মাদক উৎপাদান, চোরাচালান, অপরাধ ও হিংসালীলার কারণে দক্ষিণ অ্যামেরিকার দেশ কলম্বিয়া কুখ্যাত হয়ে উঠেছিল৷ এবার আইনি পথে ওষুধ হিসেবে গাঁজার চাষের মাধ্যমে সে দেশে শান্তির সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে উঠছে৷
বিজ্ঞাপন
গেরিলা-অধ্যুষিত এলাকার মাঝে কোরিন্টো গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ১৩,০০০৷ গত ৫০ বছরে সেখানে উপার্জনের কোনো প্রচলিত পথ ছিল না৷ এবার চিকিৎসাবিদ্যার স্বার্থে গাঁজার চাষের ফলে উজ্জ্বল সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাচ্ছে৷
মেয়র এডওয়ার্ড গার্সিয়া নিজে নতুন এই কর্মক্ষেত্র নিয়ে খুশি৷ প্রায় ১২টি কৃষি সমবায় এর মধ্যেই ওষুধ কোম্পানিগুলির সঙ্গে চুক্তি করে ফেলেছে৷ তিনি বলেন, ‘‘আমরা কোরিন্টোর পরিস্থিতি বদলাতে চাই৷ অপরাধীদের চক্র, মাদক চক্র, মাফিয়ারা অনেক হিংসালীলা চালিয়েছে৷ এবার তাদের সরিয়ে আমরা সমবায় ও কোম্পানি আনতে চাই৷''
আইনি পথে ওষুধ হিসেবে গাঁজা চাষ কলম্বিয়ার ভবিষ্যতের জন্য নতুন সুযোগ বয়ে আনছে৷ দেশ-বিদেশের ৯১টি কোম্পানি এর মধ্যেই চাষের জন্য লাইসেন্স পেয়েছে৷ ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে প্রথম কোম্পানি হিসেবে ক্যানাডা ও কলম্বিয়ার যৌথ উদ্যোগ ফার্মাসিয়েলো এই অনুমতি পায়৷ মেডেয়িন শহরের কাছেই তাদের সদর দফতর৷
কলেজে গাঁজা চাষের প্রশিক্ষণ
বিনোদনের জন্য গাঁজার ব্যবহার শিগগিরই স্বীকৃতি দিচ্ছে ক্যানাডা৷ এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যিকভাবে গাঁজার চাষ বাড়াতে ২৪ জন ছাত্রকে প্রথমবারের মতো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা দিতে যাচ্ছে দেশটির একটি কলেজ৷
ছবি: Reuters/C. Osorio
কেন এ স্বীকৃতি?
বিশ্বের প্রথম শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে বিনোদনের জন্য গাঁজাকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে ক্যানাডা৷ প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর লিবারেল পার্টির নির্বাচনি প্রচারের প্রতিশ্রুতি হিসেবে মিললো এ স্বীকৃতি৷ দেশটির সরকারের আশা, এ স্বীকৃতি দিলে অপ্রাপ্তবয়স্কদের হাত থেকে এই মাদক দূরে রাখা সম্ভব হবে, কমানো যাবে এ সংক্রান্ত অপরাধের হারও৷
গাঁজা চাষের ব্যবসায়িক দিকও বিবেচনায় রাখছেন প্রশিক্ষকরা৷ গাঁজা স্বীকৃতি পেলে এর যে বিশাল বাজার তৈরি হবে, তা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে, কী পরিমাণ শ্রম ও খরচে কী পরিমাণ গাঁজা উৎপাদন সম্ভব, এ সবকিছুই শেখানো হবে এ কলেজে৷
ছবি: Reuters/C. Osorio
ব্ল্যাক মার্কেট
আইনি স্বীকৃতির পর বাজারে পর্যাপ্ত গাঁজার সরবরাহ না থাকলে কালোবাজারে বিক্রি বেড়ে যাওয়ার আশংকা করছে আইন-শৃংখলা বাহিনী৷ এ সমস্যার সমাধানে দ্রুতই ভালো প্রজাতির গাঁজা বাজারে আনতে দক্ষ মানুষ তৈরি করতে চায় নিয়াগারা কলেজ৷
ছবি: Reuters/C. Osorio
প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী
ভালো গাঁজা উৎপাদনে প্রয়োজন সঠিক পরিচর্যা৷ তাই ল্যাবে কিভাবে আলো নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উৎকৃষ্ট প্রজাতির গাঁজার উৎপাদন করা যায়, সে ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় শিক্ষার্থীদের৷ এই প্রকল্পের দায়িত্বে আছেন বিল ম্যাকডোনাল্ড৷
ছবি: Reuters/C. Osorio
গাঁজার ব্র্যান্ড
