আংশিক লকডাউনে এ বার বন্ধ লোকাল ট্রেন৷ গন্তব্যে পৌঁছনোর বেপরোয়া চেষ্টা নিত্যযাত্রীদের৷ ফলে করোনা বিধির দফারফা৷ কোভিডে লাগাম দিতে তবে কি অন্য রাজ্যের মতো পূর্ণ লকডাউনের পথে হাঁটতে হবে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে?
বিজ্ঞাপন
শহরতলির লোকাল ট্রেন মহানগরী কলকাতার লাইফলাইন৷ জেলা থেকে রোজ লক্ষ লক্ষ মানুষ হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশন দিয়ে শহরে আসেন রুটি-রুজির জন্য৷ আসে কাঁচা সব্জি, মাছ-সহ অন্যান্য সামগ্রী৷ কোভিডের প্রথম ঢেউ সামলাতে প্রথম দফায় আট মাস বন্ধ ছিল লোকাল ট্রেন৷ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসার পর ১১ নভেম্বর ফের শুরু হয় পরিষেবা৷ এ বার দ্বিতীয় ঢেউ হানা দিতে দ্রুত সংক্রমণ বাড়ছে৷ শুক্রবার সন্ধ্যার হিসেব অনুযায়ী, রাজ্যে দৈনিক সংক্রমণ ১৯ হাজার পার করেছে৷ মৃত্যু একশোর উপরে৷ পরিস্থিতি সামলাতে বৃহস্পতিবার থেকে লোকাল ট্রেন দুই সপ্তাহের জন্য বন্ধ করে দিয়েছে রাজ্য সরকার৷ তার সুফল কি মিলবে?
অনির্বাণ দলুই
দূরত্ববিধি নেই
একদিকে ট্রেন বন্ধ৷ অন্যদিকে বাসের সংখ্যা কমেছে অনেকটাই৷ মেট্রোও চলাচল করছে কম৷ অথচ সরকারি-বেসরকারি দফতর বন্ধ হয়নি৷ ৫০ শতাংশ কর্মী নিয়ে সরকারি দফতর চলছে৷ সেজন্য কর্মস্থলে পৌঁছতে নাজেহাল হচ্ছেন সাধারণ মানুষ৷ করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে ৫০ শতাংশ যাত্রী নিয়ে বাস ও মেট্রো চালানোর অনুমতি দিয়েছে রাজ্য৷ পথে নেই পর্যাপ্ত বাস, তার উপরে বাড়তি যাত্রীর চাপ৷ কোথাও দেখা যাচ্ছে লম্বা লাইন, কোথাও বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিস যাচ্ছে মানুষ৷ কাজের জায়গায় পৌঁছনোর তাড়ায় উধাও সব নিয়মবিধি৷ মেচেদা, মধ্যমগ্রাম, বারুইপুর, ডানলপ, কামালগাজি, চুঁচুড়া— সর্বত্র ধরা পড়ল একই ছবি৷
তারাপদ হালদার শ্রীরামপুর থেকে নিয়মিত কলকাতায় আসেন৷ ট্রেন না পাওয়ায় বাসের উপর ভরসা করতে গিয়ে বিপদে পড়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘নিজস্ব যানবাহন নেই৷ ফলে বাসে সংক্রমণের ভয় জেনেও উঠতে বাধ্য হলাম৷ এর থেকে লকডাউন হলে ভাল ছিল৷’’ একই অভিজ্ঞতা মধ্যমগ্রামের দীক্ষা রাউতের৷ সল্টলেকের কর্মস্থলে পৌঁছতে বেশ কিছুটা পথ ট্রেনে সফর করতেন৷ এখন তা সম্ভব হচ্ছে না৷ অ্যাপ ক্যাবে বিপুল ভাড়া কতজন মেটাতে পারবেন!
উল্টো ছবিটাও দেখা যাচ্ছে পথেঘাটে৷ অফিসের সময় ছাড়া দুপুর বা রাতে ফাঁকাই চলছে বাস৷ হাতে গোনা যাত্রী থাকছেন৷ তাই বেশি সংখ্যায় বাস চালাতে চাইছে না বাস মালিক সংগঠন৷ জয়েন্ট কাউন্সিল অফ বাস সিন্ডিকেটের সাধারণ সম্পাদক তপন বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘যত বেশি বাস চালাব, তত ক্ষতির বহর বাড়বে৷ জ্বালানির দাম বেড়েছে৷ বাসের ইএমআই, বিমার খরচ আছে৷ সরকারি বাস ভর্তুকি পায়৷ আমরা তো পাই না৷ কীভাবে বাসকর্মীদের পেট চলবে?’’
