1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

আইন ও আয়নায় শিশু অধিকার

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৮ এপ্রিল ২০২৩

বাংলাদেশে আইনে শিশুদের অধিকার অনেক৷ তাদের অধিকার লঙ্ঘন হলে শাস্তির কথাও বলা আছে আইনে৷ কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এখনো প্রতিকূল৷ এখনো শিশুদের অধিকারই সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘন হয়, শিশুরাই সবচেয়ে বেশি সহিংসতার শিকার হয়৷

বাংলাদেশের এক শিশু শ্রমিক৷
বাংলাদেশে কাগজে ও আইনে শিশুদের অধিকার অনেক থাকলেও তাদের অধিকারই সবচেয়ে বেশি লঙ্ঘন হয়৷ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

গত ২১ এপ্রিল মিরপুর এলাকার আট বছরের একটি শিশু ৯৯৯-এ ফোন করে তার বাবা-মায়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে৷ তার অভিযোগ হলো বাবা-মা সারাক্ষণ ঝগড়া করে৷ মা তাকে মারধর করে৷ মিরপুর থানা পুলিশ প্রাথমিক তদন্তের পর ওই দিনই শিশু ও তার মা-কে থানায় নিয়ে আসে৷ মিরপুর থানার ওসি মোহাম্মদ মোহসীন জানান, ‘‘থানায় ডেকে কথা বলার পর আমরা এখন কাউন্সেলিং-এর ব্যবস্থা করেছি৷ শিশুটি এখন বাবা-মায়ের সঙ্গেই আছে৷ আমরা নিয়মিত কাউন্সেলিং ছাড়াও খোঁজ-খবর রাখছি৷ মায়ের কিছুটা মানসিক সমস্যা আছে বলে মনে হ্চ্ছে৷ তবে নতুন করে কোনো অভিযোগ সে করেনি৷’’

শিশুটিকে তার বাবা ও স্কুলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল কোনো বিপদে পড়লে যেন ৯৯৯-এ ফোন করে৷ শিশুটি এভাবেই ৯৯৯-এর কথা জেনেছিল বলে জানান মোহাম্মদ মোহসিন৷

জাতীয় জরুরি সেবার (৯৯৯) পুলিশ ইন্সপেক্টর (মিডিয়া) আনোয়ার সাত্তার বলেন, ‘‘আমরা শিশুদের (১৮ বছর পর্যন্ত বয়স যাদের) নানা অভিযোগ নিয়ে কল পাই৷ এই অভিযোগের বড় একটি অংশ হলো পরিবারে তারা মারধর বা নির্যাতনের শিকার হচ্ছে৷ কিছু সমস্যা আমরা ফোনেই সমাধান করে ফেলি৷ আর যেগুলো জটিল, সেগুলো আমরা সংশ্লিষ্ট থানাকে দায়িত্ব দিই৷ তবে অভিযোগের একটি অংশের সত্যতা পাওয়া যায় না৷ বাবা-মায়ের প্রতি কোনো কোনো ক্ষোভের কারণে কেউ কেউ অভিযোগ করে৷ আর পরীক্ষার সময় আমরা প্রচুর কল পাই প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ নিয়ে৷’’

তিনি জানান, ‘‘আজও (বৃহস্পতিবার) আমরা একটি মেয়ের অভিযোগ পেয়েছি৷ মেয়েটি বলছে, তার মা তাকে মারধর করে৷ মা বলছেন, মেয়েটি অবাধ্য এবং প্রেম করে৷ আমরা বিষয়টি দেখার জন্য সংশ্লিষ্ট থানাকে যুক্ত করেছি৷’’

অভিযোগ গ্রহণের পর নিয়মিত ফলোআপ করা হয় বলেও কথা জানান তিনি৷

তিনি জানান, ২০২২ সালে তারা ৮৪ লাখ ৩৯ হাজার ২৩৪টি কল পেয়েছেন৷ এর মধ্যে শিশুরা কল করেছে দুই লাখ ৫৮ হাজার ৩৯টি৷

সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে একটি শিশু সহায়তা সেল আছে, যার নাম্বার ১০৯৮৷ টোল-ফ্রি এই নাম্বারে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুরা ফোন করে তাদের সমস্যা বা অভিযোগ জানাতে পারে৷ তারা আইনিসহ সব ধরনের সহায়তা করে৷ তাদের হিসাব অনুযায়ী, তারা ২০১৫ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২২ সালের জুন মাস পর্যন্ত সাত লাখ ৮৩ হাজার ৮৪৫টি কল গ্রহণ করেছেন৷ তার মধ্যে ৯ হাজার ৮৭২ টি শিশু নির্যাতনের ঘটনার প্রতিকার, আট হাজার ৩৪৭ টি পরিবারিক সমস্যা সমাধান, ১১ হাজার ২১৩ জন গৃহহীন ও সহায়সম্বলহীন হারিয়ে যাওয়া শিশুর নিরাপদ আবাস বা পরিবারে স্থানান্তর, ২০ হাজার ১৩৮ জন শিশুকে আইনি সহায়তা, ৫৩ হাজার ৪৫৩ জন শিশুকে স্বাস্থ্য বিষয়ে তথ্য ও পরামর্শ প্রদান, ১৯ হাজার ২১৭ জন শিশুকে বিদ্যালয়ে পড়াশুনার ব্যাপারে, স্কুল শিক্ষক, ম্যানেজিং কমিটি ও অভিভাবকের সাথে যোগাযোগের মাধ্যমে সহায়তা, ৬৬৮ জনকে মাদক ও অন্যান্য নেশার ব্যবহার ও ক্ষতি সম্পর্কে পরামর্শ ও নিরাময় সেন্টারে রেফার এবং দুই হাজার ৯৯৭ জন শিশুর বাল্য বিবাহ বন্ধ করেছেন৷

