পরিবারের সম্মান রক্ষার্থে ২০১৫ সালে পাকিস্তানে কমপক্ষে ১,১০০ নারীকে হত্যা করা হয়েছে৷ ‘অনার কিলিং’ হিসেবে পরিচিত এই ধরণের হত্যাকাণ্ড থামাতে আইন থাকলেও তা বন্ধ করা যাচ্ছে না৷
বিজ্ঞাপন
গত জুন মাসে লাহোরের এক মা তাঁর ১৮ বছরের মেয়ের গায়ে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলেন৷ মেয়ের অপরাধ, সে পরিবারের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ভালোবাসার মানুষকে বিয়ে করেছে৷
তারও আগে পাঞ্জাব প্রদেশে ১৯ বছরের এক স্কুল শিক্ষিকাকে তাঁর চেয়ে দ্বিগুণ বয়সের একজন মানুষকে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় পুড়িয়ে মারা হয়৷
বেসরকারি সংস্থা ‘হিউম্যান রাইটস কমিশন অফ পাকিস্তান'- এর হিসেবে, গত বছর প্রায় ১,১০০ নারী অনার কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন৷
সে দেশের মানবাধিকার কর্মী তাহিরা আব্দুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ইদানিং এই ধরণের হত্যাকাণ্ডের খবর গণমাধ্যমে বেশি আসায় মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ তবে পাকিস্তানি সমাজে রাজনীতি ও আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে মডারেটদের তুলনায় ধর্মীয় উগ্রবাদীদের ভূমিকা বেড়ে যাওয়ায় সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না৷
ভাইয়ের হাতে খুন হওয়া পাকিস্তানের সেই বিতর্কিত মডেল
পাকিস্তানে নিজের ভাইয়ের হাতে খুন হয়েছেন বিতর্কিত মডেল কন্যা কান্দিল বেলুচ৷ ‘অনার কিলিং’ এর শিকার এই নারী সেদেশের ইন্টারনেট জগতে আলোড়ন তুলেছিলেন খোলামেলা ছবি প্রকাশ করে৷
ছবি: Instagram/quandeel_baloch
ফেসবুকে ‘লজ্জাজনক’ ছবি দেয়ায় খুন!
পাকিস্তানের মুলতানে নিজ বাড়িতে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় মডেল কান্দিল বেলুচকে৷ তাঁর ভাই ওয়াসিম আজিম দাবি করেছে, ফেসবুকে ‘লজ্জাজনক’ ছবি প্রকাশ করায় পরিবারের সম্মান রক্ষার জন্য বোনকে খুন করেছেন তিনি৷
ছবি: Facebook/Qandeel Baloch via Reuters
ইন্টারনেটে আলোচিত কান্দিল বেলুচ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় এবং বিতর্কিত ছিলেন কান্দিল বেলুচ৷ রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা এই মডেলের টুইটার অনুসারীর সংখ্যা পয়তাল্লিশ হাজারের বেশি এবং ফেসবুকে তা প্রায় আট লাখ৷
ছবি: Instagram/quandeel_baloch
পাকিস্তানের ‘কিম কার্দাশিয়ান’
বেলুচকে অনেকে তুলনা করতেন মার্কিন টিভি অভিনেত্রী কিম কার্দাশিয়ানের সঙ্গে৷ ছবি শেয়ার করার ওয়েবসাইট ইন্সটাগ্রামে কার্দাশিয়ানের মতো করে তোলা বেশ কিছু ছবি, ভিডিও শেয়ার করেছিলেন তিনি৷ ছবিগুলো বেশ খোলামেলা৷ এর আগে পাকিস্তানের কোনো মডেলকে এভাবে ছবি পোস্ট করতে দেখা যায়নি৷
ছবি: Instagram/quandeel_baloch
‘নগ্ন’ হওয়ার ঘোষণা
