1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান
দুর্নীতিবাংলাদেশ

আকাশছোঁয়া দুর্নীতি, দমনে নেই সদিচ্ছা

সমীর কুমার দে
২৮ জুন ২০২৪

সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন সরকারি কর্মকর্তার অঢেল সম্পত্তি সমাজের একাংশে দুর্নীতির বিপুল বিস্তারকে নতুন করে আলোচনায় এনেছে৷

দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান ফটক
দুর্নীতির তথ্য পাওয়া ক্ষেত্রে এখনও দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণছবি: bdnews24.com

দুর্নীতিবাজদের দমনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কী করছে? দুদকের কমিশনার জহুরুল হক ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একজন দুইজন তো না, হাজার হাজার দুর্নীতিবাজ৷ আপনারা সাংবাদিকরা লিখলেই তো আমরা জানতে পারি৷ আসলে আমরা কয়জনের দুর্নীতি বের করবো? যাদের দুর্নীতির ব্যাপারে তথ্য আসে, তাদের বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেই৷” কারো বেনামে সম্পদ থাকলে কি দুর্নীতি দমন কমিশনের পক্ষে সেটা জানা সম্ভব? এ সম্পর্কে দুদক কমিশনার বলেন, "আমাদের তো অত জনবল নেই যে, প্রত্যেক মানুষকে ধরে ধরে তদন্ত করবো৷ কোনো না কোনো সোর্স থেকে আমাদের কাছে অভিযোগ আসতে হবে, তখনই আমরা ব্যবস্থা নিতে পারি৷ এখনও আমাদের কাছে ৪-৫ হাজারের মতো অভিযোগ জমা পড়ে আছে৷”

দুর্নীতির তথ্য পাওয়া ক্ষেত্রে এখনও দুর্নীতি দমন কমিশনের কাছে সংবাদ মাধ্যমের রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ৷ কিন্তু সংবাদ মাধ্যম কি সঠিকভাবে দুর্নীতির রিপোর্ট প্রকাশ করছে? সংবাদ মাধ্যমেও দুর্নীতির রিপোর্ট করার মতো দক্ষ সাংবাদিক কতজন? পত্রিকা বা টেলিভিশন চ্যানেল কি তথ্য পেলে সবার দুর্নীতির খবর প্রকাশ করে? জানতে চাইলে ‘কালের কন্ঠে'র অনুসন্ধানী সেলের প্রধান হায়দার আলী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘দুর্নীতির খবর প্রকাশের ক্ষেত্রে আমাদের বহু ধরনের বাধা আছে৷ প্রথমত, পত্রিকা অফিস একটা অনুসন্ধানের জন্য যে সময় ও সাপোর্ট প্রয়োজন সেটা দিতে চায় না৷ দুই দিন পরপরই জানতে চায় এখনও কেন রিপোর্ট হয়নি? অথচ একটা রিপোর্ট করার জন্য এক মাসও লেগে যেতে পারে৷ আবার সব ব্যক্তির দুর্নীতির খবর প্রকাশ করা সব সময় সম্ভবও হয় না৷ অনুসন্ধান শুরু করার পর মালিক পক্ষের কাছে এমন জায়গা থেকে ফোন এল যে, রিপোর্টটি আর আলোর মুখ দেখে না৷ সব গণমাধ্যমে এটা না হলেও কিছু কিছু গণমাধ্যমে সেটা হয়৷”

একজন দুইজন তো না, হাজার হাজার দুর্নীতিবাজ: জহুরুল হক

This browser does not support the audio element.

দুর্নীতির রিপোর্ট করার জন্য দক্ষ সাংবাদিক তৈরি হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে হায়দার আলী বলেন, ‘‘দুর্নীতির রিপোর্ট করতে হলে কী ধরনের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে হবে, আমরা অনেক সময় সেটা জানি না৷ এরজন্য আমাদের যে প্রশিক্ষন প্রয়োজন, সেটাও সব সময় সঠিকভাবে হচ্ছে না৷ দুর্নীতির বিরুদ্ধে যে পরিমান রিপোর্ট হওয়া প্রয়োজন সেটাও হচ্ছে না৷ তবে আশার কথা, সাম্প্রতিক সময়ে অনেক গণমাধ্যম দুর্নীতির রিপোর্টকে গুরুত্ব দিচ্ছে৷ অনেকেই চেষ্টা করছেন৷ কিছু কিছু ছাপা হচ্ছে৷ এই উদ্যোগটা অব্যহত থাকলে দুর্নীতি বিরোধী অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা আরও এগিয়ে যাবে৷ অনেক ভালো রিপোর্ট সামনে আমরা দেখবো৷”

