তুরস্ককে এখন সিরিয়া ও ইরাকে আইসিস বা আইএস-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে সামরিকভাবে সংশ্লিষ্ট হতে হবে – কুর্দদের সঙ্গে একযোগে৷ এভাবেই তুরস্ককে তার অস্থির বিদেশনীতির মূল্য চোকাতে হচ্ছে৷ এ নিয়েই সংবাদভাষ্য, লেখক বাহা গ্যুনগর৷
বিজ্ঞাপন
ভয় দেশের যৌথ সীমান্তের সিরীয় তরফে অবস্থিত রণাঙ্গণ থেকে রোজ যা খবর আসছে, তা তুরস্কের পক্ষে ক্রমেই আরো বেশি নাটকীয় হয়ে উঠছে৷ তুরস্কের সীমান্ত থেকে অদূরে অবস্থিত সিরীয় কুর্দদের শহর কোবানের উপর ইসলামিক স্টেট সন্ত্রাস গোষ্ঠীর অভিযান এ যাবৎ রোখা সম্ভব হয়নি৷ সিরিয়ার অপরাপর অঞ্চল এবং সেই সঙ্গে উত্তর ইরাক থেকেও আইসিস-এর উত্তরোত্তর সাফল্যের খবর পাওয়া যাচ্ছে৷
আজ বৃহস্পতিবার তুর্কি সংসদ সিদ্ধান্ত নেবে, সীমান্ত পেরিয়ে সিরিয়া তথা ইরাকের রাজ্যাঞ্চলে তুর্কি সেনাবাহিনীর অভিযান অনুমোদন করা হবে কিনা৷ আইসিস-এর বিরুদ্ধে সংগ্রামে সংশ্লিষ্ট বিদেশি সেনা গোষ্ঠী তুরস্কের রাজ্যাঞ্চল ব্যবহার করতে পারবে কিনা, সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে৷
শত্রু কে এবং লক্ষ্য কি?
দামেস্ক সরকারের প্রকাশ্য সম্মতি ছাড়া সিরিয়ার রাজ্যাঞ্চলে অগ্রসর হওয়াটা তুরস্ক ও মার্কিন নেতৃত্বাধীন মিত্রশক্তিদের পক্ষে সমস্যাকর হয়ে দাঁড়াতে পারে৷ আসাদ প্রশাসনের আইসিস-ভীতি কম নয়; কাজেই বাইরে থেকে যে কোনো রকমের সাহায্যের জন্যই আসাদ প্রশাসনের খুশি হওয়ার কথা৷ এছাড়া যৌথ শত্রুর আবির্ভাবের ফলে যদি আসাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমের কড়া মনোভাব অন্তত কিছুটা নরম হয়, তা-তেই বা ক্ষতি কি? কিন্তু তা সত্ত্বেও সিরিয়ার রাজ্যাঞ্চলে সামরিক অভিযান চালানোর কোনো অনুমতি আসাদ প্রশাসনের তরফ থেকে দেওয়া হয়নি৷
মর্জিমতো সিরিয়ায় ঢুকে আইসিস-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো তুরস্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা তাদের মিত্রদের পক্ষে খুব সমীচিন হবে না: দামেস্ক সে ধরনের অভিযানকে ‘‘যুদ্ধঘোষণা'' হিসেবে গণ্য করতে পারে – যার ফলশ্রুতি হবে অনিশ্চিত৷ অপরদিকে তুরস্ক কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের উত্তরোত্তর আচরণ একনায়ক আসাদ-এর সম্মতির উপর নির্ভরশীল করতে পারে না৷ এই জটিলতা থেকে মুক্তি পাবার একমাত্র পন্থা হলো জাতিসংঘের একটি প্রশস্ত সনদ – যার পিছনে বিশ্ব নিরাপত্তা পরিষদের দুই স্থায়ী সদস্য রাশিয়া ও চীনেরও সমর্থন থাকবে৷
স্বখাত সলিল
তুরস্ক আজ যে উভয়সংকটের সম্মুখীন, তার জন্য তুরস্ক নিজেই প্রধানত দায়ী৷ আসাদের শীঘ্র পতন ঘটবে, বলে তুরস্ক ধরে নিয়েছিল৷ তুরস্ক যাবতীয় আসাদ-বিরোধীদের নির্বিচারে সাহায্য করে সেই সঙ্গে ইসলামি মৌলবাদীদেরও হাত শক্ত করেছে৷ আইসিস সমর্থকদের বিভিন্ন গোষ্ঠী ও সন্ত্রাসের ‘সেল' তুরস্কেও দানা বেঁধে থাকতে পারে, এই সন্দেহ তুর্কি সমাজকে সচকিত ও আতঙ্কিত করে তুলেছে৷
ইরাকে জিহাদিবিরোধী যুদ্ধ
চরমপন্থি ইসলামি সংগঠন আইএস-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চলছে ইরাকে৷ সন্ত্রাসবাদী এ সংগঠনটির সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশেও তৎপরতা রয়েছে৷ দেখুন ইরাকে আইএস-বিরোধী যুদ্ধ সংশ্লিষ্ট কিছু ছবি৷
