বিশ্বজুড়ে মানবিক সংকটের কারণে জাতিসংঘ আগামী বছরের জন্য আরো অর্থায়নের আবেদন জানিয়েছে৷ চলতি বছর বিশাল ঘাটতির উল্লেখ করে দাতা দেশগুলির কাছে কঠিন পরিস্থিতি তুলে ধরেছে মানবিক সহায়তা সংস্থা৷
বিজ্ঞাপন
নতুন বছরেও বিশ্বজুড়ে মানবিক বিপর্যয়ের কারণে অনেক মানুষের সহায়তার প্রয়োজন হবে৷ জাতিসংঘ সেই লক্ষ্যে প্রায় ৪,৬০০ কোটি মার্কিন ডলার অংকের আবেদন করেছে৷ ২০২৪ সালের ‘গ্লোবাল হিউম্যানিটেরিয়ান ওভারভিউ' নামের রিপোর্টে জাতিসংঘের মানবিক বিষয় সমন্বয়কারি সংস্থা ওসিএইচএ এমন পরিস্থিতি তুলে ধরেছে৷ সংঘাত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে জরুরি পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মানুষ অসহায় অবস্থায় রয়েছে৷ শুধু অধিকৃত ফিলিস্তিনি এলাকা, সুদান ও ইউক্রেনেই মানুষের জন্য লাগাতার সহায়তার প্রয়োজন বলে জাতিসংঘের এই সংস্থা মনে করে৷ সংবাদ শিরোনামের আড়ালে আফ্রিকার পূর্ব ও দক্ষিণ অংশেই প্রায় সাত কোটি ৪১ লাখ মানুষ সহায়তার উপর নির্ভর করছে৷ সিরিয়া, ইয়েমেন ও আফগানিস্তানেও অনেক মানুষ এমন সহায়তার উপর নির্ভর করছেন৷
জাতিসংঘের সহায়তা সংস্থার প্রধান মার্টিন গ্রিফিথস বলেন, আন্তর্জাতিক রেড ক্রস এবং রেড ক্রসের জাতীয় দফতরগুলিও সহায়তার অর্থায়নের জন্য আলাদা করে আবেদন জানাবে৷ তবে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এমন কঠিন পরিস্থিতি সত্ত্বেও দাতা দেশগুলি হাত গুটিয়ে নিচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন৷ গ্রিফিথস বলেন, অর্থায়নের ক্ষেত্রে চরম ঘাটতি দেখা যাচ্ছে৷ তাই সহায়তা সংস্থাগুলি মানবিক পরিস্থিতির মূল্যায়ন করতে গিয়ে অত্যন্ত বাস্তববাদী ও কড়া মনোভাব নিয়ে নির্দিষ্ট সংকটের প্রতি মনোযোগ দিচ্ছে৷ ২০২৩ সালে ৫,৬৭০ কোটি ডলারের আবেদন করেও শেষ পর্যন্ত এই অংকের মাত্র ৩৫ শতাংশ হাতে পেয়েছে জাতিসংঘ৷ সেই অর্থ কাজে লাগিয়ে প্রায় ১২ কোটি ৮০ লাখ মানুষকে সহায়তা দেওয়া সম্ভব হয়েছে৷ গ্রিফিথস বলেন, ২০২৩ সালে এই প্রথম আগের বছরের তুলনায় আর্থিক সহায়তা বাড়ার বদলে কমে যাবে বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে৷
গ্রিফিথসের মতে, ২০২৪ সালে সার্বিকভাবে মধ্যপ্রাচ্য এবং নির্দিষ্টভাবে গাজা ও পশ্চিম তীরের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে৷ তাছাড়া আগামী বছর ইউক্রেন যুদ্ধ নতুন করে শুরু হবার আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি সেখানেও সহায়তার প্রয়োজনের উল্লেখ করেন৷ মোট ৭২টি দেশের জন্য সহায়তার আবেদন জানিয়েছে জাতিসংঘ৷ ২৬টি সংকটে জর্জরিত দেশ এবং ৪৬টি দেশ, যেগুলি প্রতিবেশী দেশগুলির সংকটের কারণে সমস্যায় পড়েছে, তাদেরও সহায়তার প্রয়োজন৷
জাতিসংঘ মানবিক সংকটে কীভাবে সহায়তা করে, গ্রিফিথস সে বিষয়ে বিস্তারিত জানান৷ মানুষের প্রাণ বাঁচানো, ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রাম, শিশুদের সুরক্ষা, মহামারি মোকাবিলা এবং গৃহহীন মানুষকে আশ্রয় দেবার মতো কর্মকাণ্ডে জাতিসংঘ কাজ করে চলেছে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কার কারণে মানবিক সহায়তার প্রয়োজন আরো বেড়ে যাবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন৷
এসবি/কেএম (রয়টার্স, এএফপি)
২০২২ : জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিপর্যয়ের বছর
এ বছর বিশ্বের নানা দেশে প্রচণ্ড গরম পড়েছে, খরা, দাবদাহ হয়েছে, ঝড় আর বন্যার কারণেও বিপর্যস্ত হয়েছে কোটি কোটি মানুষের জীবন৷ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রধান কারণ জলবায়ু পরিবর্তন৷ দেখুন ছবিঘরে...
