আলব্যার্ট আইনস্টাইনের মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গের যে অস্তিত্ব আছে, ৪০ বছর গবেষণা চালিয়ে তারই প্রমাণ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷ ১৩০ কোটি বছর আগে দু'টি ব্ল্যাক হোলের ধাক্কা লাগার আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন তারা – মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গের কল্যাণে৷
বিজ্ঞাপন
একশ' বছরের বেশি আগে আলব্যার্ট আইনস্টাইন বলে গেছিলেন মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ থাকার সম্ভাবনার কথা – তাঁর যুগান্তকারী ‘জেনারেল থিওরি অফ রিলেটিভিটি' তত্ত্বের আনুষঙ্গিক হিসেবে৷
সহজ কথায়, পদার্থের অবস্থানের ফলে ‘স্পেস' অর্থাৎ ব্যাপ্তি, এবং ‘টাইম' অর্থাৎ সময় বা কাল যেভাবে বিকৃত হয়, তার পিছনে মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গের ভূমিকা আন্দাজ করেছিলেন আইনস্টাইন৷ স্পেস-টাইম কনটিনুয়াম, বা ব্যাপ্তি ও কালের যৌথ সত্তাকে একটি জালের মতো করে ভেবেছিলেন আইনস্টাইন; কোনো ভারী পদার্থ – একটা বলের মতো – সেই জালের ওপর পড়লে, জালটা ঝুলে পড়ে বা ঢেউ খায়, অর্থাৎ ব্যাপ্তি ও কাল বেঁকে যায়!
ঘটনাটা কী ঘটেছে
যে কোনো বস্তুর একটা ‘মাস' বা তার অভ্যন্তরীণ পদার্থের পরিমাপ থাকে৷ মাধ্যাকর্ষণ যখন সেই পদার্থকে টানে, তখন ‘মাস' গিয়ে দাঁড়ায় ‘ওয়েট' বা ওজনে৷ বস্তুটির আকারের তুলনায় তার ‘মাস' বা পদার্থ যদি অকল্পনীয় রকম বেশি হয়, এত বেশি যে, এমনকি আলোর ফোটনও সেই পদার্থের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ছাড়িয়ে বেরুতে পারবে না – কাজেই সেই বস্তুটি থেকে কোনো আলোকরশ্মি আমাদের পৃথিবীতে পৌঁছাবে না, ফলে আমরা দেখব – মহাকাশে একটি কালো গর্ত বা ব্ল্যাক হোল৷ আইনস্টাইন সে কল্পনাও করে গেছিলেন৷
এবার দেখা যাক, কী নিয়ে এত চেঁচামেচি৷ আর কিছু নয়, ১৩০ কোটি বছর আগে আমাদের সূর্যের ২৯ গুণ বেশি পদার্থধারী একটি ব্ল্যাক হোল, সূর্যের ৩৬ গুণ বেশি পদার্থধারী একটি ব্ল্যাক হোলের দিকে ঘুরপাক খেয়ে গিয়ে, শেষমেষ দু'টি ব্ল্যাক হোলের ধাক্কা লেগে, দু'টি ব্ল্যাক হোল পরস্পরের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল৷ পৃথিবী থেকে দেখা ব্রহ্মান্ডের দক্ষিণাংশের এই মহাজাগতিক ঘটনার শেষ সেকেন্ডের একটি ভগ্নাংশ ধরা পড়েছে যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা ও ওয়াশিংটনে রাখা যন্ত্রে৷
যাঁরা অনেক বেশি প্রশংসার যোগ্য
আলব্যার্ট আইনস্টাইনকে পদার্থবিদ এবং অঙ্ক বিশারদ হিসেবে তো চেনেন, কিন্তু অটিজম-এর মতো অক্ষমতাকে জয় করার কারণেও যে তিনি অনন্যসাধারণ, তা কি জানেন? ছবিঘরে থাকছে তাঁর এবং এমন আরো কয়েকজন অসাধারণ মানুষের কথা৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Warner Bros/Entertainment Inc.
