অজানার হাতছানি কাকে না টানে! অ্যাডভেঞ্চারের শখ কার না নেই! নিজে না পারলেও বই পড়ে দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর চেষ্টা করে অনেকেই৷ আইসল্যান্ডের এক দুর্গম হিমবাহের উপর সম্প্রতি এমনই এক অভিযান চালানো হলো৷
বিজ্ঞাপন
লাংইয়োকুল হিমবাহের কোলে পাহাড়ি অঞ্চল৷ জুন থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত বিশেষ ফোর হুইল ড্রাইভ জিপ নিয়ে সেখানে যাবার অনুমতি পাওয়া যায়৷ তবে পর্যটকদের এক দল শীতকালেই সেখানে যাবার উদ্যোগ নিয়েছে৷ ইউরোপের অন্যতম বিশাল হিমবাহ অতিক্রম করতে চেয়েছিল তারা৷ এই অভিযানে বেশ কয়েকদিন সময় লাগে৷ শুরুতেই সুইস অভিযাত্রী লেওনহার্ড ফপ বলেন, ‘‘আমাদের আশা, পথ শুধু সোজা হবে না৷ উঁচু-নিচু পথ হবে, জলের ধারা পেরোতে হবে৷ একটু অ্যাডভেঞ্চার হবে৷'' আরেক অভিযাত্রী উরসুলা ইয়ুংকার বলেন, ‘‘গত ১৫ বছর ধরে নিয়মিত আইসল্যান্ডে আসছি, তবে শীতে কখনো আসিনি৷ পাহাড়ে এমন ভ্রমণ করার ইচ্ছা চিরকালই ছিল৷''
আল্পস ভ্রমণ – অতীত এবং বর্তমান
এ বছর গ্রীষ্মে একদল পর্যটক সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতচূড়া ভ্রমণে গিয়েছিলেন৷ ১৮৬৩ সালে প্রথম পর্বতারোহীরা যে পথ ধরে আল্পস-এ গিয়েছিলেন, সেই পথ ধরেই গিয়েছিলেন তাঁরা৷
ছবি: PHOTOPRESS/Anthony Anex/Tourism Switzerland
পূর্বসূরিদের পথ ধরে
১৮৬৩ সালে বিশ্বে প্রথমবারের মতো একটি পর্যটন সংস্থা সুইজারল্যান্ডের আল্পস-এ একটি ভ্রমণের আয়োজন করেছিল৷ এ বছরের সুইস গ্র্যান্ড ট্যুর ২০১৩-তে একটি দল সেই সময়ের পথ ধরেই আল্পস ভ্রমণ করল৷ লিউকারবাড এবং কান্ডেরস্টেগের মধ্যকার গেমি পাস-এ দলটির অনেকে পর্বতারোহণও করেছে৷
ছবি: PHOTOPRESS/Anthony Anex/Tourism Switzerland
নোট নেয়া
সে সময়কার একজন পর্যটক মিস জেমিমা মোরেল ঐ ভ্রমণের পুরো বর্ণনা একটি ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করেছিলেন৷ সেই ডায়রির বর্ণনা নতুন দলটিকে সাহায্য করেছে পথ বেছে নিতে৷ জেমিমা সেসময় ইংল্যান্ডের অনেক স্থান ভ্রমণ করলেও বিদেশে সেটাই ছিল তাঁর প্রথম ভ্রমণ৷
ছবি: Thomas Cook
সঠিক পোশাকে পর্বতারোহণ
১৮৬৩ সালের ২৬শে জুন ‘জুনিয়র ইউনাইটেড আল্পাইন ক্লাব’ লন্ডন ব্রিজ থেকে তাদের তিন সপ্তাহের যাত্রা শুরু করেছিল৷ এই ছবিতে বাম দিক থেকে তৃতীয় নারীটিই জেমিমা৷ জেমিমা মোরেলসহ তখনকার নারীরা ভিক্টোরিয়া-যুগের পোশাকে অভ্যস্ত ছিলেন এবং তাঁদের হাতে থাকত একটি করে ছাতা৷
ছবি: Thomas Cook
আধুনিক পর্যটন ব্যবস্থা
১৮৬৩ সালের ঐ ভ্রমণের মাধ্যমে আধুনিক পর্যটন ব্যবসা শুরু হয় বলে অনেকের ধারণা৷ ইংল্যান্ডের ডার্বিশায়ারের থমাস কুক ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে তাঁর পর্যটন সংস্থাটি প্রথম চালু করেন৷ সুইজারল্যান্ড পর্যটন কোম্পানিগুলো তখন কুকের সাথে ব্যবসা শুরু করতে আগ্রহী হয়৷ তিনি ব্যবসার চেয়ে আগ্রহী ছিলেন তাঁর প্রতিষ্ঠানকে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে পরিচিত করতে৷
ছবি: Thomas Cook
ভ্রমণের টিকেট
১৮৬৩ সালের আগেও কিছু পর্যটন সংস্থা ছিল, কিন্তু কুক তাঁর ভ্রমণে এমন কিছু বিষয় জুড়ে দিলেন, যাতে তা পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠল৷ যেমন রেল, বাস কোম্পানিগুলোর সাথে যোগাযোগ করে তাঁর কোম্পানির সাথে যুক্ত করা৷ বিদেশের হোটেল বুকিং-এমন অনেক কিছু যুক্ত করেছিলেন কুক, যা পর্যটন ব্যবসায় একেবারেই নতুন ছিল৷
