জার্মান সংসদে আউশভিৎস স্মারক অনুষ্ঠানে জার্মান প্রেসিডেন্ট ইওয়াখিম গাউক এ কথা বলেছেন৷ ২৭শে জানুয়ারি, ১৯৪৫: সোভিয়েত সৈন্যরা কুখ্যাত নাৎসি বন্দিশিবির তথা মৃত্যুশিবির আউশভিৎস-বির্কেনাউকে মুক্ত করে৷
বিজ্ঞাপন
আউশভিৎস-এ প্রায় ১৩ লাখ মানুষকে বন্দি রাখা হয়েছিল৷ তাদের মধ্যে গ্যাস চেম্বারে, অনশনে এবং চরম দুর্বলতায় প্রাণ হারান ১১ লাখ মানুষ, যাদের অধিকাংশই ছিলেন ইহুদি, সেই সঙ্গে রোমা ও সিন্টিদের মতো সম্প্রদায়ের মানুষ এবং রাজনৈতিক বিরোধীরা৷
সে আমলে ইউরোপে যে ১ কোটি ১১ লাখ ইহুদির বাস ছিল, তাদের মধ্যে ৬০ লাখ প্রাণ হারান নাৎসিদের ইহুদি নিধনযজ্ঞে, বিশেষ করে এই ধরনের ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে'৷ সে হিসেবে আউশভিৎস নাৎসি বিভীষিকার প্রতীক৷ ৭০ বছর আগে সোভিয়েত রেড আর্মি এই মৃত্যুশিবিরকে মুক্ত করে৷
যুদ্ধপরবর্তী জার্মানিতে যারা জন্মেছে, সেই সব জার্মানদের উপর আউশভিৎস-এর মারণযজ্ঞের দোষারোপ করা চলে না, তবুও তাদের একটা দায়িত্ব থেকে যায়৷ আউশভিৎস থেকে যারা প্রাণে বেঁচেছেন, জার্মানির তরুণ প্রজন্মকে অতীতের সেই সব সাক্ষীর কথা শুনতে হবে, যাতে তারা নিজেরাই সেই ‘‘সাক্ষীদের সাক্ষী'' হয়ে আউশভিৎস-এর স্মৃতি ও শিক্ষাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে – এ কথা বলেছেন ফেডারাল সংসদ সভাপতি নর্বার্ট ল্যামার্ট মঙ্গলবারের স্মারক অনুষ্ঠানে৷
অথচ জার্মানির বাস্তবিক পরিস্থিতি – যথা ড্রেসডেনের পেগিডা আন্দোলন এবং অন্যত্র তার শাখা-প্রশাখায় বহিরাগত-বিদ্বেষের স্পষ্ট ছোঁয়া দেখা যাচ্ছে – যার বিরুদ্ধে অনেক বেশি সংখ্যক জার্মান রুখে দাঁড়িয়েছেন এবং সমাবেশ ও জনসভায় প্রতিবাদ জানাচ্ছেন৷ তা সত্ত্বেও, বিভীষিকাময় অতীতকে ভোলার একটা প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়েছে ব্যার্টেলসমান নিধির একটি সাম্প্রতিক জরিপে৷ ঐ জরিপে দেখা গেছে, ৮১ শতাংশ জার্মান ইহুদি নিপীড়নের কাহিনি নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চান না; এমনকি ৫৮ শতাংশ সে কাহিনি ভুলে যেতে চান৷
নাৎসি লুটের সেই সংগ্রহ
মিউনিখের এক ফ্ল্যাটে ইউরোপীয় শিল্পীদের আঁকা ১,৪০০ অমূল্য ছবির সন্ধান পাওয়ার পর গত বছর আলোচনায় আসেন কর্নেলিয়াস গুরলিট, যাঁর বাবা হিল্ডেব্রান্ড গুরলিট ছিলেন নাৎসি আমলের আর্ট ডিলার৷ গত মঙ্গলবার ৮১ বছর বয়সে মারা গেছেন তিনি৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa
জানালার নর-নারী
ড্রেসডেনের শিল্পী উইলহেল্ম লাখনিট (১৮৯৯-১৯৬২) জলরংয়ে ‘ম্যান অ্যান্ড উইমেন ইন দ্য উইনডো’ আঁকেন ১৯২৩ সালে৷ নাৎসি প্রোপাগান্ডা মন্ত্রী ইওসেফ গ্যোবেল্সের নির্দেশে অন্য অনেক ছবির সঙ্গে এ ছবিটিও ‘অধঃপতিত’ ঘোষণা করে সংগ্রহশালা থেকে সরিয়ে ফেলা হয়৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa
যুগল
‘যুগল’ শিরোনামে জলরংয়ের এই ছবিটি হান্স ক্রিস্টফ (১৯০১-১৯৯২) এঁকেছিলেন ১৯২৪ সালে৷ সে সময় তিনি খুব বেশি পরিচিতি না পেলেও এখন উইলহেল্ম লাখনিট, ওটো গ্রিবেল, ওটো ডিক্সের মতো শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারিত হয়৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa
সন্ত
ক্রিস্টফ ফল (১৮৯৭-১৯৩৯) সেই বিংশ শতকের গোড়ার দিকেই ভাস্কর্য আর ছবির জন্য খ্যাতি পান৷ কিন্তু নাৎসি সরকারের কোপে পড়ে তাঁর ক্যারিয়ারের সমাপ্তি ঘটে, কারণ তাঁদের বিচারে এসব শিল্পকর্ম ছিল অ-জার্মান৷ ‘মংক’ ছবিটি তিনি আঁকেন ১৯২১ সালে৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa (Ausschnitt)
ড্রেসডেন জ্বলছে
ব্যার্নহার্ড ক্রেচমারও (১৮৮৯-১৯৭২) ছিলেন ড্রেসডেনের শিল্পী৷ জলরংয়ে ‘ট্রাম’ ছবিটি তিনি কবে এঁকেছিলেন, তার সঠিক তারিখ জানা যায় না৷ তাঁর আঁকা বহু ছবি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ‘অধঃপতিত’ আখ্যা দিয়ে গ্যালারি থেকে সরিয়ে নেয়া হয়৷ ১৯৪৫ সালে ড্রেসডেনে ‘মিত্রবাহিনীর’ বোমা হামলায় তাঁর বহু শিল্পকর্ম ধ্বংস হয়ে যায়৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa
ভিন্নমত
ওটো গ্রিবেল (১৮৯৫-১৯৭২) জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির জন্য লিফলেট ও পোস্টার তৈরি করতেন৷ সামরিক বাহনীর কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তিনি সোচ্চার হয়েছেন ছবি এঁকেও৷ স্বাভাবিকভাবেই এসব কাজ নাৎসি নেতাদের পছন্দ হয়নি৷ সে সময় ওটো গ্রিবেলের আঁকা বহু ছবি ধ্বংস করে ফেলা হয়৷ তবে ‘চৌপায়ায় শিশু’ শিরোনামের এই ছবিটি কোনোভাবে রক্ষা পেয়ে যায় এবং বহু বছর পর এর সন্ধান মেলে কর্নেলিয়াস গুরলিটের গোপন সংগ্রহশালায়৷
ছবি: picture-alliance/AP(Ausschnitt)
সমালোচকের কণ্ঠরোধ
বাঁয়ের ছবিতে দেখা যাচ্ছে অগাস্ট রঁদার (১৮৪০-১৯১৭) একটি ড্রয়িং৷ ডানে ওটো ডিক্সের (১৮৯১-১৯৬৯) আঁকা ‘দ্য ফিমেল লায়ন ট্যামার’৷ ওটো ডিক্স ছিলেন নাৎসি আমলের একজন প্রতিবাদী কণ্ঠ, যিনি সেই সময়ের বাস্তবতার ছবি এঁকেছেন তুলির রূঢ় আঁচড়ে৷ ১৯৩৪ সালে ওটো ডিক্সের ছবি প্রদর্শনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়৷ বিভিন্ন জাদুঘর থেকে তুলে নেয়া হয় তাঁর আঁকা শতাধিক ছবি৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa (Ausschnitt)
ড্রেসডেনের প্রতিবাদ
ওটো গ্রিবেল ও ওটো ডিক্সের মতো ড্রেসডেনের শিল্পী কনরাড ফেলিক্সম্যুলারও ছিলেন নাৎসি কর্মকাণ্ডের একজন কড়া সমালোচক৷ এ কারণে তাঁকেও রাষ্ট্রীয় নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে হয়৷ ‘রিয়েলিস্ট’ ধারার এই শিল্পী ‘কাপল ইন দ্য ল্যান্ডস্কেপ’ ছবিটি আঁকেন ১৯২৪ সালে৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa (Ausschnitt)
