বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগরের রসরাজ দাস এখন আইনের জটিলতায় পড়েছেন৷ তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ যে মামলা করেছে, তা জামিন অযোগ্য৷ আবার পুলিশ তাঁকে নির্দোষ বললেও তদন্ত রিপোর্ট কবে দিতে পারবে তা নিশ্চিত নয়৷
বিজ্ঞাপন
সে কারণে রসরাজ কবে ছাড়া পাবেন, তা কেউ বলতে পারে না৷ না পুলিশ, না রসরাজের আইনজীবী৷ তার ওপর তাঁর পরিবারের সদস্যরা এতই সাধারণ যে, আইনের মারপ্যাঁচ তাঁরা বোঝেন না৷ তাঁদের একটাই কথা, ‘‘রসরাজ তো কোনো দোষ করেনি৷ তারপরও ওকে ছাড়ে না কেন?''
রসরাজের বাড়ি নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের হরিনবেড় গ্রামে৷ সে পেশায় জেলে৷ রসরাজকে আটক ও মারপিট করে পুলিশে দেয়া হয় ২৯ অক্টোবর বিকেলে৷ এর আগের দিন তাঁর ফেসবুক আইডি থেকে ধর্মীয় অবমাননাকর একটি পোস্টের অভিযোগ করে উত্তেজনা ছড়ানো হয়৷ পুলিশ তাঁকে আটকের পর নাসিরনগর থানায় তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় মামলা করে৷ পরদিন ৩০ অক্টোবর সমাবেশের নামে নাসিরনগর সদর উপজেলায় হিন্দু বসতিতে ব্যাপক হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করা হয়৷ ভাঙচুর করা হয় প্রতিমা৷
দয়াময় দাস
রসরাজকে ঐ মামলায় আটকের পর রিমান্ডে নিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়৷ কিন্তু পুলিশ তদন্তে নিশ্চিত হয়েছে যে, রসরাজের মোবাইল ফোন থেকে কোনো ফেসবুকে পোস্ট করা হয়নি৷ তারপরও এখানো রসরাজ কেন কারাগারে?
এই প্রশ্নের জবাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ফরেনসিক রিপোর্টে দেখা গেছে রসরাজের মোবাইল ফোন থেকে ফেসবুকে ওই পোস্ট দেয়া হয়নি৷ কিন্তু তাঁর আইডি থেকে পোস্ট দেয়া হয়েছে৷ এখন আমাদের তদন্তের বিষয় হলো, তাহলে কে পোস্ট দিয়েছে? বিষয়টি আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি৷''
তিনি আরো জানান, ‘‘তাঁর ফেসবুক থেকে পরে ক্ষমা চেয়ে যে ব্যক্তি পোস্ট দিয়েছে, তাকে আমরা চিহ্নিত করেছি৷ কিন্তু আটক করতে পারিনি৷ আমরা সন্দেহভাজন কয়েকজনকে আটক করে কিছু তথ্য পেয়েছি৷ এছাড়া কম্পিউটারের চারটি সিপিইউ জব্দ করেছি, যার ফরেনসিক রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি৷ রিপোর্ট পেলে বোঝা যাবে ওই কম্পিউটারের কোনোটি থেকে পোস্ট দেয়া হয়েছে কিনা৷ আমরা আইপি অ্যাড্রেসও চিহ্নিত করার কাজ করছি৷''
তাই তিনি বলেন, ‘‘তদন্ত চলছে৷ তবে এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না যে, কে পোস্টটি দিয়েছিল৷''
অ্যাডভোকেট নাসির মিয়া
