বাংলাদেশে চলছে বিরোধী দলের অবরোধ কর্মসূচি৷ বরাবরের মতো এই কর্মসূচি পালনের সময়েও গাড়ি-বাড়ি পোড়ানো এবং হতাহতের ঘটনা ঘটেছে৷ ব্লগার শেখ মোহাম্মদ রাসেল তাই আইন করে হরতাল বন্ধ করার পক্ষে৷
বিজ্ঞাপন
সামহয়্যার ইন ব্লগে ‘আইন করে হরতাল নিষিদ্ধ করা হোক' – এই শিরোনামে একটি পোস্ট দিয়েছেন শেখ মোহাম্মদ রাসেল৷ লেখার শুরুতে ‘হরতাল' শব্দের উৎপত্তি এবং হরতাল আসলে কেমন হওয়ার কথা, সে সম্পর্কে তিনি ধারণা দিয়েছেন এভাবে, ‘‘হরতাল শব্দটি মূলত একটা গুজরাটি শব্দ (গুজরাটিতে হাড়তাল) যা সর্বাত্মক ধর্মঘটের প্রকাশক৷ মহাত্মা গান্ধী ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন৷ হরতালের সময় সকল কর্মক্ষেত্র, দোকান, আদালত বন্ধ থাকে৷ তবে সাধারণত অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ারসার্ভিস, গণমাধ্যমসমূহ এর আওতার বাইরে থাকে৷''
উইকিপিডিয়া থেকে এসব তথ্য পরিবেশন করার কথাও জানিয়েছেন শেখ মোহাম্মদ রাসেল৷ তারপর লিখেছেন, ‘‘গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় হরতালকে গণতান্ত্রিক অধিকার হিসেবেই মানা হয় – এই উক্তিটির চর্চা আমরা সব সময়ই করে থাকি৷ দাবি-দাওয়া, আলোচনা ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে আদায় না হলে সর্বশেষ পন্থা হিসেবে চূড়ান্ত পর্যায়ে এই পন্থাটিকে ব্যবহার করা হয় প্রতিপক্ষকে বাধ্য করার জন্য৷ হরতালের বিরুদ্ধে দায়ের করা একটি মামলা আদালত খারিজ করে দিয়েছে এই বলে যে, হরতাল নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার৷ (সুত্র: প্রথম আলো ১১জুন ২০১২)''
হরতালের আগুনে জ্বলছে বাংলাদেশ
যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রতিবাদে চলতি সপ্তাহে হরতালের সূচনা করে জামায়াত-শিবির৷ এএফপির হিসেবে গত ২১শে জানুয়ারি থেকে ৪ই মার্চের মধ্যে বাংলাদেশে সহিংসতায় প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি৷ হরতালের কিছু ছবি নিয়ে ছবিঘর৷
ছবি: Reuters
বরিশালে অগ্নিসংযোগ
জামায়াত-শিবিরের ডাকা হরতালের দ্বিতীয় দিন ৪ই মার্চ বরিশালে মোটর সাইকেলে অগ্নি সংযোগ করছে দলটির সমর্থকরা৷ এভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় হরতালের সময় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, পুলিশের উপর হামলায় অংশ নেয় জামায়াত-শিবিরের সমর্থকরা৷ উদ্দেশ্য, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ করা৷
ছবি: Reuters
সহিংসতায় নিহত কমপক্ষে ৮০
ঢাকায় ৪ মার্চ হরতাল চলাকালে জামায়াতে ইসলামী কর্মী সন্দেহে এক ব্যক্তিকে আটক করছে পুলিশ৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধের দাবিতে গত ২১শে জানুয়ারি থেকে জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন সহিংস কর্মসূচিতে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৮০ ব্যক্তি৷ নিহতদের মধ্যে জামায়াত-শিবিরের সদস্য ছাড়াও পুলিশ, আওয়ামী লীগ কর্মী, নিরীহ পথচারী এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নাগরিকও রয়েছেন৷
ছবি: Reuters
ট্রেনে আগুন
ঢাকায় হরতাল চলাকালে ৪ মার্চ কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে অবস্থানরত একটি ট্রেনে আগুন লাগে৷ ছবিতে আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন জনতা৷ ঢাকা থেকে নোয়াখালিগামী ট্রেনটির তিনটি বগি আগুনে পুড়ে গেছে৷ রেলমন্ত্রী মাজিবুল হক ট্রেনে অগ্নিসংযোগের জন্য জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করেছেন৷
ছবি: Reuters
মসজিদ থেকে গ্রেপ্তার
হরতাল চলাকালে ৪ মার্চ ঢাকার একটি মসজিদ থেকে জামায়াত কর্মী সন্দেহে কয়েকজনকে আটকে করে পুলিশ৷ জামায়াতের ভাইস-প্রেসিডেন্ট দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেওয়ার পর বাংলাদেশে সহিংসতার তীব্রতা বেড়ে যায়৷ ২৮ ফেব্রুয়ারি এই রায় ঘোষণার পর বিভিন্ন জায়গায় সহিংসতায় ৪ মার্চ অবধি প্রাণ হারিয়েছেন ৬৪ ব্যক্তি৷
ছবি: Reuters
অব্যাহত অগ্নিসংযোগ
হরতালের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে অগ্নিসংযোগ৷ রাস্তায় টায়ার পোড়ানো, গাড়িতে আগুন, ট্রেনে আগুন, মার্কেটে আগুন – চলতি হরতালে সবই দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ৷ ইলেকট্রনিক মিডিয়ার কল্যাণে এখন হরতালের সহিংসতার ভিডিও পৌঁছে যাচ্ছে বিশ্বের সব প্রান্তে৷ ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ৩ মার্চ রাস্তায় অগ্নিসংযোগ করছে জামায়াতের সমর্থকরা৷
ছবি: Reuters
‘কপাল পোড়ে’ সাধারণ মানুষের...