‘ক্যামেরা অবসকিউরা’
ইটালির শিল্পী আন্তোনিও কানালেত্তো (১৬৯৭-১৭৬৮) চিত্রকলার ইতিহাসে বিখ্যাত তাঁর আঁকা ল্যান্ডস্কেপের জন্য৷ এ সব ছবি আঁকার ক্ষেত্রে তিনি ‘ক্যামেরা অবসকিউরা’ নামের একটি যন্ত্র ব্যবহার করতেন, যা আধুনিক ক্যামেরার পূর্বসূরি৷ তাঁর করা এই ছাঁপচিত্রটি পাওয়া গেছে কর্নেলিয়াস গুরলিটের সংগ্রহশালায়৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa
দেলাক্রোয়ার স্কেচ
ফ্রান্সে রোমান্টিক শিল্প আন্দোলনের অন্যতম প্রভাবশালী শিল্পী ইউজিন দেলাক্রোয়ার (১৭৯৮-১৮৬৩) ছাঁপচিত্রগুলো তাঁর জিবদ্দশাতেই দারুণভাবে আলোচিত হয়৷ ইতিহাস বা পুরাননির্ভর ছবি, স্টিল লাইফ ও পোর্ট্রেট – সবই তিনি করেছেন৷ কর্নেলিয়াস গুরলিটের ফ্ল্যাটে পাওয়া শিল্পকর্মের মধ্যে দেলাক্রোয়ার এই পেনসিল স্কেচটিও ছিল৷
ছবি: Staatsanwaltschaft Augsburg/dpa
9 ছবি1 | 9
ঠিক এই ভুলে যাওয়ার বিরুদ্ধেই আউশভিৎস স্মারক দিবস৷ সেই বিস্মৃতির বিরুদ্ধেই বারংবার মত প্রকাশ করেছেন বুন্ডেসটাগের বক্তারা – সেই সঙ্গে বহির্বিশ্বের নেতারা৷ জার্মান প্রেসিডেন্ট ইওয়াখিম গাউক সেই কারণেই তাঁর ভাষণে ঘোষণা করেছেন: ‘‘আউশভিৎসকে বাদ দিয়ে জার্মান সত্তা হয় না৷'' হলোকস্টের স্মৃতি জার্মানির সব নাগরিকের, এ দেশের ইতিহাসের অঙ্গ – বলেছেন গাউক৷
অপরদিকে খোদ আউশভিৎস-এ যে সব বিশ্বনেতাদের দেখা যাবে, তাদের মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুটিন থাকবেন না: রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ৷ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট পোরোশেঙ্কো উপস্থিত থাকছেন৷ উপস্থিত থাকছেন জার্মানি, অস্ট্রিয়া এবং ফ্রান্সের প্রেসিডেন্টবর্গ৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাঠাচ্ছে তাদের অর্থমন্ত্রী সহ একটি প্রতিনিধিদল৷ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, আউশভিৎস স্মারক অনুষ্ঠানের উপর ইউক্রেন সংকটের ছায়া পড়েছে৷
ঐ স্মারক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে আউশভিৎস-বির্কেনাউ রাষ্ট্রীয় সংগ্রহশালা এবং আন্তর্জাতিক আউশভিৎস পরিষদ৷ তারা এবার পোল্যান্ডের প্রেসিডেন্টকে দিয়ে বহির্বিশ্বের নেতৃবর্গকে ব্যক্তিগত আমন্ত্রণ পাঠায়নি, বরং তাদের দাতাদেশগুলিকে জিজ্ঞাসা করেছে, কারা স্মারক অনুষ্ঠানে আসবেন৷ কাজেই পোল্যান্ডের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, পুটিন আসতে চাইলে আসতেও পারতেন৷
হিটলারের নকল ডায়েরি প্রকাশের ৩০ বছর
