নরেন্দ্র মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এখন নয়াদিল্লিতে আছেন। তৃতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়ার পর মোদীর সঙ্গে শেখ হাসিনার বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।
বিজ্ঞাপন
শেখ হাসিনার সঙ্গে আরো কয়েকজন সরকারও রাষ্ট্রপ্রধানেরও নয়াদিল্লিতে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক হতে পারে সেখানে। তারাও নরেন্দ্র মোদীর শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে নয়াদিল্লিতে আছেন।
শেখ হাসিনা শনিবারই নয়াদিল্লি গিয়েছে। ফিরে আসবেন সোমবার। এর আগে গত বুধবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী টেলিফোনে কথোপকথনের সময় তার সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানান। শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতে গেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। তারাও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে থাকবেন বলে জানা গিয়েছে।
পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন দুই দিন আগে ঢাকায় সাংবাদিকদের জানান,‘‘সোমবার শেখ হাসিনা-মোদীর বৈঠকে দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন গুরুত্ব পাবে।”
চলতি মাসেই শেখ হাসিনা আবার ভারত সফরে যাবেন। এটা আগেই ঠিক করা ছিলো। তারপর জুলাইয়ে তার চীন সফরের কথা আছে। পররাষ্ট্র সচিব জানান," ওই সফরের ব্যাপারে আমরা আলাদাভাবে কাজ করছি।”
'মমতা-মোদীর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তিস্তা ইস্যু জটিল হবে'
তবে সেই সফরের আগে নরেন্দ্র মোদীর শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠনে শেখ হাসিনার অংশ নেয়া এবং মোদীর সঙ্গে আলাদা বৈঠকের আলাদা গুরুত্ব আছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাদের কথায়, এটা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মোদী সরকারে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কেরই ইঙ্গিত। সেটা বাংলাদেশের নির্বাচনের আগেও দেখা গিয়েছে। সামনেও দেখা যাবে।
তবে তারা মনে করেন, ‘‘এর ফলে বাংলাদেশ কতটা লাভবান হবে বা বিভিন্ন অমীমাংসিত ইস্যু সমধানে কতটা কাজে আসবে সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নই।”
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘‘ভারতে সরকার পরিবর্তন হলে সাধারণত তাদের পররাষ্ট্র নীতিতে তেমন পরিবর্তন হয়না। আর ভারতে তো ওই অর্থে সরকার পরিবর্তন হয়নি। মোদীই আবার ক্ষমতায়। পররাষ্ট্র নীতির ব্যাপারে ভারতে একটা সাধারণ কনসেনসাস আছে। আর বাংলাদেশের ব্যাপারে সেটা আরো নির্ধারিত। দলের পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশ নীতিতে পরিবর্তন আসেনা। মানুষের প্রত্যাশা বা চাহিদার ভিত্তিতে হয়তো কোনো জিনিস হাইলাইটেড হতে পারে।”
তিস্তার পানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে মোদীর রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরো জোরদার হয়েছে। ফলে তিস্তা ইস্যুটা হয়তো আরো জটিল হবে। কারণ মমতার সম্মতি ছাড়া তো আর তিস্তা চুক্তি হবেনা।”
বাংলাদেশে কোনো দলের প্রতি মোদী সরকারের বিশেষ আগ্রহ আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘হ্যাঁ, এখন যে সরকার বাংলাদেশে আছে তারা তো ভারতের বিভিন্ন কনসার্ন অ্যাড্রেস করেছে। সেটা কংগ্রেস বলেন আর বিজেপি বলেন সবারই বাংলাদেশের এখনকার যে সরকার তাদের প্রতি ঝোঁক আছে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘ভারতে জোট সরকার হলেও মোদীর ক্ষমতার হেরফের হবে বলে মনে হয়না। এর আগেও তো এনডিএ জোট ছিলো। হয়তো অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তাদের মধ্যে কোনো কোনো ব্যাপারে মতানৈক্য হবে। কিন্তু বাংলাদেশের ব্যাপারে আগের অবস্থানই বহাল থাকবে।”