শুরুতে রসরাজের পক্ষে কোনো আইনজীবীকে কাজ করতে দেয়া না হলেও, এখন অ্যাডভোকেট নাসির মিয়া তাঁর আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘তথ্য প্রযুক্তি আইনের যে ধারায় রসরাজের বিরুদ্ধে পুলিশের এইআই কাওসার মামলা করেছেন, তা জামিন অযোগ্য৷ আমরা জামিনের আবেদন জানিয়েও জামিন পাইনি৷ ৩ জানুয়ারি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে মামলার পরবর্তী তারিখ৷ সেদিন আবার জামিনের আবেদন জানাবো৷ তবে জামিন পাওয়া নির্ভর করছে পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর৷ আদালত পুলিশের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন চেয়েছে৷ কিন্তু পুলিশ কবে তদন্ত প্রতিবেদন দেবে, তা পুলিশই জানে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘পুলিশের কারণেই এখন রসরাজকে কারাগারে পঁচতে হচ্ছে৷ সে এখন জেলা কারাগারে আছে৷ পুলিশ যদি প্রথমেই মামলা করে প্রাথমিকভাবে তদন্ত করে দেখতো, তাহলে এই নির্দোষ লোকটিকে জেলে যেতে হতো না৷ পুলিশ যদি তাঁকে ৫৪ ধারায়ও সন্দেহজনকভাবে গ্রেপ্তার করতো, তাহলেও এতদিনে রসরাজ জামিনে মুক্তি পেতেন৷''
তিনি বলেন, ‘‘রসরাজ যে বিতর্কিত ফেসবুক পোস্টের সঙ্গে জড়িত না, তা সবদিক থেকেই প্রমাণিত৷ তারপরও পুলিশ যতদিন পর্যন্ত আদালতে রসরাজকে নির্দোষ বলে প্রতিবেদন না দেবে, ততদিন তাঁকে কারাগারেই থাকতে হবে৷''
এসপি মিজানুর রহমান
এরইমধ্যে পুলিশ স্থানীয় একটি সাইবার ক্যাফের মালিক জাহঙ্গিরকে আটক করেছে৷ সেখান থেকে কম্পিউটার জব্দও করা হয়েছে৷ ধারণা করা হচ্ছে, ওই সাইবার ক্যাফে থেকেই বিতর্কিত পোস্টটি দেয়া হয়৷
রসরাজের মা ঢাকায় এসে সংবাদ সম্মেলন করে তাঁর ছেলের জামিনে মুক্তি প্রার্থনা করেছেন৷ কিন্তু মুক্তি মিলছে না৷ রসরাজের ভাই দয়াময় দাস ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমরা ঘটনার পর থেকে পলাতক জীবনযাপন করেছি৷ আমাদের বাড়ি ঘর ভেঙে ফেলা হয়েছে হামলা চালিয়ে৷ কয়েকদিন হলো বাড়ি ফিরেছি৷ কোনো সহায়তা পাইনি৷ কীভাবে ঘর-বাড়ি বানাবো জানি না৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘আমার ভাই কোনো দোষ না করেও জেলে গেছে৷ তাকে কীভাবে ছাড়াবো জানি না৷ উকিলও কিছু বলে না৷ পুলিশের কাছে যাই নাই৷ আমার ভাই তো কোনো দোষ করেনি, তাকে একটু ছাড়ানোর ব্যবস্থা করেন না স্যার৷’’
আপনি কি রসরাজের পাশে আছেন? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷
নাসিরনগরের হিন্দুরা এখন যেমন আছেন
এক ব্যক্তি ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে- এই অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু জনপদে ব্যাপক সহিংসতা চালিয়েছে দুর্বৃত্তরা৷ শতাধিক বাড়ি ও বেশ কিছু মন্দিরে হামলা হয়েছে৷ সেখানে গিয়ে ছবি তুলে এনেছেন খোকন সিং৷
ছবি: Khukon Singha
রসরাজের বাড়ি-ঘরে হামলা
যে ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফেসবুকে ইসলাম অবমাননার অভিযোগ তোলা হয়েছে তার নাম রসরাজ দাস৷ অভিযোগ ওঠার পরই তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ তারপরও হামলা হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং হবিগঞ্জের মাধবপুরের হিন্দুদের অনেক বাড়ি এবং মন্দিরে৷ নাসিরনগর সদর থেকে ১৬ কিমি. দূরে হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামে রসরাজের বাড়িতেও হামলা চালানো হয়৷
ছবি: Khukon Singha
রসরাজ কি সত্যিই ধর্ম অবমাননা করেছে?
