বাংলাদেশে ইসলামিক স্টেট (আইএস) আছে কি নেই এ নিয়ে বিতর্কের মধ্যে একের পর এক হামলা চলছেই৷ খোদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘বাংলাদেশে কোনো আইএস নেই৷ কিছু জেএমবি ধরা পড়ে, আবার ছাড়া পায় তারাই এসব করছে৷''
বিজ্ঞাপন
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার চককানু গ্রামে বন্দুকধারীরা শিয়া সম্প্রদায়ের একটি মসজিদে এশার নামাজের প্রস্তুতিকালে মুসল্লিদের ওপর হামলা চালায়৷ তাদের এলোপাতাড়ি গুলিতে মসজিদের মুয়াজ্জিন মোয়াজ্জেম হোসেন নিহত এবং ইমামসহ তিনজন গুরুতর জখম হন৷ এই হামলার দায়ও ‘স্বীকার' করেছে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট৷ বিভিন্ন জঙ্গি গোষ্ঠীর ইন্টারনেটভিত্তিক তৎপরতা নজরদারির যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েবসাইট ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ' এমনটাই বলছে৷ ওয়েবসাইটটি বৃহস্পতিবার আইএসের এই দাবির কথা জানায়৷ এর আগেও দুই বিদেশি হত্যা ও পুরনো ঢাকায় শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতিকালে হামলার ঘটনায় আইএসের দায় স্বীকার করার কথা জানিয়েছিল ‘সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপ'৷
তবে বৃহস্পতিবার পুলিশ দাবি করেছে, পুরনো ঢাকার হোসেনি দালানে হামলার প্রধান সমন্বয়কারী মাহফুজ ওরফে শাহাদাত ওরফে আলবানী গত বুধবার গভীর রাতে রাজধানীর গাবতলী এলাকায় ডিবির সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হয়েছেন৷ নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির একটি অংশ ওই হামলা চালায়৷ নিহত আলবানী জেএমবির ওই অংশটির সামরিক প্রধান৷ পুলিশের দাবি, জামায়াত-শিবির থেকে আসা একদল নতুন সদস্য জেএমবির ওই অংশটির অর্থ জোগান দিয়ে আসছে৷ ওই অংশটিই ৪ নভেম্বর আশুলিয়ায় একটি তল্লাশি চৌকিতে এক পুলিশ সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এরাই গত এপ্রিল মাসে আশুলিয়ার কমার্স ব্যাংকের শাখায় ডাকাতির চেষ্টা চালিয়ে সাতজনকে হত্যা করেছিল৷ রংপুরে কুপিয়ে মাজারের খাদেমকে হত্যা এবং সৈয়দপুরে ইমামবাড়ার খাদেমকে জখম করার সঙ্গেও এই অংশটির সদস্যরা জড়িত বলে দাবি পুলিশের৷
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (গোয়েন্দা) মনিরুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, সাম্প্রতিককালে যে ঘটনাগুলো ঘটছে এর সঙ্গে শিবির থেকে আসা জেএমবির একটি অংশের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলেছে৷ এদের বেশ কিছু সদস্য পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে৷ এখনো অনেক সদস্য বাইরে রয়েছে৷ তাদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে৷ তিনি বলেন, জামায়াত শিবিরের কাছে থেকেই তারা আপাতত ফান্ড পাচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি৷
বাংলাদেশে জঙ্গি হামলার শিকার যারা
চলতি বছর ইসলামপন্থিরা একের পর এক হামলা চালিয়ে বাংলাদেশকে কাঁপিয়ে দিয়েছে৷ এতে প্রাণ হারিয়েছেন বেশ কয়েকজন৷ চলুন জানা যাক ২০১৫ সালের কবে, কারা হামলার শিকার হয়েছেন...৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্লগার খুন
একুশে বইমেলা থেকে ফেরার পথে ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে খুন হন ব্লগার এবং লেখক অভিজিৎ রায়৷ কমপক্ষে দুই দুর্বৃত্ত তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এসময় তাঁর স্ত্রী বন্যা আহমেদও গুরুতর আহত হন৷ বাংলাদেশি মার্কিন এই দুই নাগরিককে হত্যার দায় স্বীকার করেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’৷ পুলিশ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
বাড়ির সামনে খুন
ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান বাবুকে হত্যা করা হয় ঢাকায়, গত ৩০ মার্চ৷ তিন দুর্বৃত্ত মাংস কাটার চাপাতি দিতে তাঁকে কোপায়৷ সেসেময় কয়েকজন হিজরে সন্দেহভাজন দুই খুনিকে ধরে ফেলে, তৃতীয়জন পালিয়ে যায়৷ আটকরা জানায়, তারা মাদ্রাসার ছাত্র ছিল এবং বাবুকে হত্যার নির্দেশ পেয়েছিল৷ কে বা কারা এই হত্যার নির্দেশ দিয়েছে জানা যায়নি৷ বাবু ফেসবুকে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিরুদ্ধে লিখতেন৷
ছবি: Munir Uz Zaman/AFP/Getty Images
সিলেটে আক্রান্ত মুক্তমনা ব্লগার
শুধু ঢাকায় নয়, ঢাকার বাইরে ব্লগার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে৷ গত ১২ মে সিলেটে নিজের বাসার কাছে খুন হন নাস্তিক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট এবং ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস৷ ভারত উপমহাদেশের আল-কায়েদা, যাদের সঙ্গে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’-এর সম্পর্ক আছে ধারণা করা হয়, এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷ দাস ডয়চে ভেলের দ্য বব্স জয়ী মুক্তমনা ব্লগের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/EPA/Str
বাড়ির মধ্যে জবাই