রুটি-রুজির সংকট
রতন খাসনবিশ
ভারতের অর্থনীতিতে বিরাট ধাক্কা লেগেছে কোভিডের প্রথম দফায়৷ সমীক্ষা অনুযায়ী, ২৩ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে চলে গেছেন৷ দ্বিতীয় ঢেউয়ে তীব্র হচ্ছে অর্থনীতির সংকট৷ এরিমধ্যে ৭২ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন৷ শুধু এপ্রিলে কর্মহারা হয়েছেন ২৮ লাখ৷ এরমধ্যে বিপুল সংখ্যক নারীরাও রয়েছেন৷ দেশের বিভিন্ন রাজ্যে পূর্ণ লকডাউন চলছে৷ পশ্চিমবঙ্গ আংশিক লকডাউন করায় কি একটু ভালো অবস্থানে থাকবে? অর্থনীতিবিদ রতন খাসনবিশ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আংশিক করে লাভ হয় না৷ এতে যেমন সংক্রমণের শৃঙ্খল পুরো ভাঙা যায় না৷ তেমনই কর্মসংস্থান সঙ্কুচিত হতে থাকে৷ তার থেকে পূর্ণ লকডাউন ভালো যাতে অতিমারির থেকে বাঁচা যায়৷’’ যদিও কোনও লকডাউনকেই ফলপ্রসূ বলে মনে করেন না চিকিৎসকদের একাংশ৷ ওয়েস্ট বেঙ্গল ডক্টর্স ফোরাম-এর সদস্য ডাঃ পুণ্যব্রত গুণ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘টিকাকরণ জরুরি৷ তবেই কোভিডকে রোখা যাবে৷ লকডাউনে অতিমারির মোকাবিলা করা যায় না, উল্টো মানুষের বিপদ বাড়ে৷’’
তবে গোড়ায় মধ্যমপন্থা অবলম্বনের পক্ষপাতী অনেক জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ৷ কোভিড প্রোটোকল মনিটরিং কমিটির আহ্বায়ক, চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘অতিমারি মোকাবিলা ও অর্থনীতির স্বাস্থ্য একসঙ্গে বিবেচনা করতে পদক্ষেপ নিতে হবে৷ ধাপে ধাপে বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে৷ তার সঙ্গে টিকাকরণ চালিয়ে যাওয়া দরকার৷ সবশেষ অস্ত্র লকডাউন৷ নইলে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়বেন৷’’
করোনার ভারতীয় রূপ কতটা ভয়ংকর?
প্রায় প্রতিদিনই করোনা শনাক্তের রেকর্ড হচ্ছে ভারতে৷ ধারণা করা হচ্ছে এর পেছনে দেশটিতে শনাক্ত হওয়া করোনার নতুন রূপের ভূমিকা থাকতে পারে৷ এ নিয়ে এখন পর্যন্ত পাওয়া কিছু তথ্য থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: DesignIt/Zoonar/picture alliance
বি.১.৬১৭
এমন নামেই পরিচিত করোনার নতুন ভারতীয় ধরনটি৷ দেশটিতে দ্রুত সংক্রমণ ছড়ানোর কারণ এটি কীনা সেটি অবশ্য এখনও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না৷ তবে সম্ভাব্য একটি কারণ হিসেবে দেখা হচ্ছে এই ভ্যারিয়েন্টকে৷
ছবি: DesignIt/Zoonar/picture alliance
কখন থেকে?
গত মার্চে ভারতের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ প্রথম এই ভ্যারিয়েন্টের কথা জানায়৷ ভাইরাসের এই ধরনটি দুইবার রূপ বদলেছে বলে সেসময় জানিয়েছেন কর্মকর্তারা৷ তবে বিজ্ঞানীদের ধারণা সেটি এখন তৃতীয়বারের মতো রূপ বদলেছে৷ জিনগত উপাত্তের উন্মুক্ত তথ্য ভাণ্ডার জিআইএসএইড-এর (GISAID) তথ্য অনুযায়ী ভারতে বিদ্যমান করোনা ভ্যারিয়েন্টের ৬৩ ভাগই এখন বি.১.৬১৭৷
ছবি: Adnan Abidi/REUTERS
কতটা উদ্বেগের?
