প্লাস্টিক দূষণ আমাদের গ্রহের একটি মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ তাই এক ফরাসি প্রযুক্তিবিদ আখ থেকে একটি প্লাস্টিকের বোতল তৈরি করেছেন, যা পুরোপুরি ‘বায়োডিগ্রেডেবল', অর্থাৎ কালে নিজেই পচে নষ্ট হয়ে যায়৷
বিজ্ঞাপন
সারা বিশ্বে প্রতি মিনিটে দশ লাখ প্লাস্টিকের বোতল কেনা হয়৷ এমনকি জার্মানির মতো পরিবেশ বান্ধব দেশেও ক্রমে আরো বেশি মানুষ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়ার মতো প্লাস্টিকের বোতলের দিকে ঝুঁকছেন৷
অথচ প্লাস্টিকের বোতল তৈরিতে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি ও অপরাপর সম্পদ খরচ হয়৷ এক জার্মানিতেই প্লাস্টিকের বোতল তৈরিতে লাগে বছরে ৬৬৫,০০০ টন খনিজ তেল ও ১,১০০ কোটি কিলোওয়াট/ঘণ্টা বিদ্যুৎ – যা থেকে বছরে সাড়ে বারো লাখ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয় (পরিবেশ সংগঠন ডিইউএইচ-এর পরিসংখ্যান)৷
অধিকাংশ প্লাস্টিকের বোতলই রিসাইকল করা সম্ভব, কিন্তু অধিকাংশ দেশের তা করার মতো পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই৷ ফলে বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক নদী বেয়ে সমুদ্রসৈকত ও সাগরে গিয়ে পড়ছে ও প্লাস্টিক বায়োডিগ্রেডেবল নয় বলে, সেখানে জমা হচ্ছে৷ এমনকি সাগরের মাছের মাধ্যমে তা মানুষের খাদ্যেও প্রবেশ করছে ও স্বাস্থ্যের বিপদ ঘটাচ্ছে৷
প্লাস্টিকের পানির বোতলের জীবন
সারা বিশ্বে প্রতিবছর লক্ষ লক্ষ বোতল পানি বিক্রি হয়৷ কিন্তু পানি পান করার পর প্লাস্টিকের ঐ বোতলগুলোর কী হয় তা কি জানেন? ছবিঘরে থাকছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত৷
ছবি: Fotolia/zhekos
প্লাস্টিকের দামই বেশি
এক বোতল পানি কেনার জন্য আপনি যে দাম দেন তার বেশিরভাগই কিন্তু চলে যায় প্লাস্টিকের জন্য৷ এছাড়া রয়েছে বোতলের গায়ে লেবেল লাগানো, পরিবহণ, সংরক্ষণ ও বোতল নষ্ট করে ফেলার খরচ৷
ছবি: Fotolia/fottoo
তেলের ব্যবহার
অশোধিত তেল দিয়ে তৈরি হয় পলিইথিলিন টেরেফথালেট (পিইটি) প্লাস্টিক৷ এরপর সেটা দিয়েই তৈরি হয় প্লাস্টিকের বোতল৷ এই তেল উৎপাদনের সময় গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন হয়৷ এছাড়া প্লাস্টিক তৈরির সময় বিভিন্ন বিষাক্ত উপাদান পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে৷ ছবিতে জার্মানির সবচেয়ে বড় তেলশোধন প্ল্যান্ট দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: picture-alliance/dpa
বড়ি থেকে বোতল
পরিশোধিত তেল থেকে প্রথমে প্লাস্টিকের এমন ছোট ছোট বড়ি তৈরি করা হয়৷ এরপর সেগুলোকে গলিয়ে বোতল তৈরি করা হয়৷
ছবি: Fotolia/digitalstock
চারে এক
আর্থ পলিসি ইনস্টিটিউটের হিসেবে সারা বিশ্বে উৎপাদিত চারটি পানির বোতলের অন্তত একটি ক্রেতার খোঁজে কমপক্ষে একটি আন্তর্জাতিক সীমানা অতিক্রম করে৷ অর্থাৎ, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যায়৷ এভাবে পানি পরিবহণের জন্য ব্যবহৃত যানবাহন থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী৷
ছবি: picture-alliance/dpa
পানি সংকট
প্যাসিফিক ইনস্টিটিউটের হিসেবে এক বোতল পানির জন্য তিনগুণ বেশি পানি খরচ হয়৷ ফলে যে অঞ্চলে পানির ফ্যাক্টরি অবস্থিত সেখানকার ভূগর্ভে পানির স্বল্পতা দেখা দেয়৷
ছবি: picture-alliance/dpa