ব্লগার নিলয় চট্টোপাধ্যায়কে, যিনি নিলয় নীল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, হত্যা করা হয় ঢাকায় তাঁর বাড়ির মধ্যে৷ একদল যুবক বাড়ি ভাড়ার আগ্রহ প্রকাশ করে ৮ আগস্ট তাঁর বাড়িতে প্রবেশ করে এবং তাঁকে কুপিয়ে হত্যা করে৷ নিজের উপর হামলা হতে পারে, এমন আশঙ্কায় পুলিশের সহায়তা চেয়েছিলেন নিলয়৷ কিন্তু পুলিশ তাঁকে সহায়তা করেনি৷ ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’ এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে, তবে তার সত্যতা যাচাই করা যায়নি৷
ছবি: Getty Images/AFP/Uz Zaman
জগিংয়ের সময় গুলিতে খুন বিদেশি
গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে জগিং করার সময় ঢাকার কূটনৈতিক এলাকায় খুন হন ইটালীয় এনজিও কর্মী সিজার তাবেলা৷ তাঁকে পেছন থেকে পরপর তিনবার গুলি করে দুর্বৃত্তরা৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস এই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে বলে দাবি করেছে জিহাদিদের অনলাইন কর্মকাণ্ডের দিকে নজর রাখা একটি সংস্থা৷ তবে বাংলাদেশে সরকার এই দাবি অস্বীকার করে বলেছে ‘এক বড় ভাইয়ের’ তাঁকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo/ A.M. Ahad)
রংপুরে নিহত এক জাপানি
গত ৩ অক্টোবর রংপুরে খুন হন জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও৷ মুখোশধারী খুনিরা তাঁকে গুলি করার পর মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায়৷ ইসলামিক স্টেট এই হত্যাকাণ্ডেরও দায় স্বীকার করেছে, তবে সরকার তা অস্বীকার করেছে৷ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বাস করেন না যে তাঁর দেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠীটির উপস্থিতি রয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
হোসনি দালানে বিস্ফোরণ, নিহত ১
গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার ঐতিহ্যবাহী হোসনি দালানে শিয়া মুসলমানদের আশুরার প্রস্তুতির সময় বিস্ফোরণে এক কিশোর নিহত এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হন৷ বাংলাদেশে এর আগে কখনো শিয়াদের উপর এরকম হামলায় হয়নি৷ এই হামলারও দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট, তবে সরকার সে দাবি নাকোচ করে দিয়ে হামলাকারীরা সম্ভবত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি গোষ্ঠী জেএমবি-র সদস্য৷ সন্দেহভাজনদের একজন ইতোমধ্যে ক্রসফায়ারে মারা গেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Zaman
ঢাকায় প্রকাশক খুন
গত ৩১ অক্টোবর ঢাকায় দু’টি স্থানে কাছাকাছি সময়ে দুর্বৃত্তরা হামলা চালায়৷ এতে খুন হন এক ‘সেক্যুলার’ প্রকাশক এবং গুরুতর আহত হন আরেক প্রকাশক ও দুই ব্লগার৷ নিহত প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনের সঙ্গে ঢাকায় খুন হওয়া ব্লগার অভিজিৎ রায়ের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ জঙ্গি গোষ্ঠী ‘আনসার-আল-ইসলাম’ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/M. Uz Zaman
প্রার্থনারত শিয়াদের গুলি, নিহত ১
গত ২৭ নভেম্বর বাংলাদেশের বগুড়ায় অবস্থিত একটি শিয়া মসজিদের ভেতরে ঢুকে প্রার্থনারতদের উপর গুলি চালায় কমপক্ষে পাঁচ দুর্বৃত্ত৷ এতে মসজিদের মুয়াজ্জিন নিহত হন এবং অপর তিন ব্যক্তি আহত হন৷ তথকথিত ইসলামিক স্টেট-এর সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততা দাবি করা স্থানীয় একটি গোষ্ঠী হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
9 ছবি1 | 9
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা রহমান জিয়াদ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘নাশকতার আশঙ্কার কারণে সরকার সামাজিক যোগাযোগের সাইটগুলো বন্ধ রেখেছে৷ কিন্তু তাতেও কী কাজ হল? এর মধ্যেও তো বগুড়ায় হামলা হল৷'' তাঁর দাবি, আসলে এগুলো বন্ধ রেখে কিছু হবে না৷ এর জন্য সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে আরো সক্রিয় হতে হবে৷ পাশাপাশি মূল অপরাধীদের খুঁজে বের করতে হবে৷ শুধু ব্লেম-গেমের রাজনীতি করলে হবে না৷ এসব থেকে বেরিয়ে এসে নাশকতার সঙ্গে যারা জড়িত বা তাদের মদদদাতাদের ধরতে হবে৷
এদিকে বাংলাদেশে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মুক্তচিন্তার ওপর গুরুত্ব দিয়ে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট৷ গত বৃহস্পতিবার ইউরোপীয় পার্লামেন্টে পাস হওয়া এক প্রস্তাবে সরকারের প্রতি এ আহ্বান জানানো হয়েছে৷ বাংলাদেশে মানবাধিকার ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র ও আইনের শাসন নিয়ে উদ্বেগের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের সাতটি পৃথক রাজনৈতিক গোষ্ঠী গত মঙ্গলবার আলাদা আলাদাভাবে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছিল৷ পরে ওই সাতটি প্রস্তাবের বিষয়গুলো নিয়ে যৌথ প্রস্তাবনার ওপর আলোচনার পর একটি অভিন্ন অবস্থানের ওপর সুপারিশের ভিত্তিতে প্রস্তাব গৃহিত হয়৷