এক সময় সিরিয়ায় আইএস জঙ্গি সংগঠনে যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের ছেলেমেয়েরা। সন্তানদের দেশে ফেরানোর লড়াই চলাচ্ছেন তাঁদের বাবা-মায়েরা।
বিজ্ঞাপন
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে সে দেশে ক্রমশ শক্তিবৃদ্ধি করে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিরা। মধ্য প্রাচ্য তো বটেই, ইউরোপ থেকেও বহু মানুষ সে সময় যোগ দিয়েছিলেন আইএস জঙ্গিদের সংগঠনে। এখন যাঁদের অনেকেই সিরিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক। ফ্রান্স-সহ বহু দেশ সেই আটক ব্যক্তিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু করেছে। যদিও আটক ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ, যতটা গুরুত্ব সহকারে সরকারের এ কাজ করা উচিত ছিল, তা করা হচ্ছে না। অনেকে ক্যাম্প থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন বলেও অভিযোগ।
ফ্রান্সে ট্রেড-ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আন্তোনিয়ো (আসল নাম নয়)। দীর্ঘ দিন শ্রমিকদের জন্য আন্দোলন করেছেন তিনি। বছর পাঁচেক আগে আচমকাই তাঁর মেয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যান। বেশ কিছুদিন অপেক্ষার পরে আন্তোনিয়ো জানতে পারেন, তিউনিশিয়ার বন্ধুর সঙ্গে সিরিয়ায় চলে গিয়েছেন তাঁর মেয়ে। যোগ দিয়েছেন আইএসশিবিরে। আন্তোনিয়ো জানিয়েছেন, বাড়ি ছাড়ার কিছু দিন আগেই ধর্ম পরিবর্তন করেছিলেন তাঁর মেয়ে। তাঁর ধারণা, তিউনিশিয়ার ওই বন্ধুর মাধ্যমেই আইএস জঙ্গিদের সংস্পর্শএ এসেছিলেন তিনি।
আন্তোনিয়ো খবর পেয়েছেন, কিছু দিন আগে কুর্দ ক্যাম্পে আটক করা হয়েছে তাঁর ২৬ বছরের মেয়েকে। একটি বাচ্চাও হয়েছে তাঁর। খবর পাওয়ার পর থেকেই মেয়েকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা শুরু করেছেন আন্তোনিয়ো। কিন্তু তারই মধ্যে খবর আসে ক্যাম্প থেকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছেন তাঁর মেয়ে। বিষয়টি ফরাসি সরকারকেও জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু অভিযোগ ফরাসি সরকার যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে বিষয়টি দেখছে না।
আইএস এখনো যেসব দেশের জন্য হুমকি
মার্কিন সামরিক অভিযানে জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) নেতা আবু বকর আল বাগদাদি নিহত হয়েছেন৷ তবে এখনও অনেক দেশের জন্য এই জঙ্গি গোষ্ঠীকে বড় হুমকি হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকরা৷
ছবি: dpa
ইরাক
দেশটিতে মার্কিন সমর্থিত বাহিনীর কাছে হেরে আইএস যোদ্ধারা গেরিলা যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে৷ এখনও তারা ইরাকের কয়েকটি প্রদেশে অপহরণ ও বোমাবাজি করছে৷ বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরাকে প্রায় দুই হাজার আইএস যোদ্ধা সহিংস তৎপরতা চালাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/Dabiq
সিরিয়া
ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সত্ত্বেও গত বছর সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে বেশ কয়েকটি আক্রমণ চালিয়েছে আইএস৷ অ্যামেরিকান বাহিনীকেও টার্গেট করেছে তারা৷ ইসলামিক স্টেটের যোদ্ধারা সিরিয়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মরুভূমিতে সক্রিয় রয়েছে৷
ছবি: DW/Judit Neurink
মিশর
বিগত এক বছরে মিশরে কোনো বড় আক্রমণ না হলেও দেশটিতে বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটছে৷ দেশটির সেনাবাহিনী বলছে, ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে সিনাই প্রদেশে অভিযানে কয়েকশ উগ্রপন্থি নিহত হয়েছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/K. Desouki
সৌদি আরব
সৌদি আরবে বেশ কয়েকটি বোমা বিস্ফোরণ এবং নিরাপত্তা বাহিনীসহ সংখ্যালঘু শিয়াদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে আইএস৷ সৌদি আরব যখন আইএসের বিরুদ্ধে প্রচারে অংশ নিয়েছিল তখন তাদের বিরুদ্ধেও আক্রমণ চালানোর আহ্বান জানিয়েছিল গোষ্ঠীটি৷ অ্যামেরিকান থিঙ্কট্যাঙ্ক সেন্টার ফর গ্লোবাল পলিসি বলছে, আইএস সৌদি আরবে এখনও সক্রিয় এবং সৌদি কর্তৃপক্ষ এ সম্পর্কে ভালো জানে৷
ছবি: dpa
ইয়েমেন
আইএস ২০১৪ সালের শেষদিকে ইয়েমেন শাখা ঘোষণা করে৷ হুতি বিদ্রোহী ও সৌদি আরব সমর্থিত আবদ রাব্বু মনসুর হাদির সরকারের মধ্যে গৃহযুদ্ধ চলছে৷ ইয়েমেনে আইএস আল কায়েদার সাথে লড়াই করছে এবং উভয় দল শিয়া হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধেও লড়ছে৷ দেশটিতে অনেক হামলা ও হত্যার দায় আইএস স্বীকার করলেও কোনো অঞ্চল তাদের দখলে নেই৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Souleiman
নাইজিরিয়া
বোকো হারাম ২০০৯ সাল থেকে উত্তর নাইজেরিয়ায় বেশ কয়েকটি বড় আক্রমণ চালিয়েছে৷ ২০১৬ সালে এই গোষ্ঠীকে দুইটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে, যার একটি অংশ আইএসের প্রতি অনুগত৷ আইএস পশ্চিম আফ্রিকায় গত বছর বেশ কয়েকটি সামরিক ঘাঁটিকে লক্ষ্যবস্তু করেছিল৷ এই অঞ্চলে গোষ্ঠীটির আধিপত্য বাড়ছে৷
ছবি: Getty Images/AFP/A. Marte
আফগানিস্তান
দেশটিতে ২০১৫ সাল থেকে সক্রিয় রয়েছে আইএস৷ এখনো নানগারহার প্রদেশে তাদের খুব শক্তিশালী মনে করা হয়৷ অ্যামেরিকান কমান্ডাররা বলছেন, আফগানিস্তানে প্রায় দুই হাজার আইএস যোদ্ধা তালেবানকে আক্রমণ করতে পারে৷
ছবি: picture-alliance/Xinhua/E. Waak
শ্রীলঙ্কা
এপ্রিলে শ্রীলঙ্কায় গির্জা ও হাসপাতালে বোমা হামলায় জড়িত ছিল বলে দাবি করে আইএস৷ শ্রীলঙ্কার কর্মকর্তারা বিস্ফোরণের জন্য তাদের সঙ্গে যুক্ত দুইটি স্থানীয় মুসলিম উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে দায়ি করেন৷ ওই বিস্ফোরণের পর আইএস একটি ভিডিও প্রকাশ করে যাতে আটজনকে তাদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে দেখা যায়৷
ছবি: Reuters/D. Siddiqui
ইন্দোনেশিয়া
বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম দেশটির হাজার হাজার মানুষ আইএসের আদর্শ থেকে অনুপ্রাণিত বলে জানা গেছে৷ ধারণা করা হয় প্রায় ৫০০ ইন্দোনেশিয়ান আইএসের পক্ষে লড়াইয়ে সিরিয়ায় গিয়েছিল৷ গত বছর সুরবায়ায় আত্মঘাতী হামলায় ৩০ জন নিহত হয়৷ ওই হামলার পেছনে আইএস এর মদদপুষ্ট জামাহ আনসারুত দৌলা সংগঠনটির হাত ছিল৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
ফিলিপাইন্স
ফিলিপাইন্সরা আশঙ্কা করছেন সিরিয়া ও ইরাক থেকে পালিয়ে আসা আইএস উগ্রপন্থিরা মিন্ডানাও প্রদেশের প্রত্যন্ত বন এবং মুসলিম গ্রামগুলোতে আশ্রয় নিতে পারে৷ এই অঞ্চলটি নৈরাজ্য, বিশৃঙ্খলা, বিচ্ছিন্নতাবাদ এবং ইসলামী বিদ্রোহের কারণে কুখ্যাত৷ এই অঞ্চলে সংঘটিত হামলা এবং সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের জন্য আইএস দায় নিলেও তার যথার্থতা নিশ্চিত হওয়া যায়নি৷
ছবি: Reuters/Handout
10 ছবি1 | 10
ফ্রান্সে আইএস-এ যোগ দেওয়া ছেলেমেয়েদের পরিবারগুলি একটি সংগঠন তৈরি করে ফেলেছে। ছেলেমেয়েদের ফিরিয়ে আনার জন্য যারা লাগাতার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই দলের সদস্যদের বক্তব্য, প্রায় পাঁচ হাজার ছেলেমেয়ে কেবল ইউরোপ থেকেই আইএস-এ যোগ দিতে গিয়েছিলেন। ফ্রান্স থেকে গিয়েছিলেন প্রায় দেড় হাজার জন। তাঁদের অনেকেই এখন বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি। তবে ক্যাম্প থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার খবরও পাচ্ছেন অনেকে। অনেকেরই ধারণা, কুর্দরা এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে সরিয়ে নিচ্ছে তাঁদের।
ফরাসি সংগঠনের সদস্যদের বক্তব্য, তঁদের ছেলেমেয়েরা আআইএস-এ যোগ দিয়ে কী কী অপরাধমূলক কাজ করেছে, তা তাঁদের জানা নেই। অপরাধের শাস্তি তাঁদের পাওয়া উচিত, এ কথা মানেন তাঁরা। কিন্তু একই সঙ্গে তাঁদের বিচার যাতে নিরপেক্ষ হয়, সে বিষয়েও সরব তাঁরা। সে জন্যই ছেলেমেয়েদের দেশে ফিরিয়ে এনে বিচার প্রক্রিয়া চালানোর দাবি করা হচ্ছে।
ফরাসি সরকারের বক্তব্য, সিরিয়া থেকে অনেককেই ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া জারি আছে। তবে কাজটি করতে সময় লাগবে। সিরিয়ার এখনও যা পরিস্থিতি, তাতে দ্রুত কাউকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়। কিন্তু সংগঠনটির বক্তব্য, সরকার ছেলেমেয়েদের ফিরিয়ে আনতে আদৌ আগ্রহী নয়।
কিন্তু কেন ফিরে আসতে চাইছেন ওই ফরাসি নাগরিকরা? এক সময় পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে যাঁরা আইএস জঙ্গি সংগঠনে নাম লিখিয়েছিলেন, কেন তাঁরা দেশে ফিরে আসতে চাইছেন? আইএস ক্যাম্প থেকে পালিয়ে আসা এমন অনেকেরই বক্তব্য, তাঁদের সামনে কাচের স্বর্গ তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু সিরিয়ায় গিয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন, কী অবর্ণনীয় ঘটনা চলছে সেখানে। বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে ফের তাঁরা দেশে ফেরার চেষ্টা শুরু করেন। কেউ ফিরতে পেরেছেন, কেউ পারেননি। ছেলেমেয়ে হারানো পরিবারগুলির আশা, একবার ফিরিয়ে আনতে পারলে নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবেন তাঁদের সন্তানরা।