আমরা ২৪ ঘণ্টা সহায়তা দেই: শিশু সহায়তা সেলের ম্যানেজার

This browser does not support the audio element.

সেলের ম্যানেজার মোহাইমেন চৌধুরী বলেন, ‘‘শিশুদের অভিযোগগুলো ১৯৮টি ভাগে ভাগ করা যায়৷ আমাদের কাউন্সেলিংয়ের টিম আছে৷ মোবাইল টিম আছে৷ সারা দেশে নেটওয়ার্ক আছে৷ আমরা প্রশাসন, পুলিশ, সাংবাদিক, জনপ্রতিনিধি সবার সহায়তা নিই৷ ফোন পাওয়ার পর তার তথ্য নিয়ে তাতে সহায়তা করি৷ এটা ফলোআপের মধ্যে রাখা হয়৷ আর শুধু শিশু নয়, তার সমস্যা নিয়ে অভিভাবক, প্রতিবেশী এমনকি পথচারি পর্যন্ত সবাই আমাদের সহায়তা চাইতে পারেন৷ আমরা শিশু অধিকার আইন অনুযায়ী তাদের সহায়তা করি৷’’

তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘আমরা ২৪ ঘণ্টা সহায়তা দেই৷ প্রতিদিন গড়ে ৯০০ থেকে ১২০০ কল পাই৷ তবে আমরা ১০ ধেকে ১৫ ভাগ মানুষের কাছে পোঁছতে পেরেছি৷ তাই আমরা নানা ধরনের প্রচার চালাচ্ছি৷ আমাদের ফেসবুক পেজেও অভিযোগ করা যায়৷ কাউকে চিহ্নিত করতে আমরা প্রয়োজনে ফেসবুক কর্তৃপক্ষেরও সহায়তা নিই৷’’

১৮ বছরের কমবয়সি শিশুকে আটক করে পুলিশ তার বয়স ২১ বছর দেখাচ্ছে: ইশরাত হাসান

This browser does not support the audio element.

শিশুর প্রতি সহিংসতা

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর হিসেবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ২২৫টি শিশু নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হয়েছে৷ তাদের মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৮ জন৷ শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৪৩ জন৷ পরিবারে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ছয় জন, শিক্ষকের হাতে ৩৬ জন৷ ২০২২ সালে নির্যাতনের শিকার হয়েছে এক হাজার ৮৮টি শিশু, ধর্ষণের শিকার হয়েছে ১০১ জন, শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১০২ জন৷ পরিবারে ২৪ জন এবং শিক্ষকের হাতে ১০৯ জন৷ সংস্থাটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্যের ভিত্তিতে এই হিসাব দিয়েছে৷ বাস্তবে এই সংখ্যা আরো বেশি৷
চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ১২৮টি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে, ২০২২ সালে হত্যার শিকার হয়েছে ৫১৬টি শিশু৷ হত্যার ঘটনায় শতকরা ৫০ ভাগ ক্ষেত্রে মামলা হলেও নির্যাতনের ঘটনায় মামলা হার শতকরা ৪০ ভাগের বেশি নয়৷

শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি
শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়েও আছে নানা বিচ্যুতি৷

