1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

মিডিয়ায় নেই লোক সংগীত!

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
৩ অক্টোবর ২০১৭

বাংলা গানের শক্তিশালী এবং ঐতিহ্যবাহী ধারা লোক সংগীত৷ সাধারণভাবে মনে হতে পারে লোক সংগীতের ধারা ম্রিয়মান হয়ে যাচ্ছে৷ কিন্তু গবেষকরা তা বলছেন না৷ তাদের কথা লোক সংগীত এখনো দাপুটে তবে প্রচলিত মিডিয়ায় এর উপস্থিতি কম৷

ছবি: DW/Mustafiz Mamun

লালনের গান যা বাউল গান নামেই পরিচিত৷ এই বাউল গান লোক সংগীতের একটি শক্তিশালী মরমী ধারা৷ আর  বাউল গানের কদর এখন বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বের নানা দেশে৷  বাউল গানের জনক লালন সাই বিশ্বে পরিচিত একজক আধ্যাত্মিক সাধক হিসেবে৷

এই লালনের গানের সংকলন প্রকাশ করেছে নিউইয়র্কের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস৷  সংকলনের নাম ‘সিটি অব মিরর, সংস অব লালন সাই', বাংলায় নাম আরশী নগর৷ মার্কিন গবেষক ড. ক্যারোল সলোমন ৩০ বছর ধরে লালনের গান নিয়ে গবেষণা করেছেন৷ ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির বাংলা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ছিলেন৷ তিনি পেনসিলভেনিয়া এবং শিকাগো ইউনিভার্সিটিরও প্রভাষক ছিলেন৷ 

Saimon - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

২০০৯ সালের মার্চ মাসে একটি সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যান৷ কিন্তু তাঁর স্বপ্ন থেমে থাকেনি৷ তাঁর অনুবাদ করা লালনের গানের সংকলন বের হয়েছে তার মৃত্যুর পর ২০১৭ সালে৷ আর তা সম্পাদনা করেছেন বাংলাদেশেরই আরেক গবেষক বাংলা একাডেমির ফোকলোর জাদুঘর ও মহাফেজখানা বিভাগের সহ পরিচালক ড. সাইমন জাকারিয়া৷

তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘১৯৭৯ সাল থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত একটানা লালনের গান বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করেন ক্যারল৷ ফকির সাধুদের সঙ্গে মিশেছেন তিনি৷ এসব গান নিজ হাতে বাংলায় লিখেছিলেন৷ লিখেছেন শব্দার্থ, টিকা, ভাবার্থ৷ এরপর নিজে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন৷ তাঁর মৃত্যুর পর ২০১২ সালে আমি নিউ ইয়র্কে যাই তাঁর ওপর বক্তৃতা করতে৷ সেখানেই তাঁর পরিবার আমাকে সংকলনটি সম্পাদনার দায়িত্ব দে৷''

সাইমন জাকারিয়া বলেন, ‘‘গত ২৬ বছর ধরে আমি বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘুরছি৷ এখনো সপ্তাহে তিন দিন আমি গ্রামেই থাকি৷ আগের মতই এখনো বাংলাদেশে লোক সংগীতের চর্চা বেগবান৷ কিন্তু এগুলোকে আমাদের মিডিয়া আমাদের প্রচার মাধ্যম তুলে ধরছে না৷ এটাই সমস্যা৷''

লোক সংগীত বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং মাটির সংগীত  গ্রাম বাংলার বাংলার মানুষের জীবন, জীবনের কথা, সুখ, দুঃখ, জীবনবোধ, ফসল, পার্বনসহ জীবনের নানা  কথা ফুটে ওঠে এই সংগীতে৷ আর সহজিয়া বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার হয় এই সংগীতে, যেমন একতারা, দোতারা৷ তবে কেনো বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার না করেও এই গান আবকর্ষণীয় মাঝির কন্ঠে ভাটিয়ালী কোনো বাদ্য যন্ত্র ছাড়াই প্রাণের সুর ছড়ায়৷ 

বাংলাদেশের লোক সংগীতের মধ্যে আছে বাউল, গম্ভীরা, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, কবিগান, কীর্তন, গাজন, ভাদুগান, ঝুমুর গান, ঘেঁটু গান, সারি গান, বারোমাসি, মেয়েলি গীত, চোকচুন্দ্রী, ধামগান, ক্ষণগান, চোরচুন্নি, জারি , সারি প্রভৃতি৷ এইসব গান অঞ্চলভিত্তিক৷ আর প্রত্যেক গানের পেছনে আছে অনেক গল্প , অনেক লোক ইতিহাস৷