'দুই দেশের সম্পর্ক যেরকম আছে, সেরকমই থাকবে'
আর সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘‘আসলে দুই দেশের কোনো দেশেই সরকার পরিবর্তন হয়নি। ওখানে হয়তো জোট থেকে কয়েকজন মন্ত্রী হবেন। তাতে তো আর বিরাট কোনো পরিবর্তন হয়ে যাবেনা। দুই দেশের সম্পর্ক যেরকম আছে সেরকমই থাকবে।''
তিনি বলেন, ‘‘২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন ভারতে ক্ষমতায় ছিলো কংগ্রেস। আওয়ামী লীগের এক টার্ম তো ভারতে কংগ্রেসই ক্ষমতায় ছিলো। ২০১৪ সালে মোদী ক্ষমতায় আসলো। তখন তো অনেকে ভেবেছিলো মোদী ক্ষমতায় এসেছে আওয়ামী লীগের অনেক অসুবিধা হবে। কোনো অসুবিধা তো হয়নি।''
তার কথায়, ‘‘ভারতের রাজনীতি ভারতের স্বার্থ দেখে। মোদী অথবা মনমোহন সিং যেই ছিলো তারা ভারতের স্বার্থ দেখেছেন। দেখা গেছে যে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে তাদের সুবিধা। তাদের সম্পর্ক অনেক পুরনো এবং আরো ভালো হবে। এটা তো পরিবর্তন হওয়ার কোনো কারণ নাই।”
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘‘তিস্তার পানি , সীমান্ত হত্যাসহ আরো অনেক ইস্যু নিয়ে আমরা কথা বলছি। কিন্তু কোনো সমাধান কি হয়েছে? সামনে কতটা হবে আমি সন্দিহান। কারণ এটা আমাদের বার্গেইনিং ক্যাপাসিটির ওপর নির্ভর করে। আমরা কি সেই অবস্থানের পরিবর্তন ঘটাতে পারব?”
ভারত বাংলাদেশ যত চুক্তি
সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-বাংলাদেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক পেয়েছে অন্য এক মাত্রা৷ দুই দেশের সরকারের মধ্যে বেড়েছে পারস্পরিক যোগাযোগ, হয়েছে নানা চুক্তি, আর একে অপরকে দিয়েছে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশের’ মর্যাদা৷
ছবি: AFP/P. Singh
১০০ কোটি ডলার ঋণ ও ১৪ প্রকল্প
২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার একবছর পর ২০১০ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথম ভারত সফরে যান৷ সেসময় ১০০ কোটি ডলারের এলওসি বা ঋণরেখা অনুমোদন করে ভারত৷ এই অর্থে জনপরিবহন, সড়ক, রেলপথ সেতু আর অভ্যন্তরীন নৌপথের ১৪ টি প্রকল্প বাস্তবায়নের চুক্তি হয়৷
ছবি: Getty Images/G. Crouch
বন্দী বিনিময়
২০১০ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে দুই দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি হয়৷ ২০১১ সালের ১৩ই জানুয়ারি তা কার্যকর হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী কোনো দেশের নাগরিক অন্য দেশে সাজাপ্রাপ্ত হলে তাকে অনুরোধক্রমে ফেরত পাঠাতে পারবে৷ তবে এর আগেই অনুপ চেটিয়াসহ ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদি নেতাদের গ্রেপ্তার করে দেশটিতে পাঠানো হয় বলে গণমাধ্যমে খবর বেরোয়৷
ছবি: Getty Images/AFP/J. Barreto
ছিটমহল বিনিময়
২০১৫ সালের জুন মাসে ভারত-বাংলাদেশের স্থল সীমান্ত চুক্তি অনুমোদন হয়৷ যার মাধ্যমে ২০১৫ সালের জুলাইতে দুই দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ছিটমহল বিনিময় হয়৷ ভারতের ১১১টি ছিটমহল যুক্ত হয় বাংলাদেশের সাথে৷ একইভাবে ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলও হয়ে যায় ভারতের অংশ৷
ছবি: AFP/Getty Images
নদীর পানি বন্টন
বাংলাদেশের ভারতের অভিন্ন নদীর সংখ্যা ৫৪ টি৷ এর মধ্যে শুধু গঙ্গা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে চুক্তি আছে৷ যদিও পানি বন্টনের ক্ষেত্রে এই চুক্তি ভারত মানছে না বলে অভিযোগ আছে৷ অন্যদিকে পাঁচ দশক ধরে তিস্তা চুক্তির চেষ্টা চললেও তা সম্ভব হচ্ছে না দেশটির উদাসীনতার কারণে৷ যার ফলে এখন একতরফাভাবে নদীটির পানি প্রত্যাহার করে নিচ্ছে ভারত৷
ছবি: DW/A. Chatterjee
ভারসাম্যহীন বাণিজ্য