মাত্র অর্ধেক
এক হিসেবে জানা গেছে, ইউরোপে গত বছর প্রায় ৬০ মিলিয়ন প্লাস্টিক বোতল রিসাইকেল করা হয়৷ পরিমাণটা, যত বোতল ব্যবহৃত হয়েছে তার অর্ধেকের কিছু বেশি৷ বাকি বোতলগুলো বিভিন্ন জায়গায় জমে গিয়ে বিশেষ করে জলাধার ও সাগরে পড়ে গিয়ে পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করছে৷
ছবি: JOSEPH EID/AFP/Getty Images
রিসাইক্লিং
ব্যবহার হওয়ার পর পানির বোতলগুলো রিসাইকেল করে বিভিন্ন পণ্য তৈরি করা হয়৷ যেমন এক ধরণের পশম, যেটা শীতবস্ত্র জাতীয় পোশাক তৈরিতে কাজে লাগে৷
ছবি: Fotolia/zhekos
7 ছবি1 | 7
ফরাসি শিল্পপতি ও প্যাকেজিং ডিজাইনার নিকোলা মুফলে বহু বছর ধরে বড় বড় কোম্পানির জন্য প্লাস্টিকের বোতল তৈরি করেছেন৷ এবার তিনি একটি ‘‘ভেজান'' বা পুরোপুরি নিরামিষ বা ‘নির্প্লাস্টিক' বোতল বিকাশের কাজে মন দিয়েছেন৷ পেট্রোকেমিক্যাল থেকে তৈরি প্লাস্টিকের তুলনায় মুফলে-র কোম্পানির সৃষ্ট এই বোতল নাকি শতকরা ১০০ ভাগ বায়োডিগ্রেডেবল, বলে তাদের দাবি৷
‘এখো' বোতল?
আখ থেকে তৈরি বোতলগুলি বাজারে ছাড়া হয় বছর দেড়েক আগে৷ প্রধানত ফলের রসের দোকান অথবা জড়িবুটি কিংবা প্রসাধনদ্রব্যের বিক্রেতারা এই ‘নিরামিষ' বোতল ব্যবহার করে থাকেন৷ এই ‘বায়োপ্লাস্টিক' নাকি একবার মুক্ত প্রকৃতিতে গিয়ে পড়লে এক থেকে দু'বছরের মধ্যেই অন্তর্হিত হয়৷
একটা মুশকিল থেকে যাচ্ছে: মুফলের কোম্পানি লিসপ্যাকেজিং-এর বোতলগুলো দেখতে ঠিক প্লাস্টিকের বোতলের মতো – সাদা এবং স্বচ্ছ – কাজেই গ্রাহকরা বুঝবেন কী করে যে এগুলো পরিবেশ বান্ধব এখো প্লাস্টিক থেকে তৈরি? তাই অলিভের বিচি গুঁড়িয়ে এখো প্লাস্টিকে রং ধরানোর কাজ চলেছে৷
লিসপ্যাকেজিং কোম্পানি চলতি বছর শেষ হবার আগে সাত লাখ বায়োডিগ্রেডেবল বোতল তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে৷ শুধু বোতলই নয়, অন্যান্য প্লাস্টিক পণ্যের ক্ষেত্রেও নিরামিষ ‘এখো' প্লাস্টিকের ব্যবহার দেখতে চান মুফলে – বিশেষ করে ফ্রান্স যখন সাধারণভাবে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর চেষ্টা চালাছে৷
২০১৬ সালে ফ্রান্স ঘোষণা করে যে, ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের প্লেট বা কাপ-ডিশ ও কাঁটাচামচ আগামীতে নিষিদ্ধ করা হবে ও তার পরিবর্তে কাপড় কিংবা মাড় থেকে তৈরি পণ্য ব্যবহার করা হবে, যা পচিয়ে সার করা সম্ভব৷ লিসপ্যাকেজিং-এর এখো প্লাস্টিক এক্ষেত্রে তার অবদান রাখার আশা করছে৷
জেনিফার কলিন্স/এসি
পরিবেশ রক্ষায় প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াজাতকরণ
গত কয়েক বছরে ঢাকায় প্লাস্টিক বোতলজাত পানীয় ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায়, তা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ তবে বর্তমানে বেশ কিছু প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারাখানা গড়ে ওঠায়, এ সমস্যা অনেকটাই দূর হওয়ার পথে৷
ছবি: DW/M. Mamun
পরিবেশের হুমকি প্লাস্টিক বোতল
ঢাকার একটি দোকানে প্লাস্টিক বোতলগুলোয় বিভিন্ন রকম পানীয়৷ গত কয়েক বছরে প্লাস্টিক বোতলজাত পানীয় বিক্রি বৃদ্ধি পাওয়ায়, তা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ ব্যবহৃত বোতল যেখানে সেখানে ফেলায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে৷ তবে এবার বেশ কয়েকটা প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারাখানা গড়ে ওঠায় এ সমস্যা দূর হতে যাচ্ছে বলে আশা করছেন অনেকেই৷