চলতি বছর টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপ চলাকালে পাকিস্তান ভারতকে হারালে নগ্ন হয়ে নাচবেন বলে ঘোষণা দিয়ে তুমুল বিতর্কের জন্ম দিয়েছিলেন বেলুচ৷ পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে হেরে যাওয়ায় নগ্ন না হতে পারার দুঃখে কাঁদার একটি ভিডিও প্রকাশ করেন ইউটিউবে৷ পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্মের কাছে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা এই মডেল৷
ছবি: Instagram/quandeel_baloch
ইসলামের ‘কলঙ্ক’
তাঁর সঙ্গে সেলফি তুলে ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সকল পদ হারান পাকিস্তানের মুফতি আবদুল কাভি৷ পাকিস্তানের তেহরিক-ই-ইনসাফের নেতা এবং ধর্মগুরু হিসেবে পরিচিত কাভি-কে ইসলামের ‘কলঙ্ক’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছিলেন বেলুচ, কেননা, তাঁর দাবি ছিল, টিভিতে ধর্মের কথা বললেও আড়ালে তাঁর সঙ্গে অনৈতিক কিছু করার ইঙ্গিত দিয়েছিলেন কাভি৷
ইন্টারনেটে সাহসিকতার নানা নমুনা রাখলেও ক্রমাগত বিতর্কের মাঝেই এক পর্যায়ে নিজের জীবন নিয়ে শঙ্কায় পড়ে যান কান্দিল বেলুচ৷ খুন হওয়ার কয়েক সপ্তাহ আগে তাই পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ কয়েকজনের কাছেই নিজের নিরাপত্তা দাবি করেছিলেন৷
ছবি: picture-alliance/Pacific Press/R.S. Hussain
শাস্তি হবে কি?
উল্লেখ্য, পাকিস্তানে প্রতিবছর গড়ে এক হাজারের মতো ‘অনার কিলিং’ এর ঘটনা ঘটে৷ এগুলোকে হত্যাকাণ্ড হিসেবেই বিবেচনা করে বিচারের ব্যবস্থা থাকলেও পাকিস্তানের আইনে পরিবার চাইলে হত্যাকারীকে ক্ষমা করে দেয়ার সুযোগ রয়েছে৷ আর এই সুযোগ নিয়ে অনেক সময় হত্যাকারী পার পেয়ে যায়৷
ছবি: Getty Images/AFP/S.S. Mirza
7 ছবি1 | 7
অনার কিলিং বন্ধে ২০০৪ সালে যে আইন হয়েছে, তা আরও শক্তিশালী করার প্রস্তাব দিয়েছেন আব্দুল্লাহ৷ তিনি বলেন, ‘‘বর্তমানে এ ধরণের হত্যাকাণ্ডগুলোর অধিকাংশই আদালত পর্যন্ত যায় না৷ ফলে অপরাধ করেও পার পাওয়া যায় এমন একটি ধারণা প্রতিষ্ঠা পেয়েছে৷''
এসব ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকেই ভুক্তভোগীর দায়িত্ব নিতে হবে এবং অপরাধীদের জন্য কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে বলে জানান আব্দুল্লাহ৷ গণমাধ্যমের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘‘অনার কিলিং বিষয়ে প্রতিবেদন করতে গিয়ে অনেক সময় দেখা যায় তারা অনিচ্ছাকৃতভাবে অপরাধীকেই নায়ক বানিয়ে দিচ্ছে৷''
সমাজকর্মী ও চলচ্চিত্র নির্মাতা সমর মিনুল্লাহ ডয়চে ভেলেকে বলেন, শুধু আইন করে এমন হত্যাকাণ্ড বন্ধ হবে না৷ ‘‘যতদিন না মানুষের মধ্যে নারীর প্রতি ইতিবাচক মনোভাব আসবে, ততদিন পর্যন্ত এই অবস্থা চলতে থাকবে,'' বলেন তিনি৷
অনার কিলিং বন্ধে ভূমিকা না নেয়ায় ধর্মীয় নেতাদের সমালোচনা করেন মিনুল্লাহ৷ সে দেশের শীর্ষস্থানীয় ধর্ম বিষয়ক নীতি নির্ধারণী সংস্থা ‘কাউন্সিল অফ ইসলামিক ইডিওলজি' (সিআইআই)-র দেয়া সাম্প্রতিক এক বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘‘তাঁরা (সিআইআই) প্রয়োজন হলে স্বামী স্ত্রীকে ‘অল্প প্রহার' করতে পারবে, এমন বিষয় নিয়ে কথা বললেও, কখনো নারী নির্যাতনের সমালোচনা করেন না৷''