প্রথম রূপটি (E484Q) অনেকটা ব্রাজিলে ও দক্ষিণ আফ্রিকায় দ্রুত সংক্রমণ ঘটানো ভ্যারিয়েন্টের মতো৷ দ্বিতীয়টি (L452R), এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় পাওয়া গেছে৷ এই ধরনটি টিকার রোগ প্রতিরোধ ব্যাবস্থাকে এড়িয়ে যেতে সক্ষম এবং বেশি মারাত্মক বলে মনে করা হচ্ছে৷ আর তৃতীয় রূপটি (P681R) উচ্চ সংক্রমণপ্রবণ যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্টটির কাছাকাছি৷
ছবি: picture-alliance/M. Schönherr
কতটা ছড়িয়েছে?
ভারতের বিভিন্ন রাজ্য নতুন এই ভ্যারিয়েন্টটি পাওয়া যাচ্ছে৷ শুধু ভারত নয় এটি ছড়িয়ে পড়েছে অন্য দেশগুলোতেও৷ জার্মানি, বেলজিয়াম, যুক্তরাজ্য, সুইজারল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং সিঙ্গাপুরের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষও দেশগুলোতে বি.১.৬১৭ শনাক্ত করেছে৷
ছবি: Xavier Galiana/AFP
মানবদেহে কী করছে?
একাধিক রূপ বদলের কারণে ভাইরাসটি শরীরে দ্রুত ছড়াতে পারে৷ বিশেষ করে এর পক্ষে শরীরে এন্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে এড়িয়ে যাওয়াও সহজ হতে পারে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন আগে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন এমন ব্যক্তি বা যারা টিকা নিয়েছেন তাদেরও এই ভ্যারিয়েন্টে নতুন করে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে৷
ছবি: AFP/National Institutes of Health
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কী বলছে?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এটিকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ তালিকায় রেখেছে৷ অর্থাৎ, তারা ভাইরাসটি নজরদারিতে রেখেছে, তবে এখনও সেটি বড় ধরনের উদ্বেগের পর্যায়ে পৌঁছেনি৷ উদ্বেগের পর্যায়ে পৌঁছালে এটিকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ ঘোষণা করা হতে পারে৷
ছবি: Fabrice Coffrini/AFP/Getty Images
বেশি সংক্রামক নয়?
ভ্যারিয়েন্টটি নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যেই রয়েছে মতপার্থক্য৷ যুক্তরাজ্যের কোভিড-১৯ জেনোমিকস ইনিশিয়েটিভ এর পরিচালক ড. জেফারি ব্যারেট এর মতে গত কয়েক মাসে ভ্যারিয়েন্টটি বেশ ধীর গতিতে ছড়িয়েছে৷ আর এজন্য তিনি এটিকে যুক্তরাজ্যের ভ্যারিয়েন্ট বি.১.১.৭ এর মত সংক্রামক নয় বলে মনে করছেন৷
ছবি: PAWAN KUMAR/REUTERS
উপাত্ত কী বলে?
জিনগত বিশ্লেষণে মহারাষ্ট্রে ৬০ শতাংশের বেশি করোনা আক্রান্তের নমুণায় এই ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে৷ তবে কর্তৃপক্ষ বলছে তারা যত নমুনা পরীক্ষা করেছেন সেটি উপসংহারে পৌঁছানোর মতো যথেষ্ট নয়৷
ছবি: Pradeep Gaur/ZUMA Wire/imago images
টিকায় কি কাজ হচ্ছে?
অন্তত দুইটি গবেষণা বলছে ভ্যারিয়েন্টের এল৪৫২আর রূপটি অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এড়িয়ে যেতে পারে৷ তবে এর একটি এখনও অপ্রকাশিত এবং অ্যাকাডেমিকভাবে পিআর রিভিউ সম্পন্ন হয়নি৷
ছবি: Anindito Mukherjee/Getty Images
অতিরঞ্জন হচ্ছে?
অনেকে অবশ্য বলতে চাইছেন ভ্যারিয়েন্টটি নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় যেসব তথ্য আসছে তার মধ্যে অতিরঞ্জন রয়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটির মাইক্রোবায়োলজি ও ইমিয়োনোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক জেরেমি পি কামিল তাদের একজন৷ তিনি বলেন, ‘‘এমন কোন নির্ভরযোগ্য গবেষণা নেই যেখানে বলা হয়েছে এল৪৫২ রূপটি সব ধরনের ইমিউনিটি বা অ্যান্টিবডিকে এড়াতে পারে৷’’ সেটি সম্ভব নয় বলেও মত তার৷