সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারক ও আইনজীবীদের মধ্যে বিবাদকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে৷ প্রশ্ন উঠেছে, বারের নেতারা কি বিচারকদের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছেন? কিভাবে এই পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব?
বিজ্ঞাপন
এসব বিষয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি মমতাজ উদ্দিন ফকির৷
মমতাজ উদ্দিন ফকির : না, না৷ একেবারে পরিপূরক৷ বার এবং বেঞ্চের সম্পর্ক মধুর থাকতে হবে৷
এই ধরনের ঘটনায় বিচারকদের উপর কী ধরনের প্রভাব পড়ে?
প্রভাবটা ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করে৷ এগুলো অনেক সময় টলারেন্সের উপর নির্ভর করে৷ কোনো সময় ভুল বোঝাবুঝি কারণে এটা হতে পারে, পরে এটা ঠিক হয়ে যায়৷ অবশ্যই একজন আরেকজনের পরিপূরক৷
একের পর এক এই ধরনের ঘটনা ঘটছে৷ উচ্চ আদালত একাধিকবার তাদের ডেকে সতর্কও করেছে৷ তারপরও কেন বন্ধ হচ্ছে না এই ঘটনাগুলো?
হবে৷ হয়ত আগেও হয়েছে৷ সবজায়গায় এগুলো আছে৷ পৃথিবীর অন্য জায়গায়ও এটা আছে৷ পরিবারেও এটা হয়৷ আপনার পরিবারেও দেখবেন সবাই একরকম হয় না৷ তার অর্থ এই নয় যে, পরিবার নষ্ট হয়ে যাবে৷
‘বিচারকদের মধ্যে সবাই তো দুধে ধোয়া না’
এই ধরনের ঘটনাগুলোতে বিচারপ্রার্থীদের যে দুর্ভোগ তা নিরসনে সুপ্রিমকোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা নেই কেন?
ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না- এটা ঠিক না৷ আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিমকোর্ট এটা নিয়ে তো ভাবছে৷ বিচার বিভাগ তো স্বাধীন৷ তারা স্বাধীনভাবে এগুলো নিয়ে চিন্তা করে৷ তারা নিশ্চয়ই এগুলো নিয়ে ভাবছে৷
আদালতের ভেতরের কর্মকাণ্ডের ছবি তোলা বা ভিডিও করা নিষিদ্ধ৷ কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনায় যে ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ পেয়েছে, সেটা কি আইনের লঙ্ঘন নয়?
এখন তো হাতে হাতে মোবাইল ফোন৷ এটা অবশ্যই লঙ্ঘন৷ কোনো ঘটনা ফেসবুকে দেওয়া হলে আরো উত্তেজনার সৃষ্টি করে৷ উদ্দেশ্যমূলকভাবে এগুলো করা হয়৷ এ জন্য কিন্তু বিভিন্ন সময় সতর্কও করা হয়৷ বলা হয়, ‘‘তোমরা এগুলো করো না’’৷ তারপরও করে৷ অনেক সময় দেখবেন রাস্তায় হাঁটছেন, আপনি জানেনও না, আপনার ছবি উঠানো হয়েছে৷ আগে কিন্তু অনুমতি ছাড়া কেউ ছবি তুলতে পারতো না৷ এখন তো এগুলো মানা হচ্ছে না৷ এখন তো হাতে হাতে মোবাইল, রাস্তায় সিসিটিভি ক্যামেরা আছে৷
বিচারব্যবস্থার উপর হামলার কিছু উদাহরণ
সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির বিরুদ্ধে এক বিচারককে ধমক দেয়ার অভিযোগ উঠেছে৷ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিচারব্যবস্থার উপর এমন হামলার তথ্য থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: Reuters/C. Barria
আইসিসির বিচারকদের যুক্তরাষ্ট্রের হুমকি
২০২০ সালের মার্চে আফগানিস্তানে নিয়োজিত মার্কিন বাহিনীসহ সব পক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত আইসিসি৷ এর প্রতিক্রিয়ায় মার্কিন প্রশাসন বলেছিল, আইসিসির যে বিচারকরা তদন্তের সঙ্গে যুক্ত হবেন তাদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ভিসা বাতিল কিংবা প্রত্যাখ্যান করা হবে৷
ছবি: Peter Dejong/AP Photo/picture alliance
ব্রাজিলে সুপ্রিম কোর্টে ভাঙচুর
ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর সমর্থকরা গত রোববার সুপ্রিম কোর্ট, কংগ্রেস, প্রেসিডেন্ট ভবনে হামলা চালায়৷ তারা সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন ঘরে ভাঙচুর করেন৷ তারা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বলসোনারোর হার মানতে পারছেন না৷ গতবছরের শুরুতে বলসোনারো সুপ্রিম কোর্টের দুজন বিচারকের নাম উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে তার (বলসোনারো) বিরোধিতা করার অভিযোগ এনেছিলেন৷
ছবি: Joedson Alves/AA/picture alliance
যুক্তরাষ্ট্রে বিচারকদের বিরুদ্ধে হুমকি বাড়ছে
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল বিচারকরা সাড়ে চার হাজারের বেশি হুমকি ও অন্যান্য অগ্রহণযোগ্য যোগাযোগের শিকার হয়েছিলেন৷ হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্ট ও সরকারবিরোধী অ্যাক্টিভিস্টদের কাছ থেকে হুমকি বেড়েছে বলে জানিয়েছে ইউএস মার্শালস সার্ভিস৷ একটি ঘটনায় একজন বিচারকের ছেলেকে হত্যা করা হয়৷ ছবিতে যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে অবস্থিত ‘লেডি জাস্টিস’ ভাস্কর্যে এক বিক্ষোভকারীকে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/C. Barria