আইনস্টাইনের ‘অক্ষমতা’
অ্যাসপারজার্স সিনড্রোম নামের এক ধরণের অটিজম, অর্থাৎ মানসিক সমস্যায় ভুগতেন আলব্যার্ট আইনস্টাইন৷ এই সমস্যা থাকলে অনেক ক্ষেত্রে মানুষ খুব জটিল বিষয় নিয়ে ভাবতে ভালোবাসে এবং সামাজিক সম্পর্ক স্থাপনেও সমস্যা হয় তাদের৷ আইনস্টাইনেরও এ সব সমস্যা ছিল৷ বিবিসি-র এক অনুসন্ধান বলছে, অ্যাসপারজার্স সিন্ড্রোমে আক্রান্তদের মতো তাঁরও একই কথা বারবার বলার অভ্যেস ছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মোৎসার্ট খুব বেশি হাত-পা নাড়তেন!
সংগীতজ্ঞ মোৎসার্টের মধ্যেও নাকি চোখে পড়ার মতো কিছু অস্বাভাবিকতা ছিল৷ খুব কম বয়সেই তাঁর মধ্যে নানা ধরণের বাদ্যযন্ত্রের প্রতি ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়৷ মাত্র পাঁচ বছর বয়সে খুব দ্রুত সুর রচনাও শুরু করেন৷ কিন্তু লিখতে সমস্যা হতো৷ বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সমস্যাটার কারণ অটিজম৷ মোৎসার্টের শ্রুতিতেও সংবেদনশীলতা ছিল৷ আরেকটা অস্বাভাবিকতা ছিল অস্ট্রীয় এই সংগীতজ্ঞের – সবসময় খুব বেশি হাত-পা নাড়াতেন!
ছবি: picture-alliance/akg-images/Erich Lessing
ভয় থেকে সুপারস্টার!
‘ঘোস্টবাস্টার্স’ মুভির জন্য সুপরিচিত ড্যান অ্যাক্রয়েডের নাকি ‘দ্য ব্লু ব্রাদার্স’-এ কাজ করার সময় অ্যাসপারজার্স সিনড্রোম ধরা পড়েছিল৷ ঘোস্টবাস্টার্স-এ চমৎকার অভিনয়ের কৃতিত্ব অ্যাসপারজার্স সিনড্রোমকেই দিয়েছেন তিনি৷ ক্যানাডিয়ান এই অভিনেতা ডেইলি মেল-কে বলেছেন, অ্যাসপারজার্স সিনড্রোমের যেসব বৈশষ্ট্য ছিল তার মধ্যে একটি হলো, ভূত এবং পুলিশে ভয়৷ ছবিতে অভিনয়ের সময় তা নাকি খুব কাজে লেগেছে৷
ছবি: Getty Images for AFI/F. Harrison
১২ হাজার বই মুখস্থ ছিল যাঁর
কিম পিক নামের কাউকে হয়ত আপনি চেনেন না৷ তাঁকে নিয়ে একটি ছবি হয়েছে, ছবির নাম ‘রেন ম্যান’৷ আশির দশকের এই ক্লাসিক মুভির কাহিনি চার্লি ব্যাবিট এবং তাঁর অটিস্টিক ভাই রেমন্ডকে ঘিরে৷ সেখানে রেমন্ড, অর্থাৎ বাস্তব জীবনের কিম পিকের চরিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন ডাস্টিন হফম্যান৷ ২০০৯ সালে মারা যান পিক৷ ১২ হাজার বই একদম মুখস্থ ছিল বলে কিম পিক-কে এক বাক্যে পণ্ডিত মানতেন সবাই৷
ছবি: cc-by-Dmadeo
যিনি এক জায়গায় বসতে ভালোবাসতেন
চিকিৎসা শাস্ত্রের বিশিষ্ট নাম ড. শেল্ডন কুপার৷ ‘দ্য বিগ ব্যাং থিওরি’ – ছবি দেখে থাকলে নামটা নিশ্চয়ই শুনেছেন৷ ছবিতে কুপার হয়েছিলেন জিম পারসন্স৷ পারসন্সের ধারণা, কুপারেরও অ্যাসপারজার্স সিনড্রেম ছিল৷ বলা হয়ে থাকে, কুপার শ্লেষাত্মক কথা একেবারেই বুঝতেন না, সপ্তাহে এক দিন খুব ঘটা করে খেতে বসতেন এবং সব সময় এক জায়গাতেই বসতেন৷
ছবি: picture-alliance/dpa/Warner Bros/Entertainment Inc.
