ার সঙ্গে সবচেয়ে বড় যে মঞ্চটি ভারত শেয়ার করে, তার নাম ব্রিকস৷ চীনও সেই মঞ্চে আছে৷ বেশ কিছুদিন ধরেই ব্রিকস তাদের নিজেদের মধ্যে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ডলার তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে৷ ব্রিকস বাণিজ্যের জন্য নতুন কারেন্সি বা দেশীয় কারেন্সিতে ব্যবসা করার কথা ভাবছে৷ হোয়াইট হাউসে ঢোকার আগেই ট্রাম্প জানিয়ে দিয়েছেন, ব্রিকস এই কাজ করলে ওই দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যে ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে৷ লক্ষ্যণীয়, মেক্সিকো এবং ক্যানাডার সঙ্গে বাণিজ্যে ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করার ঘোষণা করে দিয়েছেন৷ চীনের সঙ্গে বাণিজ্যে অতিরিক্ত ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণাও করেছেন তিনি৷ ভারতের চ্যালেঞ্জ হলো, তারা ব্রিকসকে বেশি গুরুত্ব দেবে, নাকি ট্রাম্পকে৷ দুটোই ভারতের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ৷
বাণিজ্যিক সম্পর্ক
অভিবাসন এবং বাণিজ্যিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ট্রাম্প সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারতের উপর চাপ তৈরি করতে পারে, তা অনেকেই মনে করছেন৷ তবে ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ট্রাম্প সরকার ভারতকে সাহায্য করবে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷ ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের বিষয়ে সমস্ত মার্কিন ডেমোক্র্যাট সরকার ভারসাম্যের নীতি নিয়ে চলেছে৷ বাইডেনের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি৷ ট্রাম্পের প্রথম সরকার এবিষয়ে অনেক বেশি ভারতপন্থি মনোভাব দেখিয়েছে৷ জঙ্গিবাদ নিয়ে ভারতের বক্তব্যের সঙ্গে অতীত ট্রাম্প সরকারের বক্তব্য অনেক সময়েই মিলে গেছে৷ এপর্যায়েও পাকিস্তান প্রশ্নে ট্রাম্প দিল্লির দিকে ঝুঁকে থাকবেন বলেই মনে করছেন কূটনীতিবিদেরা৷ অন্যদিকে, কাশ্মীর নিয়েও ট্রাম্প সরকার ভারতের উপর বিশেষ চাপ তৈরি করবে বলে মনে করা হচ্ছে না৷
চলতি সময়ে ক্যানাডায় 'খালিস্তানি হত্যা' নিয়ে ক্যানাডার সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে৷ ট্রাম্প সরকার এবিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে৷ ভারত আসা করছে, এবিষয়ে ট্রাম্প মোদীকে সাহায্য করবেন৷
বাংলাদেশ প্রসঙ্গ
বাংলাদেশের চলতি পরিস্থিতি নিয়ে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটি উত্তেজনা তৈরি হয়েছে৷ যদিও সরকারিভাবে ভারত এবং বাংলাদেশ কোনো দেশই তা প্রকাশ্যে আনছে না৷ বরং দুই দেশই কিছুটা সময় কেনার কৌশল নিয়েছে৷ ট্রাম্প সরকার বাংলাদেশ বিষয়ে কী মনোভাব নেয়, সেই বিষয়টিও ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ৷ কূটনৈতিকভাবে ভারত এনিয়ে অ্যামেরিকার সঙ্গে আলোচনা করতে পারে বলেও সাউথ ব্লকের অন্দরে আলোচনা শুরু হয়েছে৷
চীনের সঙ্গে সম্পর্ক
ট্রাম্পের প্রথম আমলে চীনের সঙ্গে অ্যামেরিকার সম্পর্ক সর্বকালীন তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছিল৷ চীনের সঙ্গে অ্যামেরিকার খারাপ সম্পর্ক ভারতের জন্য কূটনৈতিকভাবে সুখের৷ কারণ ভারত-চীন সম্পর্কের টানাপড়েনে ভারত সবসময়ই বাকি বিশ্বকে পাশে পেতে চায়৷ বিশেষ করে অ্যামেরিকাকে৷ এবিষয়েও ট্রাম্প মোদীকে সাহায্য করবেন বলেই মনে করা হচ্ছে৷
সব মিলিয়ে ট্রাম্প আমলে ভারত-অ্যামেরিকা সম্পর্ক এক কথায় 'মশলাদার' হবে বলে মনে করছেন কূটনীতিবিদেরা৷ ট্রাম্প এবং মোদী দুজনেই যেহেতু কূটনৈতিক স্তরে 'আনপ্রেডিকটেবল', ফলে আগামী চার বছর নানা কিছু ঘটার সম্ভাবনাই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা৷ প্রশ্ন হলো, সম্ভাবনা আশঙ্কায় না পরিণত হয়!