জার্মানির গাড়ি কোম্পানিগুলির দিনকাল মোটেই ভালো যাচ্ছে না৷ ডিজেলগেট কেলেঙ্কারি ও প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে অবৈধ বোঝাপড়ার অভিযোগে এবার উত্তর অ্যামেরিকায় একের পর এক মামলা শুরু হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
ফ্লোরিডা রাজ্যের এলিজাবেথ কফম্যান, নিউ জার্সির এডনা পার্কার ও ওয়াশিংটন ডিসি-র ক্যারল গিবস – তিনজনেই দামি, উচ্চমানের জার্মান গাড়ির ভক্ত ছিলেন৷ তাঁরা বিএমডাব্লিউ, পর্শে, আউডি ও ফলক্সভাগেন কোম্পানির বিরুদ্ধে মামলা করেছেন৷ এই কোম্পানিগুলি গোপন বোঝাপড়ার মাধ্যমে প্রায় দুই দশক ধরে নিজেদের গাড়ির দাম বেআইনি পথে অনেকটাই বাড়িয়ে রেখেছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে, তার ভিত্তিতেই অ্যামেরিকা ও ক্যানাডার আদালতে প্রায় একই সময়ে এই মামলা দায়ের করা হয়েছে৷
শুধু দাম নয়, এই কোম্পানিগুলি যন্ত্রাংশ সরবরাহকারী, বাজার, গাড়ির নির্গমন মাপার সরঞ্জাম ও অন্যান্য প্রতিযোগিতামূলক বিষয়ে বেআইনিভাবে বোঝাপড়া করে এসেছে বলে অভিযোগ উঠেছে৷ ৩ ব্যক্তি আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানালেও অ্যামেরিকার সব ক্রেতাদের হয়েই এই মামলা করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে৷
এমন গণমামলার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য ক্ষতিপূরণের মাত্রা আকাশছোঁয়া হতে পারে৷ ক্যানাডার এক আদালতে প্রায় ৮৭ কোটি ৮০ লক্ষ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয়েছে৷
উল্লেখ্য, ইউরোপেও কর্তৃপক্ষ জার্মান গাড়ি কোম্পানিগুলির এই ষড়যন্ত্রের অভিযোগের তদন্ত করছে৷ একটি সূত্র অনুযায়ী মার্কিন কর্তৃপক্ষও এক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে ভাবনাচিন্তা করছে৷ মার্কিন বিচার মন্ত্রণালয় এই অভিযোগ খতিয়ে দেখছে বলে ব্লুমবার্গ দাবি করেছে৷
জার্মানির ডাইমলার কোম্পানি এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে৷ সংবাদ সংস্থা এএফপি-কে লেখা এক ই-মেলে কোম্পানির এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, এই মামলা ভিত্তিহীন এবং কোম্পানি আত্মপক্ষ সমর্থনে সব পদক্ষেপ নেবে৷ বিএমডাব্লিউ ও ফলক্সভাগেন কোম্পানি অবশ্য এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি৷
জার্মানিতেও চাপের মুখে পড়ছে গাড়ি কোম্পানিগুলি৷ ফেডারেল পরিবহনমন্ত্রী পর্শে কোম্পানির একটি ডিজেল মডেল বিক্রির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন৷ কার্বন নির্গমন সংক্রান্ত কারচুপির অভিযোগের ভিত্তিতে এই মডেলের জন্য অনুমতি প্রত্যাহার করেছে সরকার৷ পর্শে অবশ্য বিক্রি হওয়া সব গাড়ি ফিরিয়ে এনে এই ‘ত্রুটি' সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে৷
ইউরোপে পেট্রোল-ডিজেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার?
