নাৎসি আমলের অভিজ্ঞতাই তার কারণ৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরেও ‘ডি-নাৎসিফিকেশন’ বা দেশকে নাৎসি-মুক্ত করার প্রচেষ্টা পুরোপুরি সফল হয়নি৷ জার্মান মানসে ও অবচেতনে তার গভীর দাগ মিটতে বহু দশক লেগে গেছে৷
বিজ্ঞাপন
বিচার পাওয়ার আশা যেন দুরাশা
‘বিচারহীনতার সংস্কৃতি’ বাংলাদেশে এখন একটি অতি উচ্চারিত শব্দযুগল৷ বিচার হচ্ছে না কিংবা বিচারের অপেক্ষায় আছে এমন কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ থাকছে ছবিঘরে৷
ছবি: dapd
ব্লগার হত্যা
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি টিএসসির সামনে দুর্বৃত্তরা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়কে কুপিয়ে হত্যা করে৷ এরপর একে একে হত্যার শিকার হন ব্লগার নীলাদ্রী নিলয়, অনন্ত বিজয় দাশ, ওয়াশিকুর বাবু, প্রকাশক ফয়সল আরেফিন দীপন৷ এ সব হত্যাকাণ্ডের কোনোটির বিচারে ‘উল্লেখযোগ্য’ অগ্রগতি না হওয়ায় সম্প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান৷
ছবি: Privat
সাংবাদিক দম্পতি হত্যা
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ভাড়া বাসায় সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে হত্যা করা হয়৷ গত চার বছরে এই মামলার তদন্ত থানা পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগ হয়ে র্যাব-এর হাতে পৌঁছেছে৷ গত মে মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে আমরা প্রত্যেক হত্যাকাণ্ড তদন্তের মাধ্যমে তার বিচার করতে পেরেছি৷ সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড অন্য কথা৷ ওটা এখানে না আসাই ভালো৷’’
ছবি: DW
ধর্ষণের বিচার
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে বাংলাদেশে ৬৬০ জন নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন৷ অথচ কোনো ঘটনারই বিচার হয়নি৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/E. McGregor
ত্বকী হত্যা
নারায়ণগঞ্জ গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা রফিউর রাব্বির ছেলে তানভীর মুহাম্মদ ত্বকীকে ২০১৩ সালের ৬ মার্চ হত্যা করা হয়৷ হত্যার দুদিন পর শীতলক্ষ্যার একটি খালে তার লাশ পাওয়া যায়৷ রাষ্ট্রের অনিহা থাকায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচার থমকে আছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেন রফিউর রহমান রাব্বি৷ ত্বকী হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাংসদ শামীম ওসমানের পরিবারের জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে৷
ছবি: Facebook/Taqi.Mancha
তনু হত্যা
চলতি বছরের ২০ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাস এলাকায় ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী সোহাগী জাহান তনুর মৃতদেহ পাওয়ার পর দেশব্যাপী প্রতিবাদ উঠেছিল৷ দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি উঠেছিল৷ কিন্তু এখনও কেউ গ্রেপ্তার হয়নি৷ তবে তদন্তকাজ চলছে৷
ছবি: Twitter
শিল্প কারখানায় দুর্ঘটনা
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকালে সাভারের রানা প্লাজা ধসে এগারশ’র বেশি মানুষের প্রাণ যায়৷ এর মধ্যে বেশিরভাগই পোশাক শ্রমিক ছিল৷ তিন বছরেরও বেশি সময় পর গত জুলাইতে এই ঘটনায় করা হত্যা মামলার অভিযোগ গঠন করা হয়৷ ঢাকার এক অনলাইন সংবাদমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৬ বছরে উল্লেখ্যযোগ্য শিল্প দুর্ঘটনা ঘটেছে ১৮টি৷ এর কোনোটিরই বিচার আজ পর্যন্ত হয়নি৷ প্রতিবেদনটি পড়তে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: Reuters
