ব্রিটিশ বিমানবাহিনীর ড্রোন হামলায় তিনজন ব্রিটিশ জিহাদি জঙ্গির মৃত্যুর খবর লন্ডনে তুমুল বিতর্কের সৃষ্টি করেছে৷ গ্রেহেম লুকাস মনে করেন, এক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তা স্বার্থের সঙ্গে প্রচলিত আইনের বড় রকমের সংঘাত দেখা দিচ্ছে৷
ছবি: Reuters/W. Rattay
বিজ্ঞাপন
প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাইকেল ফ্যালন ইতিমধ্যেই স্বীকার করেছেন যে, তাঁর সরকারের কাছে ইসলামি জঙ্গিদের এক তালিকা রয়েছে, যাদের উপর হামলার পরিকল্পনা রয়েছে৷ তালিকায় সেই সব চরমপন্থিদের নাম রয়েছে, যারা শয়ে শয়ে ব্রিটেন ছেড়ে সিরিয়া ও ইরাকে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এ যোগ দিতে গেছে৷ তাদের একজনের নাম ‘জিহাদি জন'৷ ব্রিটেনের নাগরিক এই জঙ্গি প্রকাশ্যে আইএস-এর হাতে বন্দিদের শিরশ্ছেদ করেছে এবং নৃশংস ও ক্ষমার অযোগ্য সেই অপরাধের ভিডিও ইন্টারনেটে প্রকাশ করেছে৷
ডিডাব্লিউ-র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের প্রধান গ্রেহেম লুকাস
এখন প্রশ্ন হলো, এর কোনো বিকল্প রয়েছে কি? কোনো প্রধানমন্ত্রী কি নিরাপত্তা সংস্থাগুলির প্রধানদের পরামর্শ উপেক্ষা করতে পারেন? তিনি কি নিজের দেশে সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি নিতে পারেন? উত্তরটা অবশ্যই ‘না'৷ আমরা সবাই জানি, আইএস কী ভয়ংকর হতে পারে৷ আমরা জানি, তারা আমাদের ধ্বংস করে দিতে চায়৷ কোনো নেতার পক্ষে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া অত্যন্ত কঠিন৷ এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই৷ সম্ভাব্য হুমকির মুখে এমন হামলা আইনত সম্পূর্ণ বৈধ – এটাই সরকারের অবস্থান৷
অন্যদিকে আইএস-এর নৃশংসতা ও বিকৃতি আমাদের বিচারবুদ্ধির উপর কালো ছায়া ফেলুক এবং আমরাও ভাবনাচিন্তা না করেই প্রতিক্রিয়া দেখাই – এমনটাও কাম্য হতে পারে না৷ ব্রিটেনের বিরোধী লেবার পার্টি সরকারের আচরণ ও আইনি পরিস্থিতি সম্পর্কে যে স্পষ্টতা দাবি করেছে, তা সম্পূর্ণ ঠিক৷ একমাত্র ক্ষমতাকেন্দ্রে হাতে গোনা কিছু মানুষের হাতে থাকা গোপন প্রমাণের ভিত্তিতে যদি দিনের পর দিন এভাবে আকাশ থেকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়, সেক্ষেত্রে অত্যন্ত বিপজ্জনক এক প্রবণতা সৃষ্টি হবে৷ তখন ‘বিগ ব্রাদার'-এর খবরদারির ধারণা আরও বাস্তব হয়ে পড়বে৷
আইএস কী, কোথায় এবং কেন?
প্রতিদিনই খবরে আইএস৷ কোনোদিন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য, কোনোদিন হয়তো ইরাক বা সিরিয়ায় কোনো অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার জন্য৷ আইএস বলছে, ইসলামি খেলাফত কায়েম করার জন্য যুদ্ধে নেমেছে তারা৷ ছবিঘরে আইএস সম্পর্কে কিছু তথ্য....
ইসলামিক স্টেট বা আইএস আসলে কী?
আল কায়েদা থেকে তৈরি হওয়া সুন্নি মুসলমানদের জঙ্গি সংগঠন আইএস৷ সাদ্দাম পরবর্তী সময়ে ইরাকে এবং বাশার আল আসাদের আমলে সিরিয়ায় সুন্নিদের হতাশা থেকেই জন্ম সংগঠনটির৷ আইএস-এর পতাকায় লেখা থাকে, ‘মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর নবী’ এবং ‘আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই৷’
ছবি: AP
আইএস কোথায় সক্রিয়?