১৯৭২ সালে প্রথম বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষর হয়৷ ২০১৫ সালে স্বাক্ষর হয় এ বিষয়ে নতুন চুক্তি৷ এর আওতায় দুই দেশের মধ্যে সীমান্ত হাটসহ আরো কিছু বাণিজ্য সম্পর্কিত চুক্তি হয়েছে৷ ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের আকার ছিল ৯১৪ কোটি ডলার৷ যার সিংগভাগই ভারতের অনুকূলে৷
ছবি: Getty Images/AFP/D. Dutta
উন্নয়ন সহযোগিতার কাঠামো
২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফরকালে একটি উন্নয়ন সহযোগিতাবিষয়ক কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়৷ যার মধ্যে আছে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পানি সম্পদ; বিদ্যুৎ; শিক্ষা, সাংস্কৃতিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ইত্যাদি৷
ছবি: Getty Images/AFP/M.U. Zaman
দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ বৃদ্ধি
এই চুক্তি সম্পর্কে ভারতীয় দূতাবাসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘‘দ্বিপক্ষীয় বিনিয়োগ প্রবাহ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এক দেশ অন্য দেশের ভূখণ্ড থেকে বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও রক্ষার লক্ষ্যে এ চুক্তি হয়েছে৷ ভারত ও বাংলাদেশ একে অপরকে ‘সবচেয়ে পছন্দের দেশ’-এর মর্যাদা দিয়েছে৷’’
ছবি: picture-alliance/AP Photo/M. Swarup
বাংলাদেশ ভারতের পণ্য পরিবহন
দুই দেশের মধ্যে হওয়া বাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী এক দেশ আরেক দেশের জল, স্থল ও রেলপথ ব্যবহার করে তৃতীয় দেশে পণ্য ট্রানজিটের সুবিধা নিতে পারে৷ ২০১৬ সালে মাশুলের বিনিময়ে ভারতকে আশুগঞ্জ নৌ বন্দর দিয়ে বহুমাত্রিক ট্রানজিট সুবিধা দেয় বাংলাদেশ৷ সড়কপথে ট্রানজিট দিতে ২০১৫ সালে আখাউড়া অগরতলা সীমান্ত দিয়ে পরীক্ষামূলক চালান পাঠানো হয়৷ যা পরবর্তীতে নিয়মিত হয়নি৷
ছবি: DW/M. Mamun
ভারতের রেল যাবে বাংলাদেশ হয়ে
আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে কোলকাতা থেকে ছেড়ে আসা ট্রেন বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে শিলিগুড়ি যাবে৷ ২০১১ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এ বিষয়ক একটি চুক্তি হয়৷ চুক্তি অনুযায়ী এজন্য দুই দেশকে তাদের অংশের রেলপথ নির্মাণ করতে হবে৷ বাংলাদেশ অংশের সাত কিলোমিটার রেলপথ আগামী বছরে জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা৷
ছবি: DW/P. Mani
সাবরুমের মানুষে জন্য ফেনীর পানি
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে সাতটি সমঝোতা সই ও চুক্তি হয়েছে৷ একটি সমঝোতার আওতায় ফেনী নদীর ১ দশমিক ৮২ কিউসেক পানি প্রত্যাহার করতে পারবে ভারত৷ ওই পানি তারা ত্রিপুরার সাবরুম শহরে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্পে ব্যবহার করবে৷
ছবি: AFP/P. Singh
বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহন
বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দর ব্যবহার করে ভারত আটটি রুটে তার উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোদে পণ্য আনা নেয়া করতে পারবে৷ এজন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিওর বা পদ্ধতি কী হবে, তা নির্ধারণে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক সফরে৷
ছবি: DW/U. Danisman
চুক্তি থাকলেও হত্যা থেমে নেই
সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনতে ২০১১ সালে বিজিবি-বিএসএফ একটি চুক্তি করে৷ নেয়া হয় সীমান্ত পারাপারে অস্ত্র ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত৷ তবে সীমান্তে দেশটির আচরণে তার প্রতিফলন নেই৷ গত ১০ বছরে ২৯৪ বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিএসএফ৷