১৯৮৩ সালের ২৫ এপ্রিল জার্মানির হামবুর্গে এক সংবাদ সম্মেলনে হিটলারের ডায়েরি পাওয়া যাওয়ার খবর দেয়া হয়৷ পরে যেটা নকল বলে প্রমাণিত হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
সংবাদ সম্মেলন ডেকে ডায়েরি প্রকাশ
১৯৮৩ সালের ২৫ এপ্রিল জার্মানির হামবুর্গে একটি সংবাদ সম্মেলন ডাকেন সাংবাদিক গের্ড হাইডেমান৷ সেখানে সারা বিশ্ব থেকে যাওয়া সাংবাদিকদের সামনে তিনি হিটলারের হাতে লেখা একটি ডায়েরি উপস্থাপন করেন৷ পরবর্তীতে যেটা নকল বলে প্রমাণিত হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
‘বড় গল্পের সন্ধান’
গের্ড হাইডেমান ছিলেন একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক৷ যখন তাঁর কাছে নকল ডায়েরিটা নিয়ে যাওয়া হয় তখন তিনি সেটা দিয়ে বড় ব্যবসা করার পরিকল্পনা করেন৷
ছবি: ullstein bild
সংবাদ সম্মেলনে বিশেষজ্ঞের উপস্থিতি
হিটলারের ডায়েরিকে আসল প্রমাণ করতে হামবুর্গের সংবাদ সম্মেলনে ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ও হিটলার বিশেষজ্ঞ হিউ ট্রেভর-রোপার ও মার্কিন ইতিহাসবিদ গেরহার্ড লুডভিগ ভাইনবের্গকে হাজির করা হয়েছিল৷
ছবি: picture-alliance/dpa
নকল প্রমাণিত
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থাপন করার মাত্র ১১ দিনের মাথায় সেটা নকল বলে খবর প্রকাশ করে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম৷ সরকারের দুটো মন্ত্রণালয় প্রমাণ করে দেখায় যে, ঐ ডায়েরি বাঁধাই করতে যে উপাদান ব্যবহার করা হয়েছে সেটা তৈরিই হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর৷
ছবি: picture alliance/AP Photo
যিনি নকল করেছেন
ইনি হলেন কনরাড কুয়াও৷ তাঁকে দিয়েই হিটলারের হাতের লেখা নকল করে ডায়েরিটা বানানো হয়েছিল৷ এ জন্য কুয়াওকে মোটা অংকের টাকা দেয়া হয়৷
ছবি: AP
কারাভোগ
ধরা পড়ার পর বিচার প্রক্রিয়া শেষে হাইডেমানকে চার বছর আট মাস আর কুয়াওকে চার বছর ছয় মাসের কারাদণ্ড দেয়া হয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মঞ্চনাটক
এই ঘটনা নিয়ে ১৯৯২ সালে জার্মানিতে একটি হাস্যরসাত্মক মঞ্চনাটক হয়েছে৷ ছবিতে তার একটি দৃশ্য দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: imago stock&people
‘জনপ্রিয়তা’ অর্জন
গলায় ক্যান্সারের কারণে কুয়াওকে মাত্র তিন বছর জেল খাটতে হয়েছে৷ হিটলারের ডায়েরি নকলের ঘটনায় পাওয়া ‘জনপ্রিয়তা’-কে কাজে লাগিয়ে পরবর্তীতে তিনি একটি দোকান খোলেন যেখানে তিনি ‘আসল কুয়াও-নকল’ ছবি বিক্রি করতেন৷ ২০০০ সালে তিনি মারা যান৷
ছবি: picture-alliance/dpa
হাইডেমানের করুণ দশা
নকল ডায়েরি ঘটনার কারণে হাইডেমানের সাংবাদিক জীবন শেষ হয়ে যায়৷ বর্তমানে ৮১ বছর বয়সি হাইডেমান হামবুর্গে অনেকটা দরিদ্র জীবনযাপন করছেন৷