আওয়ামী লীগে হত্যা-খুন বাড়ছে
১৭ অক্টোবর ২০২৩সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ব্যক্তিগত রেষারেষি এসবের প্রধান কারণ।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, নির্বাচনের আগে এই ধরনের খুন আরো বাড়তে পারে। কারণ দলের ভিতরে প্রভাব টিকিয়ে রাখা এবং নানা স্বার্থের দ্বন্দ্ব এখন সবচেয়ে বেশি মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় আছে বলে আওয়ামী লীগের ভেতরে স্বার্থ নিয়ে নানা উপদল ও গ্রুপ সৃষ্টি হয়েছে। এর বাইরে ব্যক্তিগত স্বার্থ নিয়েও দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। সামনের নির্বাচনে একটি আসনে অনেকেই প্রার্থী হতে চাইবেন। প্রার্থীদেরও নানা গ্রুপ আছে। তাদের মধ্যেও সংঘাত হতে পারে।
আর আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগে দলের তৃণমূলে প্রতিযোগিতা বাড়বে। তবে তা যাতে নোংরামির পর্যায়ে না যায় সে ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে।
সোমবার যশোরের মনিরামপুরে উদয় শংকর বিশ্বাস নামে এক যুবলীগ নেতাকে তার বাড়ির সামনে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। উপজেলার পাঁচাকড়ি গ্রামের বাসিন্দা উদয় শংকর বিশ্বাস ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ও নেহালপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের সংস্কৃতি বিষয়ের প্রভাষক ছিলেন। এ ছাড়া তিনি পাঁচাকড়ি টেকেরঘাট মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের পরিচালনা পরিষদের সভাপতি এবং পাঁচাকড়ি গ্রামের বৈকালী সর্বজনীন পূজামণ্ডপের সভাপতি ছিলেন।
একই দিন ঝিনাইদহের শৈলকুপায় আওয়ামী লীগের দুই পক্ষের দ্বন্দ্বের জেরে দলের নেতা এক ইউপি সদস্যকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। শৈলকুপা উপজেলার মিনগ্রামে নিহত হাবিবুর রহমান রিপন আবাইপুর ইউনিয়ন পরিষদের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। তার বাবা আবুল কালাম আজাদ আবাইপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। এ ঘটনায় আমিনুর রহমান ও রাসেল নামের দুজন আহত হয়েছেন। হত্যকাণ্ডের জেরে উভয় পক্ষের কয়েকটি বাড়িঘর ভাঙচুর করা হয়েছে।
আর একই দিনে রাজবাড়ীতে শ্রমিক লীগ নেতা মোল্লা আজিজ মহাজনকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তিনি ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সহসভাপতি ছিলেন। ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে জানা গেছে।
হত্যার শিকার হচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা:
গত ৩ সেপ্টেম্বর নাটোরের লালপুরে কদিমচিলাম ইউনিয়নের ৫ নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওসমান গণি প্রামাণিককে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। একজন ইউপি সদস্যের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গত ২ সেপ্টেম্বর বগুড়ার শাহজাহানপুরে তালুকদার পারভেজ নামে এক আওয়ামী লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি বগুড়া সদর বিএম কলেজের প্রভাষক এবং আশেকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ছিলেন।
১৮ জুন বাগেরহাট-পিরোজপুর মহাসড়কের বৈটপুর এলাকায় গুলি করে হত্যা করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা আনারুল শেখকে। তিনি বাগেরহাট ৮ নাম্বার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ছিলেন।
গত ৩০ মে নড়াইলের লোহাগড়ায় নিজাম শেখ নামে একজন আওয়ামী লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তিনি লোহাগড়ার কেটাকোল ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন।
গত ২৪ মার্চ খুলনার দিঘলিয়ায় আওয়ামী লীগ নেতা আনসার আলিকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার বিরুদ্ধেও হত্যাসহ সাতটি মামলা আছে। সে উপজেলার বারাকপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ছিলো।
গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সিরাজগঞ্জের তাড়াশে সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল কুদ্দুসকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
এরকম আরো বেশ কয়েকটি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে গত কয়েক মাসে।
হত্যাকাণ্ডের কারণ কী?
হত্যাকাণ্ডগুলো মূলত ঘটেছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল, পদ নিয়ে দ্বন্দ্ব, ব্যক্তিগত শত্রুতা ও রেষারেষির কারণে। তবে দলীয় রাজনীতির করণে সৃষ্ট নানা ধরনের স্বার্থের দ্বন্দ্বই প্রধান।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবে দেখা যায় চলতি বছরে আগস্ট পর্যন্ত আট মাসে সারাদেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় ১৮ জন নিহত হয়েছেন। এরমধ্যে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে নিহত হয়েছেন আট জন। যুবলীগ ও ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বে দুই জন। ছাত্রলীগের সঙ্গে ছাত্রলীগের দ্বন্দ্বে নিহত হয়েছেন একজন। মোট ১১ জন। এর সঙ্গে সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত হিসাব করলে এই সংখ্যা কমপক্ষে ১৭ জন। ২০২২ সালে আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের মধ্যে সংঘাতে ১৫ জন নিহত হয়েছেন।
বিশ্লেষকেরা যা বলছেন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক মনে করেন, "যখন যারা ক্ষমতায় থাকেন তখন তাদের জন্য নানা সুযোগ সুবিধার পরিস্থিতি তৈরি হয়। এগুলো বণ্টন ও ভোগের ব্যাপারে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। তাই দলের ভিতরে আধিপত্য ধরে রাখার বা অর্জনের একটি প্রচেষ্টা থাকে। সেটা পেশি শক্তি ব্যবহার করেও হয়। এখন যে হত্যাকাণ্ডের কথা আপনি বললেন সেগুলো অধিকাংশই তার ফল।”
তার মতে,"সামনে নির্বাচন তাই এটা বেড়েছে এবং আরো বাড়বে। কারণ দলের ভিতরে যারা দীর্ঘদিন নানা পদ ধরে আছেন বা দখলে আছেন তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীরা চাইবে এই সময়ে তাদের অবস্থানও সংহত করতে। ফলে সংঘাত, হত্যা বাড়তে পারে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন ও অপরাধ বিজ্ঞানের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন মনে করেন,"দলে অনেকে ভিড়েছেন যারা দলের আদর্শকে ধারণ করেন না। স্বার্থের জন্য তারা আওয়ামী লীগ হয়েছেন। আবার নানা দল ও উপদল আছে। আছে অভ্যন্তরীণ কোন্দল। সে কারণে হত্যাকাণ্ড হতে পারে। আবার রাজনৈতিক কারণের বাইরেও হতে পারে। ব্যক্তিগত শত্রুতাও কারণ হতে পারে। তদন্ত করলে প্রকৃত কারণ বোঝা যাবে। তবে নির্বাচনের আগে দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত বাড়ে।”
সতর্ক করা হয়েছে আওয়ামী লীগের তৃণমূলকে:
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বলেন," যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে তার বেশির ভাগই ব্যক্তি পর্যায়ের দ্বন্দ্বের কারণে। ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে হয়েছে। দলের মধ্যে গ্রুপিং বা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তেমন নয়। তারপরও আমরা দল থেকে ঘটনাগুলো তদন্ত করে দেখছি। নির্বাচনের আগে দলের মধ্যে প্রতিযোগিতা বাড়বে। অনেকেই মনোনয়ন চাইবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে এই প্রতিযোগিতা যাতে নোংরামিতে রূপ না নেয় সেজন্য আমরা সতর্ক আছি। দলীয় নেতা-কর্মীদের সতর্ক করা হয়েছে।”