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা
১৯৯৮ সালের ১৮ ডিসেম্বর বনানীর ১৭ নম্বর রোডের আবেদীন টাওয়ারে ট্রাম্পস ক্লাবের নীচে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷ ঘটনার দিনই তাঁর ভাই গুলশান থানায় হত্যা মামলা করেছিলেন৷ এই অভিনেতা খুন হওয়ার পর চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উঠলেও এখনও মামলার বিচার শুরু করা যায়নি৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: bdnews24.com
সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যা
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যের বাজারে আওয়ামী লীগের জনসভা শেষে ফেরার পথে গ্রেনেড হামলায় মারা যান সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়াসহ পাঁচজন৷ এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা – দু’টিই হবিগঞ্জে দায়ের হলেও পরে সিলেটে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করা হয়৷
ছবি: Facebook/Justice-for-Shah-AMS-Kibria
হতাশ রামুর ক্ষতিগ্রস্তরা
২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে কক্সবাজারের রামু উপজেলায় কোরআন অবমাননার অভিযোগ তুলে বৌদ্ধপল্লীতে হামলা চালিয়ে ১২টি বৌদ্ধ মন্দির ও ৩০টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে একদল লোক৷ ঐ ঘটনার চার বছর পরও মামলা গতিশীল না হওয়ায় হাতাশা প্রকাশ করেছেন ক্ষতিগ্রস্তরা৷ পিপি মমতাজ আহমদ সম্প্রতি বলেন, এই হামলার ঘটনায় দায়ের করা ১৯টি মামলায় ইতোমধ্যেই অভিযোগ গঠন করা হয়েছে৷ আরও তথ্য জানতে (+) চিহ্নে ক্লিক করুন৷
ছবি: AFP/Getty Images
নারী নির্যাতনের মামলা ৫,০০৩টি, রায় ৮২০টির
২০১৫ সালে প্রকাশিত মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক জরিপ বলছে, গত নয় বছরে দেশের নয়টি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২২,৩৮৬ জন নারী ধর্ষণসহ বিভিন্ন নির্যাতনের ঘটনায় চিকিৎসা নেন৷ এই ঘটনাগুলোর বিচারিক প্রক্রিয়ায় দেখা গেছে এ সব ঘটনায় মামলা হয়েছে মাত্র ৫,০০৩টি৷ রায় ঘোষণা হয়েছে ৮২০টি, শাস্তি হয়েছে ১০১ জনের৷ শতকরা হিসাবে রায় ঘোষণার হার ৩.৬৬ এবং সাজা পাওয়ার হার ০.৪৫ শতাংশ৷
ছবি: dapd
10 ছবি1 | 10
নাৎসি আমলে বিচারের নামে যে প্রহসন চলত আদালতকক্ষে, তা আজও কোনো নাটক বা ফিল্মে বা পুরনো তথ্যচিত্রে দেখলে রক্ত ঠান্ডা হয়ে যায়৷ আবার রক্ত গরম হয়ে ওঠে৷ বিচারকরা নিরপরাধ আসামীদের ওপর হম্বিতম্বি করছেন, তাদের কথা বলতে দিচ্ছেন না, শেষমেষ যে মৃত্যুদণ্ড তাদের দেওয়া হবে, তা জানাই ছিল, পরে সেই সাজাই ঘোষণা করা হচ্ছে৷ নাৎসি ইতিহাসের সবচেয়ে কলঙ্কিত অধ্যায় যদি বন্দিশিবিরগুলো হয় – বন্দিশিবির তো নয়, মৃত্যুশিবির – তবে তাদের পরেই আসবে নাৎসি বিচার ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ ও বিচারের নামে নির্দোষিদের হত্যা৷ জার্মানরা সে দুঃস্বপ্ন আজও ভোলেননি, যে কারণে ফেডারাল জার্মান প্রজাতন্ত্রে বিচারহীনতা বলে কোনো বস্তু নেই৷