সরকারি কর্মকর্তা থেকে সাধারণ মানুষ যাদের সম্পদ আছে, তাদের সবারই আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার কথা৷ বিশেষ করে সরকারি কর্মকর্তারা তো সবাই আয়কর রিটার্ন জমা দেন৷ তাদের হিসাবে কী সব সম্পদের বিবরণ থাকে? যদি থাকে তাহলে প্রশাসন কেন সেটা আমলে নেয় না? রাজস্ব কর্মকর্তা মতিউর রহমান বা পুলিশের সাবেক প্রধান বেনজীর আহমেদের হিসাব কেন তারা এতদিন দেখেনি? রাজস্ব বিভাগের সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটের সাবেক প্রধান ও সাবেক কমিশনার (ট্যাক্স পলিসি) ড. সৈয়দ মোহাম্মদ আমিনুল করিম ডয়চে ভেলেকে বলেন, "লাখ লাখ আয়কর ফাইলের সবগুলো পরীক্ষা করা সম্ভব নয়৷ প্রথমে যেটা দেখা হয়, যাদের আগের বছরের সম্পদের সঙ্গে পরের বছরের সম্পদের একটা বড় পার্থক্য আছে তাদেরগুলো৷ এর বাইরে দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে একশ'টার মধ্যে ৫টা ফাইল পরীক্ষা করা হয়৷ এর মধ্যে কারও সম্পদের হিসাবে সন্দেহ হলে সেটা সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিটে পাঠানো হয়৷”

আয়কর রির্টানের সঙ্গে কারো সম্পদের মিল না পেলে সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্ট ইউনিট কী ব্যবস্থা নেয় জানতে চাইলে আমিনুল করিম বলেন, "প্রথমে আমরা খুঁজে বের করি, তার কী পরিমান সম্পদ আছে৷ তিনি কত টাকা কর ফাঁকি দিয়েছেন৷ সেই করের টাকা সুদসহ আমরা তার কাছে দাবি করি৷ সরকারি কর্মকর্তা হলে সংশ্লিষ্ট বিভাগে সেটা পাঠানো হয়৷ তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য৷” দুদকে পাঠানোর কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, "না, আমরা দুদকে কখনও পাঠায় না৷ সেটা আমাদের ম্যান্ডেটও না৷ সংশ্লিষ্ট বিভাগ চাইলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করতে পারে৷ সেই মামলা দুদকে যেতে পারে৷”

দুর্নীতির তথ্য প্রকাশকারী সরকারি কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দিতে ২০১১ সালে একটা নতুন আইন হয়েছে৷ ‘হুইসেল ব্লোয়ার প্রোটেকশন অ্যাক্ট-২০১০' নামে আইনটি সংসদে পাশ হয়৷ আইনটি পাশ হওয়ার পরে তৎকালীন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছিলেন, "সরকারি অফিসে অধস্তন কর্মকর্তা যদি তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তার দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করে দেন সেক্ষেত্রে তার হেনস্থা হওয়ার আশংকা থাকে৷ নানাভাবে তাকে শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়৷ এজন্য দুর্নীতির তথ্য প্রকাশকারী কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দিতে এ আইন করা হয়েছে৷ ”

আইনটিতে বলা হয়েছে, "কোনো ব্যক্তি সঠিক তথ্য প্রকাশ করলে তার সম্মতি ছাড়া তার পরিচয় প্রকাশ করা যাবে না৷ সঠিক তথ্য প্রকাশের কারণে তার বিরুদ্ধে কোনো ফৌজদারি বা দেওয়ানি বা বিভাগীয় মামলা করা যাবে না৷ চাকরিজীবীর ক্ষেত্রে তার পদানবতি, হয়রানিমূলক বদলি, বাধ্যতামূলক অবসর, তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা বা বৈষম্যমূলক আচরণ করা যাবে না৷” শুধু তাই নয়, দুর্নীতির তথ্য শুধু উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিতভাবে কিংবা ই-মেইলে প্রকাশ করা যাবে বলেও ওই আইনে উল্লেখ করা হয়েছে৷

অথচ ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)-র সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার দুর্নীতির কিছু তথ্য সাংবাদিককে দেওয়ায় গাজীপুর মহানগর পুলিশ (জিএমপি)-র অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) জিসানুল হককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে৷ ২৪ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. জাহাংগীর আলমের সই করা এক প্রজ্ঞাপনে তাকে বরখাস্ত করা হয়৷ জিসানুল হক গাজীপুর মহানগর পুলিশের বৈধ আড়ি পাতা শাখায় (এলআইসি) কর্মরত ছিলেন৷ সাবেক ডিএমপি কমিশনারের ব্যক্তিগত তথ্য তিনি প্রকাশ করেছেন বলে অভিযোগ ওঠে৷

‘হুইসেল ব্লোয়ার প্রটেকশন অ্যাক্ট-২০১০' থাকার পরও কেন দুর্নীতির তথ্য দেওয়ার অভিযোগে একজন কর্মকর্তার চাকরি গেল? জানতে চাইলে সাবেক সিনিয়র সচিব আবু আলম শহীদ খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এসব কারণেই তো আইনটি হওয়ার ১৩ বছর পরও কেউ তথ্য দিতে চান না৷ কারণ আমরা তথ্যদাতাকে সুরক্ষা দিতে পারছি না৷ তথ্যদাতাকে যদি আমরা সুরক্ষা দিতে না পারি তাহলে তো দুর্নীতির খবর সামনে আসবে না৷”