ক্যানাডার এমন পদক্ষেপের সুযোগ নিতে এগিয়ে আসছে নামিদামি বিভিন্ন ব্র্যান্ডও৷ ওয়ালমার্টের ক্যানাডিয়ান ইউনিট এবং নানা পানীয় ও মদ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গাঁজা দিয়ে প্রস্তুত খাবার ও পানীয় বাজারজাত করার পরিকল্পনা করেছে৷
ছবি: Reuters/C. Osorio
6 ছবি1 | 6
কোম্পানির প্রধান ফেডেরিকো কক-কোরেয়া বলেন, আধুনিক উৎপাদন প্লান্ট গড়ে তুলতে তাঁরা প্রায় ৪ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছেন৷ কলম্বিয়ার জলবায়ু, উর্বর মাটি ও গেরিলা বাহিনীর সঙ্গে শান্তি চুক্তির ফলে বিনিয়োগকারীরা আশ্বস্ত হয়েছেন৷ তিনি বলেন, ‘‘ওষুধ হিসেবে গাঁজা কলম্বিয়ার অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে৷ গোটা বিশ্বে এর বাজারের সম্ভাবনা প্রায় ৪,০০০ কোটি ডলার৷ বর্তমান পরিস্থিতিতেই কলম্বিয়া আন্তর্জাতিক বাজারের ২০ থেকে ৩০ শতাংশ দখল করার ক্ষমতা রাখে৷''
কোম্পানি তার নিজস্ব গ্রিনহাউসেই গাঁজা চাষ করছে৷ তবে আইন অনুযায়ী তাদের কমপক্ষে ১০ শতাংশ গাছ ছোট চাষির কাছ থেকে কিনতে হয়৷ সে কারণে ফার্মাসিয়েলো কোম্পানি কোরিন্টো-য় এক সমবায়ের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে৷ ৬৩টি পরিবার সেই সমবায়ের সদস্য৷
কলম্বিয়ার সরকার সেই সঙ্গে স্থির করে দিয়েছে, যে দেশের স্বার্থে কাঁচামাল হিসেবে গাঁজা রপ্তানি করা যাবে না৷ কোরিন্টো উপত্যকায় আখের চাষ হলেও খুব কম মানুষ তা থেকে যথেষ্ট উপার্জন করতে পারে৷ এবার আইনি পথে গাঁজা চাষের কারণে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা হচ্ছে৷ এডওয়ার্ড গার্সিয়া বলেন, ‘‘এখানে আখের চাষ হয়৷ ৮ হেক্টরজুড়ে চাষের ফলে মাত্র এক জনের কর্মসংস্থান হয়৷ অন্যদিকে ওষুধ হিসেবে গাঁজা চাষের ফলে ১০ থেকে ১৫ জনের কর্মসংস্থান হয়৷ প্রথম বছরেই আমরা এই অঞ্চলে এক থেকে দেড় হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের আশা করছি৷''
রোগ সারাতে গাঁজার চাষ করছে ইটালির মিলিটারি
ওষধি হিসেবে ক্যানাবিস বা গাঁজার চল বহুদিনের৷ ইটালি এবার নেদারল্যান্ডস থেকে আমদানি করার পরিবর্তে স্বদেশেই গাঁজার চাষের সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷
ছবি: Getty images/AFP/F. Monteforte
ওষুধের গাঁজা
ইটালির সামরিক বাহিনী তাদের ক্যানাবিস ভিত্তিক ওষুধপত্র তৈরি করে ফ্লোরেন্স শহরের স্তাবিলিমেন্তো শিমিকো ফার্মাচিউতিকো মিলিতারে কেন্দ্রটিতে৷ ইংরেজিতে: মিলিটারি কেমিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল এস্ট্যাবলিশমেন্ট৷
ছবি: Getty images/AFP/F. Monteforte
মিলিটারি প্রকল্প
সামরিক বাহিনীর ১৬৪ বছরের রাসায়নিক ও ওষধি কেন্দ্রটি শুধু গাঁজার চাষই করে না৷ প্রতিষ্ঠানটিতে তৈরি করা ক্যানাবিসকে সরকারিভাবে ওষধি হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে৷ চূড়ান্ত পদার্থটিকে গাঁজা বললে তার অপমান করা হবে৷ দুনিয়ার সর্বত্র যে গাঁজা-ভাং-চরস খাওয়া হয়, তার সঙ্গে এর সাদৃশ্য অল্পই৷
ছবি: Getty images/AFP/F. Monteforte
টিএইচসি কম, সিবিডি বেশি
গাঁজায় যে পদার্থটি নেশাখোরদের নেশা চড়ায়, সেটি হলো টেট্রাহাইড্রোক্যানাবিনল বা টিএইচসি৷ কিন্তু গাঁজার যে সক্রিয় উপাদানটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রদাহ রোধে ডাক্তারদের কাজে লাগে, সেটি হলো ক্যানাবিডিয়ল বা সিবিডি৷ প্রায় দুই থেকে তিন হাজার ইটালীয় বর্তমানে মাল্টিপল সক্লেরোসিসের ব্যথা ও প্রতিবন্ধিত্ব বা কোমোথেরাপির পর বমি বমি ভাব কমাতে মেডিক্যাল ক্যানাবিস ব্যবহার করে থাকেন৷
ছবি: Getty images/AFP/F. Monteforte
‘আমি কোনোদিন খেয়ে দেখিনি!’