হ্যাঁ, নাৎসি আমলের সেই ‘বিচার বিভীষিকার' কথা স্মরণ করেই হয়ত এ দেশে অপরাধের দণ্ড বা সাজা কিছুটা কমই হয়, বা কম বলে মনে হয়৷ জার্মানরা পারতপক্ষে কাউকে জেলে পাঠাতে চান না, পারোলে, অর্থাৎ পালাবে না, এই শর্তে, ছাড়াই রাখেন৷ নাৎসি পরবর্তী জার্মানির গোটা বিচার ব্যবস্থাই যেন অপরাধীরাও যে মানুষ, সে কথা স্মরণে রেখে৷ এদেশে দণ্ডদানের অর্থ ও উদ্দেশ্য হলো অপরাধীকে তার অপরাধের প্রবণতা থেকে মুক্ত করা, সে যা-তে আবার ব্যক্তি বা বর্গের পক্ষে ঝুঁকি না হয়ে ওঠে, তার ব্যবস্থা করা৷ কিন্তু মৃদু বা মানবিক দণ্ডের অর্থ বিচারহীনতা নয়৷
যেমন হত্যার মতো অপরাধের কোনো স্ট্যাটিউটরি লিমিটেশন নেই, অর্থাৎ এ অপরাধ – বা তার তদন্ত – কোনোদিনই তামাদি হয়ে যাবে না৷ ২০, ২৫ বা ৩০ বছর পরেও যদি তদন্তের কোনো নতুন সূত্র আবিষ্কৃত হয় – যেমন হাল আমলের কোনো ডিএনএ-র হদিশ – তাহলে গোয়েন্দা পুলিশ সেই সূত্র অনুসরণ করে হত্যাকারীকে ধরার চেষ্টা করবে৷ এভাবে আবার ভুলক্রমে দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীদের মুক্তি পাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে৷
জার্মানিতে হাই প্রোফাইল অপরাধের কেস মানেই সাধারণত কর ফাঁকি দেওয়ার কেস৷ বায়ার্ন মিউনিখের সাবেক হর্তাকর্তা উলি হ্যোনেস থেকে শুরু করে স্টেফি গ্রাফ – বা তাঁর বাবার মতো বিশিষ্ট ব্যক্তিদেরও লৌহকপাট দেখতে হয়েছে কর ফাঁকি দেওয়া দায়ে৷ ওদিকে কর ফাঁকি দিয়ে থাকলেও, পরে নিজেই কর বিভাগকে সে-কথা জানালে বকেয়া কর ও স্বল্প কিছু জরিমানা দিয়েই মকুব পাওয়া যায় – একেও কিন্তু বিচারহীনতা বললে ভুল করা হবে৷
আমি বলব, গত নিউ ইয়ার্স ইভে কোলোনের মুখ্য রেলওয়ে স্টেশনের সামনের চত্বরে মহিলাদের উপর যে ব্যাপক হামলা চলেছে, ও পুলিশ যেভাবে – যে ধৈর্য এবং নিরপেক্ষতা নিয়ে – সেই সব চুরি ও যৌন হামলা ও যৌন হয়রানির আসামীদের খুঁজে বার করার ও আদালতের সামনে পেশ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তা থেকেই প্রমাণ হয় যে জার্মানি একটি ‘রেশ্ট-স্টাট' বা আইনশাসিত দেশ৷ এখানে অপরাধ করে একদিকে যেমন ছাড় নেই – অর্থাৎ বিচারহীনতা নেই – অন্যদিকে তেমন এ নিশ্চয়তা আছে যে, বিচারপ্রক্রিয়া হবে ন্যায্য ও আইনসম্মত৷ যার অর্থ দাঁড়াচ্ছে, এদেশে অপরাধী থেকে শুরু করে পুলিশ বা উকিল বা কারাগার কর্তৃপক্ষ, সবাই সংবিধান ও আইনের শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে যে যার নিজের কাজ – বা অকাজ – করে যাচ্ছেন৷ কোথাও কোনো ফাঁক বা ফাঁকি নেই, যা থেকে আসছে সরকার ও আইনব্যবস্থার উপর জনসাধারণের আস্থা ও নির্ভরশীলতা৷
নুরেমব্যার্গ ট্রায়ালে গোনাগুনতি ২৪ জন উচ্চপদস্থ নাৎসি কর্মকর্তার বিচার করে বাকি জার্মান জাতির জন্য একটা নিদর্শন স্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছিল৷ মিত্রশক্তিদের দখলীকৃত জার্মানিতে ডি-নাৎসিফিকেশন বা নাৎসি মানস বিতাড়নের কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি৷ বিশেষ করে সর্ষের মধ্যেই ভূত ছিল – অর্থাৎ যুদ্ধপরবর্তী বিচার বিভাগের বিচারক, কৌঁসুলি ও উকিলদের মধ্যে সাবেক নাৎসিদের অনুপাত ছিল মাত্রাতিরিক্ত রকম বেশি৷ গোড়ার দিকের বেশ কিছু জার্মান সাংসদেরও নাৎসি পটভূমি ছিল বলে শোনা যায়৷ স্বয়ং নোবেল পুরস্কার জয়ী লেখক গ্যুন্টার গ্রাস সারাজীবন মুখ ফুটে বলতে পারেননি যে, তিনি নাৎসিদের কুখ্যাত ওয়াফেন এসএস-এর সদস্য ছিলেন – ১৬ বছর বয়সে৷
তাই এ দেশে বিচারহীনতার অর্থ: গণতন্ত্রের অবসান, জার্মানরা যে মূল্য দিতে রাজি নন৷
আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