ছবি: DW/M. Mamun
কামরাঙ্গীর চরের কারখানা
ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে ব্যবহৃত প্লাস্টিক বোতল সংগ্রহ করে এনে বিক্রির জন্য পরিমাপ করা হচ্ছে কামরাঙ্গীর চরের একটি কারখানায়৷ এখানে ধরণ অনুযায়ী প্রতি কেজি বোতলের জন্য দেয়া হয়ে থাকে ছয় টাকা থেকে পনেরো টাকা৷
ছবি: DW/M. Mamun
শ্রমিকদের বেশিরভাগই নারী
পরিমাপের পর বাছাই করার জন্য বোতল নামাচ্ছেন এক মহিলা কর্মীরা৷ ঢাকার বিভিন্ন বোতল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানায় কর্মরত শ্রমিকদের অধিকাংশই নারী৷ কামরাঙ্গীরচরের এ সব কারখানায় মহিলা শ্রমিকেরা পুরুষের চেয়ে কম বেতন পান৷ এক সপ্তাহ কাজ করে একজন পুরুষ শ্রমিকের বেতন কমপক্ষে ২০০০ টাকা৷ অথচ সমান কিংবা তারও বেশি কাজ করে একজন নারী শ্রমিক পান মাত্র ১৪০০ টাকা৷
ছবি: DW/M. Mamun
কারখানার জন্য স্বতন্ত্র জায়গা
বিভিন্ন রঙের বোতলগুলো বাছাই করে আলাদা করা হয়৷ এ সব প্লাস্টিকের বোতল থেকে প্রতিবছর বাংলাদেশে আসে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা৷ রপ্তানিতে উৎসাহ দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকও এ সব রপ্তানীকারকদের দশ ভাগ ‘ইনসেনটিভ’ দিয়ে থাকে৷ এছাড়া এ ধরণের কারখানার জন্য স্বতন্ত্র একটি জায়গার কথাও ভাবছে বাংলাদেশে ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন এফবিসিসিআই৷
ছবি: DW/M. Mamun
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ
প্লাস্টিক বোতল প্রক্রিয়াকরণ কারখানার শ্রমিকরা কাজ করেন মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে৷ ছবিটা দেখেই যেটা একেবারে স্পষ্ট হয়ে উঠছে আপনার কাছে – তাই না?
ছবি: DW/M. Mamun
ধোয়া ও শুকানো
বোতলগুলো চূর্ণ করে ভাঙার পরে সেগুলো ফেলা হয় ছোট এই চৌবাচ্চায়৷ এরপর সেখান থেকে ধুয়ে সেগুলো শুকানোর জন্য দেয়া হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
রপ্তানির জন্য প্রস্তুত
পানিতে ধোয়া প্লাস্টিকের টুকরা শুকানো হচ্ছে বৈদ্যুতিক পাখার বাতাসে৷ বলা বাহুল্য, এগুলোকে সম্পূর্ণ পানিমুক্ত করে তবেই রপ্তানির জন্য প্রস্তুত করা হয়৷
ছবি: DW/M. Mamun
চূড়ান্ত বাছাই
সবশেষে চূড়ান্ত বাছাই করা হয় টুকরাগুলো৷ এ সব প্লাস্টিকের টুকরাগুলো মূলত চীনে রপ্তানি করা হয়৷ তবে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশেও কয়েকটি কারখানা গড়ে উঠেছে, যেখানে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয় এ সব বর্জ্য প্লাস্টিক৷ এই প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হয় মূলত বিভিন্নরকম ফাইবার৷
ছবি: DW/M. Mamun
ঝুঁকিপূর্ণ কাজ
বোতলগুলোকে এ পর্যায়ে মেশিনে দিয়ে ভাঙা হয়৷ এই ঝুঁকিপূর্ণ কাজটি মহিলা ও পুরুষেরা সমানভাবেই করে থাকেন৷
ছবি: DW/M. Mamun
বর্জ্য অপসারণের পাশাপাশি বর্জ্য তৈরি
এ সব কারখানা ঢাকা থেকে বর্জ্য অপসারণে ভূমিকা রাখলেও, নিজেরাই আবার ভূমিকা রাখে বর্জ্য তৈরিতে৷ প্লাস্টিক বোতলের যেসব অংশের বাণিজ্যিক মূল্য নেই, সেসব সরাসরি ফেলা হয় পাশের বুড়িগঙ্গার শাখা নদীতে৷ ফলে এ নদীটির জলপ্রবাহ প্রায় বন্ধের উপক্রম৷