ছবি: Reuters
টিকরিট পুনরুদ্ধারের চেষ্টা
সুন্নিদের সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ইসলামিক স্টেট ইন ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া (আইসিস) উত্তর ও দক্ষিণ ইরাকের কিছু অংশ দখল করে নিয়েছে৷ বাগদাদ থেকে ১৪০ কিলোমিটার দূরের শহর টিকরিটও এখন তাদের দখলে৷ সে এলাকায় ইরাক সরকারের নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধারের জন্য আইসিস জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়ছে সেনাবাহিনী৷
ছবি: Reuters
মধ্যপ্রাচ্যে কর্তৃত্ব চায় আইসিস
আন্তর্জাতিক ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার সঙ্গে আইসিস-এর একসময় ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল৷ ২০০৬ থেকে ২০০৭-এর দিকে ইরাকে যখন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন যৌথবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ লড়াই চলছে তখনই আইসিস-এর জন্ম৷ সংগঠনটির লক্ষ্য সিরিয়া, ইরাক, লেবানন, ফিলিস্তিন এবং জর্ডান মিলিয়ে বেশ বড় একটা অঞ্চলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা৷ ইরাকে নুসরা ফ্রন্টসহ বেশ কিছু সংগঠন তাদের সহযোগী হিসেবে কাজ করছে৷
ছবি: picture-alliance/AP Photo
বিদ্রোহীদের পাশে যুক্তরাষ্ট্র
সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ আর ইরাকে নুরি আল মালিকির সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত বিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যপন্থি এবং মৌলবাদী সংগঠনের কর্মী রয়েছে৷ সিরিয়ায় ন্যাশনাল কোয়ালিশনের মতো কিছু মধ্যপন্থি সংগঠনকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র৷ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ওবামা বিদ্রোহীদের একাংশকে ৫০০ মিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তা দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখছেন৷
ছবি: Reuters
ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি জানিয়েছেন, কংগ্রেস বিদ্রোহীদের জন্য ৫০০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব অনুমোদন করলে তা সিরিয়া এবং ইরাকে দেয়া হবে৷ এই বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ, কেননা, ৫০০ মিলিয়ন ডলারের বড় একটা অংশ যে আইসিস-এর কাছে যাবেনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই৷
ছবি: Reuters
কুর্দিরা চায় স্বাধীন কুর্দিস্তান
যুক্তরাষ্ট্র চায় ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকি সুন্নি এবং কুর্দিদের অংশিদারিত্বের সরকার গঠন করুন৷ ইরাকের কিছু অংশে কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসন রয়েছে৷ কুর্দিরা ‘পেশমেরগা’, অর্থাৎ কুর্দিদের স্বাধিকার আন্দোলনের অংশ হিসেবে আইসিসের বিরুদ্ধে লড়ছে৷ কুর্দিদের মূল লক্ষ্য ইরাকে স্বাধীন কুর্দিস্তান প্রতিষ্ঠা করা৷
ছবি: Reuters
ইরানের ভূমিকা