ছবি: Thomas Cook
গাইডস এবং ট্রাভেলারস চেক
এখানে যেমন দেখা যাচ্ছে – এ ধরনের ভ্রমণ বই দিয়ে প্রথমদিকে বেশ কিছু অর্থ উপার্জন করেছিলেন কুক৷ সেখানে থাকত ট্রেনের টাইমটেবিল৷ সেইসাথে তিনি ট্রাভেলারস চেকও আবিষ্কার করেছিলেন৷
ছবি: Thomas Cook
দরিদ্র কিন্তু সুন্দর
১৮৬০ সালে সুইরজারল্যান্ডের অবস্থা আজকের মতো এত ভালো ছিল না৷ অর্থাৎ, অর্থনীতির দিক দিয়ে দেশটি ছিল দরিদ্র৷ মোরেল তাঁর ডাইরিতে সুইজারল্যান্ডের গ্রামগুলোর তখনকার চিত্র তুলে ধরেছেন৷ কিন্তু কুকের পর্যটন সংস্থা সুইজারল্যান্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যকে পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় করে তোলে, বিশেষ করে সুইস আল্পসকে৷
ছবি: PHOTOPRESS/Anthony Anex/Tourism Switzerland
আল্পসের স্বর্ণযুগ
সুইজারল্যান্ডে কুকের পর্যটন ব্যবসা সেদেশে পর্বতারোহণকে জনপ্রিয় করে তোলে৷ এ কারণে সেই সময়টাকে আল্পসে পর্বাতারোহণের স্বর্ণযুগ বলা হয়৷ অনেক ব্রিটিশ পর্বতারোহী সুইস আল্পসে প্রথমবারের মতো আরোহন করেছিলেন৷ এডওয়ার্ড উইম্পার তাঁদেরই একজন, যিনি আল্পস পর্বত চূড়ায় প্রথম উঠেছিলেন ১৮৬৫ সালে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
8 ছবি1 | 8
বিশেষ অনুমতি নিয়ে অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী এই দল অভিজ্ঞ নেতাদের নিয়ে পাহাড়ে অভিযান চালিয়েছে৷ আইসল্যান্ডের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ টিংভেলির জাতীয় পার্কের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে৷ পথে পড়েছে গুলফস জলপ্রপাত আর বিশাল প্রাকৃতিক ফোয়ারা৷ হিমবাহের পথ মোটেই সহজ নয়৷ কয়েক কিলোমিটার পরই প্রথম সমস্যার মুখে পড়তে হয়৷ বরফের নীচে পানির স্রোত৷ বিশাল টায়ার ও ইঞ্জিন সত্ত্বেও গাড়ি প্রায়ই আটকে যায়৷ প্রথমে দ্রুত, তারপর ধীরে, তারপর আবার দ্রুত চালানোর চেষ্টা বড়ই কঠিন৷ তবে গোটা দলই সাহায্য করেছে৷
অভিযানের নেতা ইয়ন বালদুর টরবিয়র্ন্সসন বলেন, ‘‘আসলে বরফের স্তর খুবই পাতলা, বেশ কঠিনও৷ একবার চাকা বসে গেলে বেরোনো কঠিন৷''
দল এগিয়ে যেতে পেরেছে বটে, তবে খুবই ধীর গতিতে৷ সূর্য তাড়াতাড়ি ডুবে যায়৷ অন্ধকারে গাড়ি চালানো কঠিন৷ প্রত্যেকটি গাড়ি কখনো না কখনো আটকে পড়ে৷ যেমন বরফের নীচে পানির স্রোত৷ সবার শক্তি কাজে লাগিয়ে অভিযানের প্রথম দিন সফলভাবে শেষ হয়৷ পরদিন ভোরে আবার পথ চলার শুরু৷ অভিযানের প্রধান দিনের রুট স্থির করেন৷ টরবিয়র্ন্সসন বলেন, ‘‘অ্যাডভেঞ্চার মানে গতকালের অনুশীলন আজকের বাস্তব৷ বরফ কতটা, কত গভীর – তাতে কিছু এসে যায় না৷ আমরা ৫ থেকে ৮ মিটার বরফের উপর চলেছি৷ প্রশ্ন হলো, কী ধরনের বরফ সেটা৷''
বরফে ঢাকা এলাকার উপর দিয়ে সঠিক পথ খোঁজার ক্ষেত্রে অভিযানের নেতার অভিজ্ঞতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ ঘণ্টায় গড়ে ২ থেকে ৫ কিলোমিটার বেগে গোটা দল আইসল্যান্ডের দ্বিতীয় বৃহত্তম হিমবাহের উপর দিয়ে চলেছে৷ উচ্চতার সমস্যারও সম্মুখীন হতে হয় তাদের৷ লাংইয়োকুল হিমবাহ অতিক্রম করতে ১৪ ঘণ্টারও বেশি সময় লাগে৷ অভিযাত্রী ফ্লপ বলেন, ‘‘আমাদের মধ্যে কয়েক জনের বরফের উপর গাড়িতে চলার অভিজ্ঞতা রয়েছে৷ তবুও আমি নতুন কিছু শিখলাম৷'' আরেক জন বললেন, কঠিন পরিশ্রম সত্ত্বেও অসাধারণ অভিজ্ঞতা৷ উপকূল ধরে ফেরার পথ অনেক সহজ৷ তবে এখানকার প্রকৃতির রূপও খুবই সুন্দর৷