মাধ্যমিকে দুই বছরে চার লাখেরও বেশি শিশু ঝরে পড়েছে৷ তাদের মধ্যে মেয়ে ৬২.৬৩ শতাংশ৷ সারাদেশে ২৩ লাখের বেশি শিক্ষার্থী নবম শ্রেণিতে রেজিস্ট্রেশন করলেও সেখান থেকে ঝরে গেছে চার লাখের বেশি৷ এই সময়ে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী কমেছে ১৪ লাখ ৫০ হাজার৷ প্রাথমিক বিদ্যালয় শুমারিতে (এপিএসসি) এসব তথ্য উঠে এসেছে৷ প্রাথমিকে ঝরে পড়ার হার এখন ১৪.১৫ শতাংশ৷ তিন ভাগ শিশু স্কুলেই যায়না৷
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ২০২২ সালে ৫৮৬ সরকারি হাসপাতালে জীবিত জন্ম নিয়েছে চার লাখ ৪৭ হাজার ১৭১ শিশু৷ প্রতি হাজার জীবিত জন্মে প্রায় ২৪টি নবজাতকের মৃত্যু হয়েছে, যা চার বছরে সর্বোচ্চ৷ ২০২১ সালের তুলনায় এই হার ৩৩ শতাংশ বেশি৷ বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের ২০২০ সালের তথ্যমতে, দেশে প্রতি হাজার জীবিত জন্মে নবজাতক মৃত্যুর হার ১৫৷
বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী তিন লাখেরও বেশি শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে৷ মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় শিশুদের মধ্যে মারাত্মক অপুষ্টির কেন্দ্রস্থল ভারত এবং পাকিস্তান ৷ ভারতে অপুষ্টির শিকার ৫৭ লাখ ৭২ হাজার ৪৭২ জন শিশু, পাকিস্তানে অপুষ্টির শিকার ছয় লাখ ৭৮ হাজার ৯২৫ জন৷ আর বাংলাদেশে তিন লাখ ২৭ হাজার ৮৫৯ জন শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে৷
শিশুর অধিকার ও শিশু আইন:
বাংলাদেশে শিশু আইন ২০১৩ তে শিশুদের অধিকার এবং তাদের অধিকার লঙ্ঘনে শাস্তির বিধান আছে৷ শিশু অধিকার কীভাবে কার্যকর করা হবে তাও বলে দেয়া আছে৷ এই আইনে ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত শিশু হিসেবে গণ্য করা হয়৷ আইনটি বাস্তবায়নের বড় দায়িত্ব সমাজসেবা অধিদপ্তরের৷ জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ বাস্তবায়নেই এই আইনটি করা হয়৷ কিন্তু বাস্তবে এর প্রয়োগ তেমন হচ্ছেনা৷ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান বলেন," রাষ্ট্র ও সমাজের নানা সংস্থা শিশুদের প্রতি বেআইনি আচরণ করছে৷ ১৮ বছরের কম বয়সি একটি শিশুকে আটক করে পুলিশ তার বয়স ২১ বছর দেখাচ্ছে৷ তখন সে এই আইনের প্রটেকশন পাচ্ছেনা৷ আদালতে তখন বয়স নির্ধারণের প্রশ্ন আসে৷ ততদিনে শিশুটি প্রাপ্ত বয়স্কদের সঙ্গে কারাগারে থেকে হয়তো অপরাধী হয়ে ওঠে৷ এখানে সমাজসেবা দপ্তরের প্রবেশন অফিসারের দায়িত্ব আছে৷ কিন্তু তিনি দায়িত্ব পালন করেন না৷”
"বাংলাদেশে বাস্তবে আলাদা শিশু আদালত নেই৷ কোনো একটি আদালতকে বাড়তি শিশু আদালতের দায়িত্ব দেয়া হয়৷ ফলে শিশুদের প্রতি কী আচরণ করতে হবে তা তারা জানে না৷ শিশুকে হ্যান্ডকাফ পরানো হয়৷ তাদের প্রতি নির্মম আচরণ করা হয়,” বলেন এই আইনজীবী৷
তার কথা," শিশুর প্রতি সহিংসতার বীজ আমাদের এই সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিবারে আছে৷ শিশুর অধিকার লঙ্ঘন করলে তেমন বিচার হয় না৷ তাই শিশুর অধিকারও প্রতিষ্ঠা পায় না৷”
আইনে অনেক কমিটি, ব্যবস্থা ও সিস্টেমের কথা বলা হলেও বাস্তবে সেগুলো নেই বলে জানান তিনি৷
শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন "অপরাজেয় বাংলাদেশ”-এর প্রধান ওয়াহিদা বানু মনে করেন, " শিশুদের নিয়ে আইন এবং অনেক নীতি তৈরি করা হলেও সেটা বাস্তবায়ন হচ্ছে অনেক ধীর গতিতে৷ শিশুরা ভোটার না তাই রাজনীতিবিদরা তাদের দিকে নজর দিতেন৷ তারা যদি ভোটার হতো তাহলে নির্বাচনের আগে হলেও তারা তাদের জন্য কিছু করতো৷”
তার কথা," শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের পাচার করা হচ্ছে, ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, তাদের অপরাধমূলক কাজে বাধ্য করা হচ্ছে কিন্তু এর তেমন কোনো বিচার নেই৷ শিশুরা ঘর, স্কুলসহ সব জায়গায় সহিংসতার শিকার হচ্ছে কিন্তু প্রদিকার তেমন নেই৷”
"শিশু আইনের সুবিধা শিশুরা না পেলেও এর সুবিধা নিচ্ছে অপরাধীরা৷ কিশোর গ্যাং গড়ে তুলছে বয়স্ক অপরাধীরা৷ শিশুদের ব্যবহার করছে৷ কারণ, তারা জানে শিশু আইনে তারা কী সুবিধা পারে৷ কিন্তু নেপথ্যের অপরাধীকে ধরা হচ্ছে না৷ অপরাধীদের কারণে শিশুরা মাদকে জড়িয়ে পড়ছে,” বলেন তিনি৷
তিনি মনে করেন,"শিশুদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুষ্টিসহ সব অধিকার নিশ্চিত করতে হলে রাষ্ট্রকে আরো বেশি উদ্যোগী হতে হবে৷”

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