সার্বিক জাতীয় স্বার্থের দোহাই দিয়ে তুরস্কের সরকার এতকাল জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম থেকে দূরে ছিল৷ সোমবারের আত্মঘাতী সন্ত্রাসী হামলার পর এই নীতি দেশে-বিদেশে প্রবল চাপের মুখে পড়েছে৷
বিজ্ঞাপন
জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট-এর তৎপরতা সম্পর্কে তুরস্কের নীতি নিয়ে এতকাল অনেক সমালোচনা শোনা গেছে৷ প্রেসিডেন্ট রেচেপ তাইয়িপ এর্দোয়ান ও তাঁর রক্ষণশীল ইসলামি আক পার্টি আইএস-এর সঙ্গে শত্রুতার পথ এড়িয়ে যেতে চেয়েছিল বলে অভিযোগ উঠেছে৷ এবার তুরস্কের ভূখণ্ডেই আইএস-এর সন্ত্রাসী হামলা সেই অবস্থান বদলে দেবে কিনা, তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলছে৷
সোমবার তুরস্কের সীমান্তে সুরুচ শহরে এক আত্মঘাতী হামলায় ৩২ জন নিহত হবার পর এর্দোয়ান সরকারের উপর চাপ বাড়ছে৷ এই হামলার প্রেক্ষাপট নিয়ে তুরস্কের সংবাদমাধ্যমে নানা মত উঠে আসছে৷ একদল মনে করে, সীমান্তের অপর প্রান্তে কোবানে শহর দখলের পর কুর্দিদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নিতে আইএস এই হামলা চালিয়েছে৷ তুরস্কের সরকারকে বিব্রত করা হামলার লক্ষ্য ছিল না৷ সরকার কিন্তু এই প্রথম সরাসরি আইএস-কে হামলার জন্য দায়ী করেছে৷ হামলাকারীর পরিচয়ও জানা গেছে বলে সরকার দাবি করছে৷ প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভোতলু অবশ্য এ বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বলেননি৷ উল্লেখ্য, সম্প্রতি বিভিন্ন শহরে আইএস-এর প্রতি সহানুভূতির দায়ে অনেককে আটক করা হয়েছে৷
আসলে দক্ষিণ সীমান্তে কুর্দি বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ প্রশাসনকে বড় হুমকি বলে মনে করে তুরস্ক৷ তাই বিশেষ ভৌগোলিক গুরুত্ব সত্ত্বেও আইএস-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে মার্কিন নেতৃত্বে কোয়ালিশনে ন্যাটোর সদস্য তুরস্কের ভূমিকা অত্যন্ত শিথিল৷ এমনকি দেশের দক্ষিণে সামরিক ঘাঁটি থেকে বোমারু বিমান উৎক্ষেপণের অনুমতিও দেয়নি সরকার৷ তুরস্কের মতে, শুধু ব়্যাডিকাল ইসলামপন্থিদের উপর বোমা বর্ষণ করলে শান্তি আসবে না – বাশার আল-আসাদকেও ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে৷ অনেক পর্যবেক্ষকের মতে, আসাদ ক্ষমতাচ্যুত হলে ইসলামপন্থি জোটকে সিরিয়ার ক্ষমতাকেন্দ্রে দেখতে চায় তুরস্ক৷ এ ভাবেই আইএস-কে দূরে রাখা সম্ভব বলে সে দেশের সরকারের ধারণা৷
আইএস বিরোধী লড়াইয়ের আঁচ জার্মানিতে
গত জুন মাসে ইরাকের মোসুল দখল করে নেয় ইসলামিক স্টেট (আইএস বা আইসিস)৷ চরমপন্থি ইসলামি সংগঠনটির লক্ষ্য, মধ্যপ্রাচ্যের একটা অংশে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা৷ এদিকে আইএস-এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আঁচ লেগেছে জার্মানিতেও৷ দেখুন ছবিঘরে৷
ছবি: Aris Messinis/AFP/Getty Images
জার্মানিতে সংঘর্ষ
সুদূর ইরাক ও সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট জঙ্গিদের তৎপরতার আঁচ জার্মানিতেও দেখা যাচ্ছে৷ উত্তরের হামবুর্গ ও সেলে শহরে মঙ্গলবার (০৭.১০.১৪) কুর্দি ও ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষের সঙ্গে উগ্রপন্থি মুসলমানদের সংঘর্ষে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Markus Scholz
গনসচেতনতার উদ্যোগে বাধা
জার্মানিতে বসবাসরত কুর্দি ও ইয়াজিদি সম্প্রদায়ের মানুষ সিরিয়া ও ইরাকে আইএস জঙ্গিদের তৎপরতা সম্পর্কে গণসচেতনতা বাড়াতে গত কয়েক মাস ধরে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সমাবেশের আয়োজন করেছে৷ কখন উগ্রপন্থিরা তাদের বাধা দিচ্ছে৷
ছবি: Getty Images/Alexander Koerner
কোবানিতে তীব্র লড়াই
এদিকে সিরিয়ার কোবানি বা আইন আল-আরব শহরে আইএস জঙ্গিদের ব্যাপক হামলা চলছে৷ প্রাণ বাঁচাতে এক লাখেরও বেশি সিরীয় কুর্দি এলাকা ছেড়েছে৷ অধিকাংশই আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী দেশ তুরস্কে৷ আইএস জঙ্গিদের প্রতিরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে কুর্দিদের আধা সামরিক বাহিনী ওয়াইপিজি৷
ছবি: picture-alliance/dpa/EPA/SEDAT SUNA
আপাতত রক্ষা