5 ছবি1 | 5
আলোকরশ্মিও ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক বা বৈদ্যুতিক-চৌম্বক তরঙ্গ৷ বলতে কি, মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ আবিষ্কৃত হবার আগে মহাশূন্য থেকে সব খবরাখবরই আমরা পেতাম এই ধরনের ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক তরঙ্গের কল্যাণে৷ কিন্তু ইলেকট্রো-ম্যাগনেটিক তরঙ্গ তার যাত্রাপথে ব্যাহত হতে পারে, মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গের ক্ষেত্রে যা হয় না৷ উভয় তরঙ্গই চলে আলোর গতিতে৷
কোন যন্ত্রে মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ ধরা পড়ল
যন্ত্রটির নাম লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্রাভিটেশনাল-ওয়েভ অবজারভেটরি বা আদ্যক্ষরগুলি মিলিয়ে ‘লিগো'৷ এই লিগো যন্ত্রটি ইংরিজি ‘এল' শব্দের মতো এবং প্রায় চার কিলোমিটার লম্বা৷ সুদূর অতীতে দুই ব্ল্যাক হোলের মধ্যে সংঘর্ষ থেকে ভেসে আসা মাধ্যাকর্ষণ তরঙ্গ লুইজিয়ানা আর ওয়াশিংটনের লিগোতে পৌঁছায় ২০১৫ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর, ১৬৫১ জিএমটি-তে৷ সেই তথ্য সতীর্থদের সঙ্গে যাচাই করে প্রকাশ করতে করতে এতদিন সময় লেগে গেছে৷ তথ্যকে শব্দতরঙ্গে রূপান্তরিত করে বিজ্ঞানীরা যা শুনেছেন, তা যেন বাস গিটারের সবচেয়ে নীচু স্বর থেকে শুরু করে পিয়ানোর মিডল সি পর্যন্ত – যেন দূরে মেঘের ডাকের মাঝে মাঝে একটি ছোট্ট পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে!
এই আবিষ্কারের তাৎপর্য
‘‘জ্যোতির্বিজ্ঞানের একটা নতুন সরঞ্জাম পাওয়া গেল'', বলেছেন এমআইটি-র অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট নার্গিস মাভালভালা৷ ‘‘যেন আমাদের একটা নতুন ইন্দ্রিয় গজিয়েছে৷ এতদিন শুধু দেখতে পেতাম; এবার শুনতেও পারব৷'' কাজেই ব্ল্যাক হোল অথবা নিউট্রন স্টার সম্পর্কে আরো জানবার একটা পন্থা হলো৷ বেতার তরঙ্গ, আলোকরশ্মি, অবলোহিত আলো, এক্স-রে, গামা রে, এ সব ছাড়িয়ে মহাজগৎ-কে জানার আর একটা উপায় হলো আমাদের৷
আইনস্টাইন শুনলে বলতেন, ‘আমি তো আগেই বলেছিলাম৷'
এসি/ডিজি (রয়টার্স, এএফপি)
ডার্ক ম্যাটার খুঁজবে সার্ন
পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে অন্যতম বিস্ময় ‘ডার্ক ম্যাটার’৷ বিস্ময়কর এই পদার্থের সন্ধান পেতে বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানীরা কোনো চেষ্টাই বাকি রাখেননি৷ কিন্তু এখনো তার দেখা পাওয়া যায়নি৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সবার কাছে বিস্ময়