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে গত বছরের ১৪ জুন ‘দৈনিক ইত্তেফাকে' একটা রিপোর্ট ছাপা হয়েছিল৷ সেখানে বলা হয়েছিল, "বিদেশে সম্পদ আছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ কিনেছেন এমন ব্যক্তিদের তালিকা করছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা৷ প্রাথমিকভাবে গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে, বিদেশে সম্পদ গড়া ব্যক্তিদের মধ্যে শীর্ষে আছেন আমলারা৷ এছাড়া বড় ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক নেতা, এমনকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক সদস্য আছেন৷ অনেকের স্ত্রী আমেরিকায় নাগরিকত্ব নিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন৷ সন্তানরাও সেখানে পড়াশোনা করছে৷ নিজের পাসপোর্টেও লম্বা মেয়াদে আমেরিকার ভিসা লাগানো আছে৷ এই ধরনের ব্যক্তিরা সরকারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে৷ তাদের কেউ কেউ আমেরিকাকে খুশি করার চেষ্টা করছেন৷”

১৩ বছরে একজনও তথ্য দিতে এগিয়ে আসেননি: আবু আলম শহীদ খান

This browser does not support the audio element.

সংবাদ মাধ্যমে কারও দুর্নীতির খবর ছাপা হওয়ার পর দুদককে নড়ে চড়ে বসে৷ সরকারি এমন কোনো ব্যবস্থা কি নেই, যা দিয়ে কারও অবৈধ সম্পদ থাকলে সেটা ধরা যায়? জানতে চাইলে আবু আলম শহীদ খান বলেন, "আরো অবৈধ সম্পদ হলে সামাজিকভাবেই সেটা জানা যায়৷ তার চলাফেরা, সন্তানদের পড়াশোনাসহ অনেক কিছুই দেখে প্রতিবেশিরা ধারণা করতে পারেন৷ ফলে কেউ অবৈধ সম্পদের মালিক হলেন সেটা কেউ জানে না, একথা ঠিক না৷ সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি আছে৷ তাদের কেউ না কেউ তো জানে৷ কিন্তু সমস্যা হলো এই কথাগুলো কেউ বলেন না৷” না বলার কারণ জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, "এর অনেকগুলো কারণে আছে৷ যদি তিনি খুবই প্রভাবশালী হন তাহলে অযথা হয়রানির ভয়ে কেউ বলেন না৷ এই জন্য তো ‘হুইসেল ব্লোয়ার প্রটেকশন অ্যাক্ট করা হয়েছিল৷ কিন্তু গত ১৩ বছরে একজন ব্যক্তিও তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে এগিয়ে আসেননি৷”  

কারও অবৈধ সম্পদের তথ্য সংবাদ মাধ্যমে আসার পরও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দুদক অনেক ক্ষেত্রেই সময়ক্ষেপন করে৷ আর সেই সুযোগে ওই ব্যক্তি ব্যাংক থেকে টাকা পয়সা নিয়ে বিদেশে চম্পট দিচ্ছেন৷ সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে প্রথম রিপোর্ট ছাপা হয় গত ৩১ মার্চ৷ তিনি বিদেশে যান মে মাসের প্রথম সপ্তাহে৷ এরপর তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয় দুদক৷ মধ্যে যে এক মাস পেরিয়ে গেছে, এই সময়ে তিনি ও তার পরিবারের সদস্যরা তাদের ৩৩টি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে অন্তত ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন৷ দুদুক তদন্তে নেমে এ তথ্য পেয়েছে৷ তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানান, বেনজীর আহমেদের কিছু অ্যাকাউন্ট ‘জিরো ব্যালেন্স' হয়ে গেছে, যদিও তিনি পরিমাণ বলতে অস্বীকৃতি জানান৷

দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি প্রসঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ট্রাষ্টি বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান এম হাফিজ উদ্দিন খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, "রাষ্ট্রীয় যে ব্যবস্থা আছে, তাতে কেউ দুর্নীতি করে পার পাওয়ার সুযোগ নেই৷ এখন প্রশ্ন হলো, আমরা আসলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাই কিনা? যদি না চাই তাহলে তো বেনজীর আহমেদের মতো টাকা পয়সা তুলে নিয়ে বিদেশে চলে যাবে৷ আর যদি ব্যবস্থা নিতে চাই তাহলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব৷ সরকারের এত এজেন্সি, তারপর কেউ জানবে না, একজন সরকারি কর্মকর্তা বিপুল পরিমান অবৈধ সম্পদ গড়লেন? এটা হতে পারে না৷ আসলে দুর্নীতি দমনে ছাড় দিয়ে এটা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব না৷ সরকার কঠোর হলেই নিয়ন্ত্রণ সম্ভব৷ এখানে কে আমার ঘনিষ্ট, আর কে ঘনিষ্ট না সেটা দেখা যাবে না৷’’

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য

আরো সংবাদ দেখান
স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

ডয়চে ভেলের শীর্ষ সংবাদ

স্কিপ নেক্সট সেকশন ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ

ডয়চে ভেলে থেকে আরো সংবাদ