জীবিকার তাগিদে রাস্তায় নেমেছিলেন এই অটোরিকশা চালক৷ ২ মার্চ ঢাকায় জামায়াতের কর্মীদের ছোড়া ইটের টুকরায় গুরুতর আহত হন তিনি৷ অটোরিকশাও ভেঙ্গে গেছে৷ রাজনৈতিক সহিংসতায় এভাবেই ‘কপাল পোড়ে’ সাধারণ মানুষের৷
ছবি: Reuters
শরিক জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপি’র তাণ্ডব
দুই মার্চ ঢাকায় এভাবেই গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র কর্মীরা৷ সেদিন ঢাকায় মিছিল করেছিল বিএনপি এবং জামায়াতের সমর্থকরা৷ পুলিশ অবশ্য বিরোধীদের কঠোর হাতে মোকাবিলার চেষ্টা করছে৷
ছবি: Reuters
রাবার বুলেট, বুলেট
২ মার্চ ঢাকায় বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ চলাকালে বন্দুকে রাবার বুলেট ‘লোড’ করছেন এক পুলিশ কর্মকর্তা৷ তবে এক প্রত্যক্ষদর্শী জানিয়েছেন, সেদিন সংঘর্ষ চলাকালে সত্যিকারের বুলেটও ব্যবহার করে পুলিশ৷ এছাড়া হরতাল চলাকালে বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পুলিশ আত্মরক্ষায় বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে৷
ছবি: Reuters
চোখের সামনে জ্বলছে আগুন
২ মার্চ ঢাকায় বিএনপি সমর্থকরা গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে৷ ছবিতে পুলিশ একটি জ্বলন্ত গাড়ি দেখছে৷ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রক্রিয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে চলমান সহিংসতাকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়ে জামায়াত-শিবিরকে সমর্থন জানিয়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি৷
ছবি: Reuters
একদিনে নিহত কমপক্ষে ৩৪
২৮ ফেব্রুয়ারি সাঈদীকে ফাঁসির রায় ঘোষণার দিনে সহিংসতায় বাংলাদেশে প্রাণ হারিয়েছেন কমপক্ষে ৩৪ ব্যক্তি৷ এদের মধ্যের ২৩ জন পুলিশ এবং ইসলামপন্থিদের মধ্যে সংঘর্ষ চলাকালে গুলিবিদ্ধ হন৷ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে একদিনে এত সহিংসতা দেখেনি বাংলাদেশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
10 ছবি1 | 10
কিন্তু তারপরই শেখ মোহাম্মদ রাসেলের লেখায় প্রকাশিত হয় হতাশা৷ বাংলাদেশে হরতালের অতীত এবং বর্তমানকে স্মরণ করতে গিয়েই মূলত এ হতাশার সূচনা৷ রাসেল লিখেছেন, ‘‘যে দলই বিরোধী দলে থাকুক না কেন, হরতালকে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার বলে দাবি করে, আর সরকারি দলে থাকলে হরতাল বিরোধী কথা বলে৷ তবে ১৯৯০ সালের পর থেকে জাতীয় ইস্যু নিয়ে অথবা জনদাবি নিয়ে কোনো প্রধান বিরোধী দল হরতাল দেয়নি৷ যখনই তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন বাধাগ্রস্থ হয়েছে, তখনই তারা হরতালকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে৷ কোনো দলই হরতাল নিষিদ্ধ করার কথা ভাবেনি কখনো, কারণ, তারা জানে যে বিরোধী দলে গেলে হরতালই হবে তাদের একমাত্র হাতিহার৷''
এ পর্যায়ে আওয়ামী লীগের হরতালের অতীতও তুলে ধরেছেন সামহয়্যার ইন ব্লগের এই ব্লগার৷ ‘আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে গেলেও কখনো হরতাল দেবে না' – অতীতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এমন বক্তব্য দেওয়ার পরও ২০০১ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে ১৩০ দিন হরতালের ডাক দিয়েছিলেন বলে জানিয়েছেন তিনি৷ তারপর আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কখন কতদিন হরতালের কর্মসূচি পালন করেছে, তার একটা খতিয়ানও দিয়েছেন৷ হিসেবের আলোকে শেখ মোহাম্মদ রাসেল মনে করেন, ‘‘যে দলই বিরোধী দলে থাকুক না কেন, যখনই তাদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সংকুচিত হয়েছে তখনই হরতালকে ব্যাবহার করেছে তারা নিষ্ঠুরভাবে৷ শুধুমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে গত ২০ বছরে ৪৫০ দিনেরও বেশি হরতাল হয়েছে বাংলাদেশে৷''
হরতালকে কেন্দ্র করে গত কয়েক মাসে যে পরিমাণ সম্পদ এবং প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, তাতে শেখ মোহাম্মদ রাসেল খুব হতাশ৷ তাই তিনি লিখেছেন, ‘‘বাংলাদেশে হরতালের নামে যা শুরু হয়েছে, তা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না৷ জ্বালাও, পোড়াও, মানুষ হত্যা – এসব কোনো রাজনৈতিক অধিকার হতে পারে না৷ এই সব এ দেশকে চেটেপুটে খাওয়ায় এক নিষ্ঠুর বাহানা মাত্র৷ যে বাহানার মাসুল সাধারণ জনগণকে দিতে হয়, নেতাদের নয়৷ তাই আমরা চাই কঠোর আইন প্রয়োগ করে এ দেশ থেকে চিরতরে হরতাল নামক রাজনৈতিক নোংরা খেলাটি নিষিদ্ধ করা হোক৷''