পদার্থবিজ্ঞানীদের কাছে অন্যতম বিস্ময় ‘ডার্ক ম্যাটার’৷ বিস্ময়কর এই পদার্থের সন্ধান পেতে বিশ্বের তাবৎ বিজ্ঞানীরা কোনো চেষ্টাই বাকি রাখেননি৷ কিন্তু এখনো তার দেখা পাওয়া যায়নি৷
ছবি: Reuters/NASA-JSC/Handout
সার্নে গবেষণা
গড পার্টিকল বলে পরিচিত হিগস কণার সন্ধান পাওয়া ইউরোপের সার্ন ল্যাবরেটরি ২০১৫ সালে ডার্ক ম্যাটারের খোঁজ করবে৷ এ জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে লার্জ হেডরন কোলাইডার বা এলএইচসি৷ ছবিতে এলএইচসি টানেলের ভেতরটা দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: DW/F.Schmidt
হিগসের চেয়েও বড়
হিগস আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বাংলাদেশি বিজ্ঞানী ড. লস্কর মোহাম্মদ কাশিফ৷ তিনি বলেন, ডার্ক ম্যাটারের সন্ধান পাওয়া গেলে সেটা হবে হিগস কণা আবিষ্কারের চেয়েও বড় সাফল্য৷ ছবিতে ড. কাশিফকে দেখা যাচ্ছে (বামে)৷
ছবি: Lashkar Kashif
সার্নে ড. কাশিফের কাজ
এলএইচসির সাতটি ডিটেক্টরের মধ্যে একটি অ্যাটলাস৷ হিগস আবিষ্কারের সঙ্গে যে দুটো ডিটেক্টর জড়িত ছিল এটি তার মধ্যে একটি৷ ছবিতে অ্যাটলাসের একটি কম্পোনেন্ট মিউয়ন চেম্বার দেখা যাচ্ছে৷ পিএইচডি করার সময় এসব ইনস্টল ও পরীক্ষা করে দেখার কাজ করেছেন ড. কাশিফ৷
ছবি: Lashkar Kashif
অ্যাটলাসের আকার
৪৬ মিটার দীর্ঘ, ২৫ মিটার ব্যাস ও সাত হাজার টন ওজনের অ্যাটলাস ডিটেক্টর ইনস্টল করার সময়কার ছবি এটি৷ খেয়াল করলে দেখবেন মাঝখানে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে আছেন৷ এর মাধ্যমে অ্যাটলাস ডিটেক্টর যে কত বড় তা সহজেই অনুমান করা যাচ্ছে৷
ছবি: Lashkar Kashif
সার্নের বড় সাফল্য
১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত ‘ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর নিউক্লিয়ার রিসার্চ’ বা সার্নের এখন পর্যন্ত বড় সাফল্য হলো হিগস কণার আবিষ্কার৷ ২০১২ সালে সার্ন এই কণার সন্ধান পাওয়ার ঘোষণা দেয়৷
ছবি: 1997 CERN
বহু দেশের বিজ্ঞানীর সমাগম
সার্ন ল্যাবরেটরিটা ইউরোপের হলেও সেখানে কাজ করেন বিশ্বের অনেক দেশের বিজ্ঞানী৷ বাংলাদেশের ড. কাশিফ তাঁদের মধ্যে একজন৷ ছবিতে চতুর্থ সারিতে ডান থেকে দ্বিতীয় ব্যক্তিটি হলেন তিনি৷
ছবি: Lashkar Kashif
বাংলাদেশ-সার্ন সহযোগিতা
এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে উপস্থিত ছিলেন সার্নের মহাপরিচালক জার্মান কণা পদার্থবিদ অধ্যাপক রল্ফ-ডিটার হয়ার৷ সে সময় বাংলাদেশ সরকার ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সার্নের সহযোগিতামূলক কাজ নিয়ে আলোচনা হয়৷ এর প্রেক্ষিতে চলতি বছর সার্নের ‘সামার প্রোগ্রাম’এ অংশ নিচ্ছেন ঢাবির এক শিক্ষার্থী৷