আইন-শৃঙ্খলার অভাবেই কি পশ্চিমবঙ্গে সহিংসতা?
৭ মে ২০২২পশ্চিমবঙ্গের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে বিরোধীরা বরাবরই সরব৷ সাম্প্রতিক সময়ের একাধিক ঘটনায় সেই রব আরো উচ্চগ্রামে পৌঁছেছে৷ রামপুরহাটের বগটুই গ্রামের গণহত্যা, হাঁসখালিতে কিশোরীকে ধর্ষণের পর মৃত্যু সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছে৷ এ ছাড়াও বেশ কয়েকটি খুন ও ধর্ষণ পরপর ঘটে যাওয়ায় এ নিয়ে রাজ্য রাজনীতি উত্তপ্ত৷ একাধিক ঘটনার নেপথ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের নাম উঠে আসায় রাজ্য সরকারকে বরখাস্ত করার দাবি উঠেছে৷
জাতীয় ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর রিপোর্ট বলছে, ২০১২ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত রাজ্যে খুন, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানির ঘটনা অনেকটাই বেড়েছো৷ যদিও প্রশাসন পাল্টা দাবি করছে, সার্বিকভাবে রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভাল৷ কয়েকটি ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশ দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে৷ কিন্তু ভাইরাল ভিডিওর দৌলতে সম্প্রতি একাধিক খুনের ছবি ধরা পড়ায় শিউরে উঠছে সাধারণ মানুষ৷
বগটুইয়ে তৃণমূল নেতা ভাদু শেখ, পানিহাটির তৃণমূল কাউন্সিলর অনুপম দত্তের খুনের দৃশ্যের থেকেও ভয়াবহ ছবি উঠে এসেছে মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থেকে৷ এ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলার প্রশ্নটি তোলা হচ্ছে আরো জোরালোভাবে৷
বহরমপুরে কম্পিউটার সায়েন্সের মেধাবী ছাত্রের বিরুদ্ধে প্রেমিকাকে খুনের অভিযোগ৷ ভিডিওতে দেখা যায়, ছাত্র সুশান্ত চৌধুরী প্রকাশ্যে ছুরি হাতে উন্মত্ত ভাবে কোপাচ্ছে নিজের প্রেমিকাকে৷ খুনের সময় কয়েকজনের সঙ্গে কথাও বলছে সে৷ এই ঘটনায় স্থানীয় বাসিন্দারা আতঙ্কিত৷ এর বিরুদ্ধে মোমবাতি মিছিল করেন বহরমপুরের কংগ্রেস সাংসদ অধীর চৌধুরী৷ প্রতিবাদ মিছিল করে এআইডিএসও৷ অধীরের মন্তব্য, ‘‘রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কোথায় এসে পৌঁছলে এভাবে প্রকাশ্যে খুন করা সম্ভব!’’
ভোট পরবর্তী হিংসায় বহু কর্মী খুন হয়েছেন বরে অভিযোগ বিজেপির৷ শুক্রবার কলকাতার কাশীপুরে এক বিজেপি কর্মীকে খুনের অভিযোগে হয়ে গিয়েছে তুলকালাম৷ এই সময় রাজ্যে উপস্থিত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রিপোর্ট তলব করেছেন রাজ্যের কাছে৷ রাজ্যের বিজেপি সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ ফের রাষ্ট্রপতি শাসন জারির দাবি তুলেছেন বঙ্গে৷ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীও আগে একই দাবি জানিয়েছেন কেন্দ্রের কাছে৷ তবে সূত্রের খবর, শুক্রবার বঙ্গ বিজেপির সাংগঠনিক বৈঠকে অমিত শাহ এই দাবি খারিজই করে দিয়েছেন৷ তাঁর বার্তা, গণতান্ত্রিক উপায়ে আন্দোলন চালিয়ে সরাতে হবে তৃণমূলকে৷ পর্যবেক্ষকদের মতে, গত বছর বিপুল ভোটে বিধানসভা নির্বাচনে জিতে আসা তৃণমূলকে সরানোর ঝুঁকি নিতে চায় না কেন্দ্র৷
এদিকে খুন-ধর্ষণকে শুধু আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে দেখতে রাজি নন অনেক বিশেষজ্ঞই৷ নদিয়ার পলাশিপাড়ায় একই পরিবারের তিন জনকে নৃশংসভাবে খুনের ঘটনায় উঠে আসছে প্রেমের সম্পর্কের কথা৷ আবার কোথাও ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে নাবালকের বিরুদ্ধে৷ শুধু পুলিশি ব্যবস্থা জোরদার করে কি এর মোকাবিলা সম্ভব? প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্ব বিভাগের প্রধান সুহৃতা সাহা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমাদের চারপাশে হিংসার ছড়াছড়ি৷ প্রকাশ্যে হিংসার উদযাপন করা হচ্ছে৷ এমনকি গণমাধ্যমে যেভাবে হিংসা ক্রমাগত দেখানো হচ্ছে, তাতে মানুষের মনে যে স্টিগমা ছিল, তা দূরে সরে যাচ্ছে৷ হিংসা এখন মানুষের জীবনে প্রতিদিনের মতো স্বাভাবিক৷’’
খুনের পরও সুশান্ত লাথি মেরেছে প্রেমিকা সুতপার শরীরে৷ কেন এই ঘৃণা? ওই ছাত্রীর বিয়ে অন্যত্র ঠিক হয়েছিল৷ সাহিত্যিক-সম্পাদক জয়ন্ত দে বলেন, ‘‘ভোগবাদী সমাজব্যবস্থা এ জন্য দায়ী৷ মানুষ শুধু পেতেই চায়৷ নিজে না পেলে কেউ যেন না পায়, সেটাই চায়৷ বহরমপুরের ঘটনা তারই পরিণতি৷ শুধু আমাদের দেশে নয়, এটা পৃথিবী জুড়ে চলছে৷’’
এ জন্য যুব সমাজকে দায়ী করতে রাজি নন লেখক চন্দ্রিল ভট্টাচার্য৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘গতি এসেছে আমাদের জীবনে, ভালর সঙ্গে কিছু খারাপ জিনিসও এসেছে৷ অভিভাবকদের দায়িত্ব হলো ভাল জিনিসটির সঙ্গে সন্তানদের অভ্যস্ত করে তোলা৷ তাঁরা সেই দায়িত্ব পালন করতে না পারলে এমন ঘটনা ঘটবে৷’’