সাইমন জাকারিয়া বলেন, ‘‘১৯৬০ সাল থেকে বাংলা একাডেমি নানা নামে লোক সংগীত এবং লোকসাহিত্যের শতাধিক সংকলন প্রকাশ করেছে৷ আর এসব সংকলনে বাংলাদেশের সব অঞ্চলের লোক সংগীত স্থান পেয়েছে৷ শিল্পকলা একাডেমি সম্প্রতি লোক সংগীত সংগ্রহের প্রকল্প নিয়েছে৷ ইউনেস্কো ২০০৮  থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত একটি প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে লোক সংগীত সংগ্রহ করে দু'টি সংকলন বের করেছে৷ একটি বাউল গানের বই একটি স্বরলিপির বই৷''

বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে ফোকলোর বিভাগ৷ সেখানে এই লোক সংগীত এবং লোক সাহিত্যের ওপর গবেষণায় দেয়া হয় উচ্চতর ডিগ্রি৷ লোক সংগীতের ওপর আলাদা গবেষণা ইন্সটিটিউ আছে৷ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফোকলোর বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল  হাসান চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন,‘‘লোক সংগীত নিঃসন্দেহে মানুষ এখনো শুনছে৷ এটা কোনঠাসা হয়ে গেছে সেটা আমি বলবো না৷ কিন্তু এখন কথা হলো কোথায় শুনছে? আর এই লোক সংগীতের শিল্পীও দুই ধরণের- সহজাত শিল্পী, যারা গ্রামে গঞ্জে ছড়িয়ে আছে৷ নৌকার মাঝি ভাটিয়ালি গায়, কেউ গায় সহজাত গম্ভীরা৷ আর কেউ আছেন পেশাদার শিল্পী৷  তাঁরা আসরে মঞ্চে বা কোনো অনুষ্ঠানে গান করেন, কেউ বা টিভি রেডিওতে৷ তবে মিডিয়ায় যতটা লোক সংগীতের জায়গা হওয়া দরকার ছিল তা হয়নি৷''

Dr Abul Hasan Chowdhy - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

লোক সংগীতের চর্চার জায়গাও বিস্তৃত হয়েছে৷ নানা আয়োজন ছাড়াও জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ে লোক সংগীতের প্রতিযোগিতা হয়৷ দেশে হাজারো লোক সংগীত শিল্পী আছে৷ কিন্তু সেই বিবেচনায় সবাই প্রতিষ্ঠা পায় না বা লোক সংগীত গেয়ে জীবিকা নির্বাহ খুব অল্প সংখ্যক শিল্পীর পক্ষেই সম্ভব৷

ড. আবুল  হাসান চৌধুরী  বলেন, ‘‘কুষ্টিয়ার শফি মন্ডল বিদেশে গিয়েও বাউল গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পান৷ পূর্ণ দাস বাউল সারা বিশ্বে পরিচিত৷ কিন্তু এ রকমতো সবার ক্ষেত্রে ঘটবে না৷ নেত্রকোনার একজন শিল্পী হয়তো এলাকায় জনপ্রিয়৷ কিন্তু সে কোনো টেলিভিশন মিডিয়ায় গান গাওয়ার সুযোগ পায়নি৷ পেলে হয়তো তার গানের খ্যাতি আরো ছড়িয়ে পড়তো৷'' 

তিনি বলেন, ‘‘লোক সংগীতের অনেক সংকলণ হয়েছে৷ কিন্তু এখনো অনেক লোক সংগীত দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে আছে যেগুলো সংগ্রহ করা প্রয়োজন৷ লোক সংগীত নিয়ে গবেষণা হচ্ছে, তবে আরো গবেষণা প্রয়োজন৷ লোক সংগীতের স্রষ্টারা প্রধানত স্বশিক্ষিত ফলে অনেক লোক সংগীত কাগজে লেখা নাই, মানুষের মুখে মুখে আছে৷ কিন্তু শিক্ষিত মানুষ লিখিত আকারে গান পেতে চায়৷''