কুর্দি এই নারী তাঁর দুই মেয়েকে নিয়ে আইন আল-আরব থেকে পালিয়ে এসেছেন৷ সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলীয় শহরটিতে আইএস-এর হামলা তীব্র হওয়ার পরপরই তাঁরা তুরস্কে আশ্রয় নেন৷
ছবি: DW/Alice Martins
আতঙ্ক
তখনও আইন আল আরব সীমান্তে চলছে তীব্র লড়াই৷ এই কুর্দি পরিবার আইন আল-আরব থেকে এসে তুরস্কের সীমান্তে অপেক্ষা করছে৷ ইরাকে কুর্দি নারীদের আইএস যেভাবে তুলে নিয়ে বিক্রি করেছে, তাড়াতাড়ি পালাতে না পারলে তাঁদেরও একই পরিণতি হতে পারে এই আতঙ্ক গ্রাস করেছে তাঁদের৷
ছবি: DW/Alice Martins
অসহায়ত্ব
তুরস্কেও ভালো নেই আইন আল-আরব ছেড়ে আসা কুর্দিরা৷ খাবারদাবার, এমনকি খাওয়ার পানিও ঠিকমতো জোটে না৷ একটি সংগঠন তাই চাঁদা তুলে পানির বোতল কিনে এনে বিতরণ করছে শরণার্থীদের মাঝে৷
ছবি: DW/Alice Martins
দীর্ঘ অপেক্ষা
প্লাস্টিকের ব্যাগে কিছু খাবার নিয়ে এসেছেন একজন৷ আইন আল-আরব ছেড়ে আসা সিরীয়দের সে খাবারগুলো দিতে চান৷ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে্ তুরস্কের সেনাবাহিনী৷ তাঁদের বোঝানোর চেষ্টা চলছে৷ ওদিকে খাবারের জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছে শরণার্থীরা৷
ছবি: DW/Alice Martins
যাত্রী চাই
সিরীয় শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়ার জন্য সীমান্ত খুলে দিয়েছে তুর্কি সরকার৷ এক মিনিবাস চালক তাই যাত্রীর অপেক্ষায়৷ শরণার্থীদের কেউ যদি তাঁর মিনিবাসে ওঠেন, তাতে নিজের তো সামান্য কিছু আয় হবেই, শরণার্থীদেরও উপকার হবে৷ জাতিসংঘের হিসেব অনুযায়ী, এ পর্যন্ত প্রায় ১৩ লাখ সিরীয় তুরস্কে আশ্রয় নিয়েছে৷
ছবি: DW/Alice Martins
মধ্যপ্রাচ্যে কর্তৃত্ব চায় আইএস
আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে আইএস বা আইসিস-এর একসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ ২০০৬ থেকে ২০০৭-এর দিকে ইরাকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই চলছে তখনই আইএস-এর জন্ম৷ সংগঠনটির লক্ষ্য সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং জর্ডান মিলিয়ে বেশ বড় একটা অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
আইএস-এর বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদ আর ইরাকে নুরি আল-মালিকির সাবেক সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট বিদ্রোহীদেরই পাশে ছিল৷ সিরিয়ায় ন্যাশনাল কোয়ালিশনের মতো কিছু মধ্যপন্থি সংগঠনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন রয়েছে৷ তবে ওবামা সরকার এখন আইএস-এর বিরুদ্ধে৷ জঙ্গি সংগঠনটিকে নিশ্চিহ্ন করার অঙ্গীকার নিয়ে ইরাক ও সিরিয়ায় চলছে যুক্তরাষ্ট্রের বিমান হামলা৷
ছবি: picture alliance/dpa/Matthew Bruch
এবার আইন আল-আরব?
সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত আইন আল-আরব সাধারণের কাছে ‘কোবানি’ নামেই পরিচিত৷ তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তের এ শহরের একটা অংশ এখন আইএস-এর দখলে৷ এবার কি তবে আইন আল-আরবও দখল করে নেবে আইএস? তারপর?
ছবি: Aris Messinis/AFP/Getty Images
11 ছবি1 | 11
এ দিকে আইএস-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে সিরিয়া ও ইরাকের কুর্দি যোদ্ধারা অ্যামেরিকার সমর্থন পেয়ে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে৷ তুরস্কের সীমান্তে সিরীয় ভূখণ্ডও এই মুহূর্তে কুর্দি ওয়াইপিজি মিলিশিয়া গোষ্ঠীর দখলে রয়েছে৷ তুরস্কের সংখ্যালঘু কুর্দিরাও এর ফলে উৎসাহিত হয়ে উঠতে পারে এবং পিকেকে জঙ্গি গোষ্ঠীর নেতৃত্বে তাদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা বাড়তে পারে বলে সরকার আশঙ্কা করছে৷ তাছাড়া কুর্দিদের আধিপত্যের ফলে গোটা অঞ্চলের চরিত্র বদলে যেতে পারে৷ তাই আইএস অথবা ওয়াইপিজি মিলিশিয়া – কোনো গোষ্ঠীকেই তারা সিরিয়া সীমান্তে দেখতে চায় না৷
সুরুচ শহরে সন্ত্রাসী হামলার পর ইস্তানবুল শহরে মঙ্গলবার কুর্দি বিক্ষোভকারীরা সরকারের সিরিয়া-নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছে৷ পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে৷