২৮শে অক্টোবর রসরাজের ফেসবুক পাতায় ধর্মীয় অবমাননাকর ছবি পোস্ট করা হয় বলে দাবি করা হয়৷ রসরাজ জানিয়েছে, কেউ হ্যাক করে এটি করেছে৷ তারপরও নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে ছবিটি পোস্ট হওয়ায় ক্ষমা চেয়েছেন তিনি৷ তবে স্থানীয়রা জানিয়েছেন, রসরাজ মাত্র ফোর বা ফাইভ পর্যন্ত পড়েছে৷ ফলে ফটোশপ করে ছবি ফেসবুকে দেয়ার ক্ষমতা তার আছে কিনা এই প্রশ্ন উঠেছে৷
ছবি: Khukon Singha
ফটোশপ করতে জানেন না রসরাজ
এদিকে গ্রেপ্তার করার পর রসরাজকে রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ৷ নাসিরনগর ঘুরে এসে সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ‘‘ফোর-ফাইভ ক্লাস পাস ঐ যুবকের ফটোশপে কাজ করার মতো দক্ষতা নাই৷ আমরা সরেজমিন তদন্তে ধারণা করছি, একটি সাইবার ক্যাফে থেকে এ কাজ করা হয়েছে৷’’ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী মো. ছায়েদুল হক, পুলিশ কর্মকর্তা এবং মানবাধিকার কর্মীরাও একই কথা বলেছেন৷
ছবি: Khukon Singha
পুলিশ ছিল নিষ্ক্রিয়
ধর্ম অবমাননার কথা বলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে মন্দির ও বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাটের সময় পুলিশ হামলাকারীদের রুখতে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি বলে অভিযোগ করেছেন নির্যাতিতরা৷
ছবি: Khukon Singha
আবারও হামলা
৩ নভেম্বর আবার হামলা হয় নাসিরনগরে৷ হিন্দুদের বেশ কিছু বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ এছাড়া গত কয়েকদিনে গোপালগঞ্জ, রংপুর, বরিশাল, ঠাকুরগাঁওসহ আরো কয়েকটি জায়গায় হিন্দুদের মন্দিরে হামলা হয়েছে৷ ছবিতে নাসিরনগরের একটি বাড়ি৷
‘হেফাজতে ইসলাম’ ও ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের’ ব্যানারে বিক্ষোভ
রসরাজের শাস্তি দাবিতে ‘হেফাজতে ইসলাম’ ও ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের’ ব্যানারে রোববার বিক্ষোভ-সমাবেশের পরপরই নাসিরনগরে এবং পাশের এলাকা হবিগঞ্জের মাধবপুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর হামলে পড়ে একদল যুবক৷ ছবিতে নাসিরনগরের একটি ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি৷
ছবি: Khukon Singha
স্থানীয় আওয়ামী লীগের তিন নেতা বহিষ্কার
হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠায় স্থানীয় তিন নেতাকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে আওয়ামী লীগ৷ হামলা-ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগে তাদের সম্পৃক্ততার অভিযোগ খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ৷
ছবি: Khukon Singha
চলছে ঘর-বাড়ি ঠিক করার কাজ
পুড়ে যাওয়া ও ভাঙা ঘর-বাড়ি ঠিক করে কোনোমতে মাথা গোঁজার নিশ্চয়তা ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চলছে৷
ছবি: Khukon Singha
মন্দিরের বেহাল দশা
এই পুরোহিতের চোখের ভাষা অনেক কিছুই বলে দেয়৷ মন্দিরগুলো কবে যে ঠিক করা হবে, কারো জানা নেই৷
ছবি: Khukon Singha
মাটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রতিমা
হামলার পর থেকে এখনো মন্দিরগুলোকে ঠিক করার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি৷ তাই এই মন্দিরে প্রতিমা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাটিতে৷
ছবি: Khukon Singha
ক্ষতিগ্রস্তরা পাচ্ছেন না ত্রাণ
স্থানীয় প্রশাসন বলছে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে ৬ হাজার করে টাকা ও টিন দেয়া হয়েছে৷ ক্ষতির তুলনায় তা খুবই কম৷ তবে খোকন সিং ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছেন, বেশিরভাগ পরিবার ছয় হাজার টাকাও পাননি৷ কেউ কেউ এক বান্ডিল টিনের সঙ্গে পেয়েছেন মাত্র তিন হাজার টাকা!