বাংলাদেশের লোক সংগীতের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ধারা হিসেবে বাউল গানকেই বিবেচনা করে হয়৷ লালন সাই'র গান গভীর জীবন দর্শন এবং আধ্যাত্মিকতার মোড়কে মানুষকে নাড়া দেয়৷ বাউলগানের মূল বিষয়বস্তু প্রকৃতি৷  আধ্যাত্মিকতা, প্রেম, দর্শন, দেহতত্ত্ব ইত্যাদির সংমিশ্রণে সৃষ্ট বাউল গান৷ এই গানে বৈষ্ণব ও সুফি উভয় সম্প্রদায়ের প্রভাবই আছে৷ বাউলরা মুখে মুখে গান বাঁধেন  আর একতারা বাজিয়ে তা পরিবেশন করেন৷ পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম ও নদীয়ায় বাউল গানের চর্চা আছে৷ বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার লালন সাই'র বাউল গান লালন গীতি নামেও পরিচিত৷ দেশ বিদেশ থেকে বহু মানুষ কেবল লালনের গানের টানে কুষ্টিয়ায় ছুটে যান৷

Baul Moslem - MP3-Stereo

This browser does not support the audio element.

বাংলাদেশে এই বাউলরা নানা সময়ে নির্যাতনেরও শিকার হয়েছেন এবং হচ্ছেন৷ কারণ বাউলরা গানকে জীবনের দর্শন হিসেবে গ্রহণ করেন, দেখেন প্রার্থনা হিসেবে৷ ফলে তাদের জীবন যাপনেও আছে এর প্রভাব৷ ড. আবুল  হাসান চৌধুরী  বলেন, ‘‘এক শ্রেণির মানুষের ধর্মান্ধতার শিকার হচ্ছেন তারা৷ এটা হওয়া উচিত না৷ বাউলদের জীবন দর্শনকে সম্মান দেখাতে হবে৷''

বাংলাদেশে লোক সংগীত জনপ্রিয় করার পেছনে আব্বাস উদ্দিন, আব্দুল আলীমের নাম সবার আগে চলে আসে৷ আর তাদেরই দেখানো পথে মমতাজ লোক সংগীতকে নতুনভাবে মানুষের কাছে তুলে ধরেছেন৷ গ্রামের মানুষ শুধু নয় শহুরে মানুষ তাঁর লোক সংগীতে বুদ হয়ে যায়৷ সাইমন জাকারিয়া বলেন, ‘‘লোক সংগীত মমতাজকে এমপি বানিয়েছে৷ লোক সংগীতের প্রভাব এতই বেশি৷''  

কুষ্টিয়ার মোসলেম বাউল-এর বয়স এখন ৬০ বছর৷ ১৭ বছর বয়স থেকে গান করেন, তার একটি দলও আছে৷ সারাদেশে ঘুরে ঘুরে তিনি বাউল গান করেন৷ টেলিভিশনেও গেয়েছেন এক-দুই বার৷ মোসলেম বাউলের কথায়, ‘‘বাউল গান গেয়ে যা পাই তা দিয়ে সংসার চলে না৷ এটা দিয়ে হাত খরচ চলে৷ গান গেয়ে যা পাই আমরা দলের সবাই ভাগ করে নেই৷ গানের বাইরে আম গাছের চারা কলম করে সংসার চলে৷''

তিনি বলেন, ‘‘আমার জীবনে বাউল গান গেয়ে এক আসরে সর্বোচ্চ দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করেছি৷ তবে সব সময় এত বেশি টাকা পাওয়া যায় না৷ আর সারা বছর আমাদের ডাকও পরে না৷ শীতকালেই বেশি ডাক পাই৷''

তবে এই বাউল শিল্পী বলেন, ‘‘এখন গ্রামের চেয়ে শাহরের মানুষ বাউল গান বেশি শোনে৷ আর বাউল শিল্পীদের কদরও বাড়ছে৷''

সায়মন জাকরিয়া বলেন, ‘‘বাংলাদেশে লোক সংগীত শিল্পীদের যারা তারকা খ্যাতি পেয়েছেন তাদের কথা আলাদা৷ কেউ কেউ এখন বছরে কোটি টাকাও আয় করেন৷ কিন্তু সাধারণ শিল্পীদের অবস্থা ভালো না৷ তারা জায়গা পাচ্ছে না৷ বাংলাদেশে আগে বছরে ১২শ' লোকশিল্প মেলা হত৷ এখন সেই মেলা হাতে গোনা৷ ওই সব মেলায় লোক সংগীত শিল্পীরা গান গাইতেন৷ লোক সংগীতের প্রাণের আকর্ষণ কমেনি৷ কমছে অর্থনৈতিক প্রাপ্তি৷''

আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