শরিয়া আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে এমন রাষ্ট্র, বা ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চায় আইএস৷ সিরিয়া এবং ইরাকেই প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় তারা৷ দুটি দেশেই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সুযোগে বেশ বড় অঞ্চল দখল করে নিয়েছে আইএস৷
আইএস কেন আলাদা?
মূলত নিষ্ঠুরতার জন্য৷ শত্রুপক্ষ এবং নিরীহ মানুষের মনে আতঙ্ক ছড়াতে তারা এমন বর্বরতা এবং নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে যা আগে কেউ করেনি৷ জবাই করে ভিডিও প্রচার, পুড়িয়ে মারা, বাবার সামনে মেয়েকে জবাই করা এবং তার তার ভিডিও প্রচার, মেয়েদের যৌনদাসী বানানো আর পণ্যের মতো বিক্রি করা – এসব নিয়মিতভাবেই করছে আইএস৷ কোনো অঞ্চল দখলে নেয়ার পর সেখানে শাসন প্রতিষ্ঠায় মন দেয় আইএস৷
ছবি: gebphotography - Fotolia.com
অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক
আইএস যদিও শুধু সিরিয়া এবং ইরাকেই সক্রিয়, তবে বিশ্বের অন্যান্য ইসলামি জঙ্গি সংগঠনগুলো থেকে বিচ্ছিন্ন নয়৷ নাইজেরিয়ার জঙ্গি সংগঠন বোকো হারাম কয়েকদিন আগেই জানিয়েছে, আইএস-কে তারা সমর্থন করে৷ দুটি সংগঠনের মধ্যে একটি জায়গায় মিলও আছে৷ আইএস-এর মতো বোকো হারামও নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতার প্রতিভূ হয়ে উঠেছে৷ অন্য ধর্মের নারীদের প্রতি দুটি সংগঠনের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আচরণই মধ্যযুগীয়৷
ছবি: Getty Images/A. Katib
আইএস-এর অনুসারী কারা?
অনুসারী সংগ্রহের সাফল্যেও আইএস অন্য সব জঙ্গি সংগঠনের চেয়ে আলাদা৷ এ পর্যন্ত অন্তত ২০ হাজার বিদেশী যোদ্ধা আইএস-এ যোগ দিয়েছে৷ তাদের মধ্যে ৪ হাজারই পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর অ্যামেরিকার৷
আইএস-কে রুখতে অন্য দেশগুলো কী করছে?
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বেশ কিছু পশ্চিমা এবং আরব দেশ সিরিয়া ও ইরাকে আইএস ঘাঁটির ওপর বিমান থেকে বোমা হামলা চালাচ্ছে৷ বিবিসির প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ পর্যন্ত সিরিয়ায় ১৪২২ এবং ইরাকে ২২৪২ বার হামলা হয়েছে৷ কোনো কোনো সরকার দেশের অভ্যন্তরেও কিছু ব্যবস্থা নিচ্ছে৷ সিরিয়া ফেরত অন্তত ৩০ জন সন্দেহভাজন জঙ্গির বিচার শুরু করবে জার্মানি৷ গত মাসে সৌদি পুলিশও ৯৩ জন সন্দেহভাজন আইএস জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করেছে৷
6 ছবি1 | 6
তথাকথিত জাতীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিবেচনার আড়ালে না থেকে ব্রিটেনের সরকারের উচিত সেই সব তথ্য প্রকাশ্যে আনা, যার ভিত্তিতে তারা এমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে৷ অনেক সংসদীয় কমিটি গোপনীয়তার বেড়াজালের মধ্যে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় চর্চা করে৷ অন্তত সেই সব সংসদ সদস্যদের এমন সিদ্ধান্ত আগেভাগেই পরীক্ষা করার ক্ষমতা থাকা উচিত৷ একমাত্র এভাবেই মানুষ নিশ্চিত হতে পারে, যে সরকার নাগরিক অধিকার খর্ব করছে না৷ ইসলামিক স্টেট-এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম আমাদের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ক্ষতি করুক – সেটা আমরা হতে দিতে পারি না৷