শুধু জার্মানিতে ডিজেলগেট কেলেঙ্কারির কারণে নয়, বায়ুদূষণ কমাতে ডিজেল ও পেট্রোলচালিত গাড়ি ধাপে ধাপে বন্ধ করার জন্য চাপ বাড়ছে গোটা ইউরোপে৷ কিন্তু এমন বৈপ্লবিক পদক্ষেপের পথে রয়েছে অনেক বাধা-বিপত্তি ও জটিলতা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Woitas
বিকল্প জ্বালানির ধীর অগ্রগতি
২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী গোটা ইউরোপে মাত্র ০ দশমিক ২ শতাংশ গাড়ি পুরোপুরি বিদ্যুৎচালিত ছিল৷ হাইব্রিড গাড়ি ধরলে সংখ্যাটা দাঁড়ায় ১ দশমিক ৩ শতাংশ৷ প্রযুক্তির উন্নতি সত্ত্বেও রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অবকাঠামোর অভাবের মতো অনেক কারণে ইউরোপে পরিবহণের ক্ষেত্রে বিকল্প জ্বালানির ব্যবহার এখনো নগণ্য৷
ছবি: picture-alliance/dpa/J. Woitas
গাড়ি কোম্পানিগুলির প্রতিরোধ
পেট্রোল-ডিজেল ‘লবি’ প্রচলিত গাড়ির পক্ষে যে সব যুক্তি দেখায়, কর্মসংস্থান তার মধ্যে অন্যতম৷ যেমন জার্মানির গাড়ি শিল্পের সংগঠন ভিডিএ-র দাবি, ২০৩০ সালের মধ্যে প্রচলিত পেট্রোল-ডিজেল ইঞ্জিন উৎপাদন বন্ধ করলে জার্মানিতে প্রায় ছ’লক্ষ মানুষ চাকরি হারাতে পারেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Jan Woitas
বিকল্প জ্বালানি ও কর্মসংস্থান
বিকল্প জ্বালানির সাহায্যে বিদ্যুৎ উৎপানের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের যে জোয়ার দেখা গেছে, ইলেকট্রিক ও হাইব্রিড গাড়ির ক্ষেত্রেও তেমনটা ঘটবে বলে পূর্বাভাষ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা৷ একটি হিসেব অনুযায়ী ২০১৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপে এক্ষেত্রে ২৫ হাজার নতুন চাকরি হবে৷
ছবি: picture alliance/dpa/U. Zucchi
দুর্বল ব্যাটারি নিয়ে সমস্যা
ইলেকট্রিক গাড়ির অন্যতম সমস্যা ঘনঘন ব্যাটারি চার্জের প্রয়োজনীয়তা৷ তার উপর চার্জিং-স্টেশনের সংখ্যা এখনো কম৷ সেই নেটওয়ার্ক বাড়ালে ও ব্যাটারির দাম কিলোওয়াট-প্রতি ১০০ মার্কিন ডলারে নেমে এলে প্রচলিত গাড়ির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারবে ইলেকট্রিক গাড়ি৷ ২০২০ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এমনটা সম্ভব হবে বলে পূর্বাভাষ পাওয়া যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/K. Nietfeld
নিষেধাজ্ঞার পথ
ব্রিটেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে দেশে ২০৪০ সাল থেকে কোনো নতুন পেট্রোল ও ডিজেলচালিত গাড়িকে ছাড়পত্র দেওয়া হবে না৷ ইউরোপে একের পর এক দেশ ও শহর এমন লক্ষ্যমাত্রা স্থির করে চলেছে৷ বায়ুদূষণ কমাতে ও বিকল্প জ্বালানিচালিত গাড়ির উৎপাদনকে উৎসাহ দিতে এমন সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/S.Barbour
‘একলা চলো রে’ নীতির সমস্যা
ইউরোপের গাড়ি শিল্প পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত৷ তাই ব্রিটেনের মতো দেশ বা কিছু শহর বিচ্ছিন্নভাবে পেট্রোল-ডিজেল বর্জন করলে নির্গমনহীন গাড়ি তৈরির প্রয়াস উলটে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে ইউরোপীয় কমিশন৷ আমদানি-রপ্তানির ক্ষতি, যন্ত্রাংশ সরবরাহে বিঘ্নের ফলে বিকল্প জ্বালানির গাড়িতে বিনিয়োগ কমে যাবার আশঙ্কা রয়েছে৷
ছবি: picture alliance/dpa/L. M. Mirgeler
চাপের মুখে গাড়ি শিল্প
জার্মানির দু’টি প্রধান গাড়ি কোম্পানি ‘ক্লিন ডিজেল’ প্রযুক্তিতে বিশাল বিনিয়োগ করেছে৷ কিন্তু ২০১৫ সালে অ্যামেরিকায় গাড়ির কার্বন নির্গমন পরীক্ষায় কারচুপি স্বীকার করে নেয় ফলক্সভাগেন কোম্পানি৷ আউডি, পর্শে সহ কোম্পানির এই অসৎ কাজ জার্মানির পরিবহণ কর্তৃপক্ষ ধরতে পারেনি৷ তাই জার্মান গাড়ি শিল্প ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ চাপের মুখে পড়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/F. Gentsch
পরিবর্তনের শীর্ষে ভলভো
সুইডেনের ভলভো কোম্পানি জানিয়ে দিয়েছে, ২০১৯ সালের পর তারা আর কোনো পেট্রোল ও ডিজেলচালিত গাড়ি উৎপাদন করবে না৷ এই প্রথম কোনো বড় আকারের গাড়ি কোম্পানি এমন সাহসি পদক্ষেপ নিচ্ছে৷ উল্লেখ্য, সুইডেন ২০৪৫ সালের মধ্যে সব ধরনের গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধ করার লক্ষ্যমাত্রা স্থির করেছে৷