ইরাকে শিয়া-সুন্নি সংঘাতের মধ্যে জড়াতে চায়না ইরান৷ কিন্তু শিয়া প্রধান দেশ ইরানের সরকার ইরাকের মালিকি সরকারকে সমর্থন দিচ্ছে বলে ধারণা করা হয়৷ নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইসিস-বিরোধী যুদ্ধে মালিকি সরকারকে ড্রোন এবং অন্যান্য সমর উপকরণ দিয়ে সহায়তা করছে ইরান সরকার৷
ছবি: Atta Kanare/AFP/Getty Images
এক হাজারেরও বেশি নিহত
সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সমর্থন দিচ্ছে সৌদি আরব৷ ইরাকের প্রধানমন্ত্রী নুরি আল মালিকি মনে করেন, আইসিসকেও মদদ দিচ্ছে সৌদি সরকার৷ ইরাকে চলমান সংঘাতে কমপক্ষে এক হাজার মানুষ নিহত হয়েছে৷ মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ জন্য ইরাক সরকার এবং আইসিস-এর কঠোর সমালোচনা করেছে৷
ছবি: Reuters
বাড়ছে শরণার্থী
আইসিসের হামলা শুরুর পর থেকে ইরাকের বিভিন্ন স্থান থেকে অন্তত ১২ লাখ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন৷ সিরিয়া সংকট শুরুর পর থেকে এ পর্যন্ত আড়াই লাখ সিরীয় স্বায়ত্তশাসিত কুর্দি রাজ্যগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে৷ এখন আইসিসের দখল করে নেয়া শহরগুলো থেকে পালিয়ে ইরাকিরাও আসছে৷ ছবিতে খাজাইর চেকপয়েন্ট অতিক্রম করে কুর্দিদের নিয়ন্ত্রিত শহর এরবিলের দিকে যেতে দেখা যাচ্ছে মসুল থেকে আসা ইরাকিদের৷
ছবি: Getty Images
স্বেচ্ছাসেবীরাও নেমেছে যুদ্ধে
প্রধানমন্ত্রী মালিকি জানিয়েছেন, রাশিয়া আর বেলারুশের কাছ থেকে পুরোনো যুদ্ধ বিমান কিনেছে ইরাক৷ আইসিসের বিরুদ্ধে সেগুলো ব্যবহার করা হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ বাড়ছে সমরাস্ত্র৷ বাড়ছে যোদ্ধা৷ স্বেচ্ছাসেবীরাও যোগ দিচ্ছেন আইসিস বিরোধী যুদ্ধে৷
ছবি: Reuters
9 ছবি1 | 9
আইসিস সন্ত্রাসীরা প্রথম ওসমানি সুলতানের পিতামহের সমাধিসৌধে ৩৬ জন তুর্কি গার্ড অফ হনারকে ঘিরে ফেলেছে, এই খবর যদি সত্যি হয়, তাহলে তুরস্ক কোনোমতেই নিষ্ক্রিয় থাকতে পারে না৷ সমাধিসৌধটি সিরিয়ার অভ্যন্তরে তুরস্কের একটি এক্সক্লেভ৷
সবে মিলে করি কাজ
সেই এক্সক্লেভে যা ঘটেছে, তার বিবরণ আজ তুর্কি সংসদে বিপুল বিতর্কের অবতারণা ঘটাবে, বলে ধরে নেওয়া যায়৷ কিন্তু সরকারের পরিকল্পনা সমর্থন করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প আছে কি? বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দল, ধর্মীয়-রক্ষণশীল একেপি দলের বিধায়করা মধ্যপ্রাচ্যে ন্যাটোর বহির্সীমান্তে সংঘটিত যুদ্ধে তুর্কি সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণ অনুমোদন করবেন বলেই ধরে নেওয়া যায়৷
তুরস্কের বর্তমান আশঙ্কা ও সমস্যাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে কুর্দদের প্রতি শান্তিপূর্ণ নীতির সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হবার বিপদ দেখা দিয়েছে – যা কিনা আংকারার অনিশ্চিত মধ্যপ্রাচ্য নীতির অপর একটি নেতিবাচক ফলশ্রুতি৷ তুরস্কের আনাতোলিয়া প্রদেশের পূর্বাঞ্চলে ও দক্ষিণ-পূর্বে কুর্দ ও তুর্কিদের মধ্যে নতুন উত্তেজনা ‘ইসলামিক স্টেট'-এর বিরুদ্ধে যৌথ সংগ্রামে প্রতিবন্ধক হয়ে দেখা দিতে পারে৷