পাকিস্তানে সুপ্রিম কোর্টে শরিফ সমর্থকদের প্রবেশ
১৯৯৭ সালে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে সুপ্রিম কোর্টে বিচার চলাকালে হাজার হাজার শরিফ সমর্থক কোর্ট ভবনে ঢুকে পড়েছিলেন৷ এই মামলাকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী শরিফ ও প্রধান বিচারপতি সাজ্জাদ আলি শাহের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছিল৷ পরিস্থিতি সামলাতে সেনাবনাহিনীর হস্তক্ষেপ চেয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি৷
ছবি: Aamir Qureshi/AFP/Getty Images
কলকাতায় বিচারপতির বিরুদ্ধে পোস্টার
সম্প্রতি কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি রাজাশেখর মান্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তার এজলাস বয়কটের পাশাপাশি অন্য আইনজীবীদের এজলাসে প্রবেশে বাধা দেয়ার অভিযোগ ওঠে তৃণমূল কংগ্রেস সমর্থক বলে পরিচিতি কিছু আইনজীবীর বিরুদ্ধে৷ মান্থা বারবার বিজেপির রাজনীতিবিদ এবং পশ্চিমবঙ্গে বিরোধীদল নেতা শুভেন্দু অধিকারীর ‘পক্ষে’ ও তৃণমূলের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্যালিকার ‘বিপক্ষে’ রায় দিচ্ছেন বলে মনে করেন তারা৷
ছবি: Jagannath Raul/Dinodia/IMAGO
পদত্যাগে বাধ্য হন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি
২০১৭ সালে বাংলাদেশের সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেওয়া রায়ে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন৷ তা নিয়ে সেই সময় ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সরকারপন্থি আইনজীবীরা৷ পরে সিনহা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন৷ এর কয়েক মাস পর দুর্নীতি দমন কমিশন তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে৷
ছবি: bdnews24.com
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিচারক অপদস্থ
সম্প্রতি প্রকাশিত এক ভিডিওতে দেখা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি তানভীর ভূঁইয়া দলবল নিয়ে গিয়ে এজলাসে বসা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ১-এর বিচারক মোহাম্মদ ফারুককে অপদস্থ ও গালাগাল করছেন৷ এই সময় তানভীরকে ধমকের সুরে বিচারক ফারুককে উদ্দেশ্য করে ‘নাম, নাম’ বলতে শোনা যায়৷ যদিও তিনি এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন কথাটি তিনি বিচারককে নয়, যে ভিডিও করছিল, তাকে বলেছেন৷
ছবি: Mortuza Rashed/DW
7 ছবি1 | 7
বারের নেতারা কি এই ঘটনাগুলোর মাধ্যমে বিচারকদের উপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন?
এটা আসলে ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করে৷ জুডিশিয়ারিতে যারা আছেন, তারা অবশ্যই চেষ্টা করেন যাতে বিচারপ্রার্থীদের ক্ষতি না হয়৷
বিচারকদের সহনশীল মনোভাবের অভাবেই কি বারবার এই ধরনের ঘটনা ঘটছে?
এটা সবার ক্ষেত্রে একরকম নয়৷ আমার যে টলারেন্স আছে, আরেকজনের জন্য সেটা হয়ত থাকবে না৷ এটা বিচারবিভাগের বিষয় না, ব্যক্তি বিশেষের উপর নির্ভর করে৷ পারসোনাল ইগোর কারণে কেউ কিছু একটা করে থাকতে পারে৷ বিচারকদের মধ্যে সবাই তো দুধে ধোয়া না৷ এটার জন্য আইনজীবীরাও খারাপ না, বিচার বিভাগও খারাপ না৷ সাংবাদিকদের মধ্যেও একজন যেভাবে নম্র-ভদ্রভাবে চলেন, আরেকজন সেভাবে না-ও চলতে পারেন৷ পার্থক্য আছে না?
উচ্চ আদালত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ২১ জন আইনজীবীকে তলব করেছেন৷ এখানে কি আরো কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে উচ্চ আদালতের?
বিচারপতিরা তাদের কথা শুনবেন, তারপর সিদ্ধান্ত দেবেন৷
ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে তা নিশ্চিত করতে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?
বিচারক ও আইনজীবীদের মধ্যে সম্পর্ক ভালো থাকতে হবে৷ এই সম্পর্ক ভালো থাকলে সবার জন্য ভালো হবে৷ আইনজীবীরা ভালো থাকলে দেশ ভালো থাকবে৷ আমার পরামর্শ হলো, সবাই সবার জায়গা থেকে সতর্ক থাকবেন, আইন মেনে চলবেন৷ আইনজীবীদের সম্মানটা তাদের দিতে হবে৷ আর বিচারকদের সম্মানটা আমরা দেবো৷ বুঝতে হবে, একজন আরেকজনের পরিপূরক৷ এর ব্যত্যয় ঘটলে ক্ষতি হবে৷