‘‘আর আমার খেয়ে দেখার ইচ্ছেও নেই’’, বলেন কর্নেল আন্তোনিও মেদিকা, যিনি ফ্লোরেন্সে ইটালির সামরিক বাহিনীর ক্যানাবিস পরীক্ষাগারের দায়িত্বে৷ তাঁর এক সহকর্মী, আরেক কর্নেল না জাঁদরেল নাকি ঠাট্টা করে বলছিলেন: ‘চল্লিশ বছর ধরে আমরা সৈন্যদের সেনা ছাউনিতে ক্যানাবিস সেবন রোখার চেষ্টা করেছি – আর আজ আমরা নিজেরাই গাঁজার চাষ করছি!’
ছবি: Getty images/AFP/F. Monteforte
গঞ্জিকা পরীক্ষাগারে
জীবাণুমুক্ত, অবরুদ্ধ পরিবেশে ক্যানাবিস উৎপাদন করতে হয়৷ খোলা মাঠে চাষ করলে তাতে নানা ধরনের বিষক্রিয়াযুক্ত রাসায়নিক, বিশেষ করে পারদের মতো হেভি মেটাল এসে ঢোকে, কেননা গাছগুলি তা সহজেই শুষে নিতে পারে – বোঝালেন কর্নেল মেদিকা৷
ছবি: Getty images/AFP/F. Monteforte
ক্যানসার রোগীদের আরাম দেয় ক্যানাবিস
২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে জার্মান সংসদ একটি যুগান্তকারী বিলে মেডিক্যাল মারিজুয়ানার ব্যবহার অনুমোদন করে – যেমন কোমোথেরাপির পর ক্যানসার রোগীদের বমি বমি ভাব দূর করতে৷ টিউমার রোগীদের খিদে বাড়াতেও নাকি মারিজুয়ানা সাহায্য করে, যাতে তাদের ওজন আরো কমে না যায়৷ মাল্টিপল সক্লেরোসিসের লক্ষণ কমাতেও নাকি মারিজুয়ানা কাজে লাগে৷
ছবি: Getty images/AFP/F. Monteforte
মেড ইন ইটালি
ল্যাবরেটরিতে এক কমপাউন্ডার মারিজুয়ানার একটি প্রেস্ক্রিপশন প্রস্তুত করছেন৷ মেড ইন ইটালি গাঁজা সবে ওষুধের দোকানগুলোয় এসে পৌঁছেছে৷
ছবি: Getty images/AFP/F. Monteforte
7 ছবি1 | 7
অ্যারমান নোরেনিয়া ড্রাগ কোম্পানির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক চান না৷ একশোরও বেশি চাষিদের নিয়ে তিনি এক সমবায় গড়ে তুলেছেন৷ এক বছর অপেক্ষার পর তাঁরা রাষ্ট্রের কাছ থেকে চাষের লাইসেন্স পেয়েছেন৷ আইনি পথে আয়ের পথ খুলে যাবার ফলে তিনি নিজের পরিবার ও ছেলের জন্য আবার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছেন৷ গাঁজা চাষি অ্যারমান নোরেনিয়া বলেন, ‘‘আমার খুব সাধ, সে যেন ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে পারে৷ পেশাগত শিক্ষা পেলে সে হয়ত ভবিষ্যতে আমাদের এখানে কাজ করতে পারবে৷ তবে বেআইনি পথে তাকে কাজ করতে হবে না৷ বিপদ ও আশেপাশে অপরাধীদের উপস্থিতি ছাড়াই সে থাকতে পারবে৷''