ছবি: Peter Dejong/AP Photo/picture alliance
ইউরোপ : আগের চেয়ে গরম ও শুষ্ক
এ বছর গ্রীষ্মে প্রচণ্ড গরম ছিল ইউরোপে৷ তখন এমন খরা ছিল যা গত ৫০০ বছরেও দেখা যায়নি৷ স্পেনে তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে৷ দাবানলের কারণে রেকর্ড ৪৫জন মারা যান৷ ব্রিটেনসহ আরো কয়েকটি দেশে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ায়৷ তখন বিভিন্ন স্থানে খাওয়ার পানির সংকট দেখা দেয়৷
ছবি: Thomas Coex/AFP
দাবদাহের কবলে ইউরোপ
পশ্চিমে পর্তুগাল, স্পেন এবং ফ্রান্স, পূর্বে ইটালি, গ্রিস ও সাইপ্রাস হয়ে উত্তরে সাইবেরিয়া পর্যন্ত ইউরোপের বিশাল এলাকা গ্রীষ্মে দাবদাহে পুড়েছে৷ আগুনে পুড়েছে ছয় লাখ ৬৬ হাজার হেক্টর জমি৷ ২০০৬ সালের পর আর কখনো দাবদাহে এত বড় এলাকা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি৷
বর্ষায় এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশে বন্যা হয়েছে৷ সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়েছে পাকিস্তানে৷ প্রবল মৌসুমী বৃষ্টিতে দেশটির এক তৃতীয়াংশ ডুবে যায়, কমপক্ষে ৩৩ লাখ মানুষ ঘরছাড়া হয়, প্রাণ যায় কমপক্ষে ১১০০ জনের৷ বন্যায় ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশ আফগানিস্তানের কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে অনেক মানুষ দীর্ঘস্থায়ী ক্ষুধার যন্ত্রণা মেনে নিতে বাধ্য হন৷
ছবি: Stringer/REUTERS
এশিয়ায় ঘূর্ণিঝড়
আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ভারতকে এবার ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতও সামলাতে হয়৷ তবে চীনে গত ৬০ বছরের মধ্যে ভয়াবহতম খরা ও স্মরণকালের ভয়ঙ্করতম দাবদাহ হয়েছে৷ খরা ও দাবদাহের পাশাপাশি ছোট-বড় ১২টি ঘূর্ণিঝড়ও বয়ে গেছে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশটির ওপর দিয়ে৷ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব ফিলিপাইন্স, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া আর বাংলাদেশও টের পেয়েছে৷ এশিয়ার এই চার দেশেও এবার ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে৷
ছবি: Mark Schiefelbein/AP Photo/picture alliance
আফ্রিকায় জলবায়ু পরিবর্তনের কুপ্রভাব
বিশ্বের বাকি সব অঞ্চল থেকে অনেক দ্রুত উত্তপ্ত হয়ে উঠছে আফ্রিকা৷ এ কারণে এই মহাদেশে বৃষ্টির ধরন বদলাচ্ছে, বাড়ছে অসময়ে বৃষ্টি, বন্যা, অনাবৃষ্টি, খরা৷ আফ্রিকার দেশ সোমালিয়া এখন গত ৪০ বছরের মধ্যে ভয়াবহতম খরার সঙ্গে লড়ছে৷ খরার কারণে এ পর্যন্ত অন্তত ১০ লাখ মানুষ ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছে৷
ছবি: ZOHRA BENSEMRA/REUTERS
আফ্রিকায় বন্যা,খরায় চাষাবাদ বন্ধের জোগাড়
বন্যা এবং দীর্ঘ খরার কারণে আফ্রিকার বড় একটি অংশে বছরের বেশির ভাগ সময় স্বাভাবিক চাষবাস সম্ভব হয়নি৷ ইথিওপিয়া, সোমালিয়া এবং কেনিয়ায় এ বছর অনেক মানুষ ক্ষুধায় মারা গেছে৷
ছবি: Dong Jianghui/dpa/XinHua/picture alliance
নর্থ অ্যামেরিকায় আগুন এবং বন্যা
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাডা এবং অ্যারিজোনায় একাধিক ভয়াবহ ঝড় হয়েছে৷ গ্রীষ্মের শেষ দিকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি তাপমাত্রার কারণে তিন রাজ্যেই দাবানল ছড়িয়ে পড়ে৷ অন্যদিকে ইয়েলোস্টোন ন্যাশনাল পার্ক এবং কেন্টাকি রাজ্যে ছিল বিপরীত চিত্র৷ প্রবল বর্ষণের কারণে বন্যা হয়েছে সেখানে৷
ছবি: DAVID SWANSON/REUTERS
ঘূর্ণিঝড়ে লন্ডভন্ড অ্যামেরিকা
সেপ্টেম্বরে ফ্লোরিডার ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ইয়ান৷ ঝড়ের কারণে যে ব্যাপক ক্ষতি হয় রাজ্য কর্তৃপক্ষ তাকে ‘ঐতিহাসিক’ হিসেবে বর্ণনা করে৷ ফ্লোরিডার আগে অবশ্য কিউবায় আঘাত হেনেছিল ইয়ান৷ ঝড়ের কারণে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ায় বেশ কিছুদিন অন্ধকারে থাকতে হয় কিউবানদের৷ সেপ্টেম্বরে লাতিন অ্যামেরিকা এবং ক্যারিবিয়া হয়ে ক্যানাডার ওপর দিয়ে বয়ে যায় ঘূর্ণিঝড় ফিওনা৷
ছবি: Giorgio Viera/AFP/Getty Images
সেন্ট্রাল অ্যামেরিকাতেও ঝড়ের আঘাত
সেন্ট্রাল অ্যামেরিকায় শুধু ফিওনা আঘাত হানেনি৷ অক্টোবরে কলম্বিয়া, ভেনেজুয়েলা, নিকারাগুয়া, হন্ডুরাস এবং এল সালভাদরে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় জুলিয়া৷ ব্যাপক ক্ষতি হয় তাতে৷
ছবি: Matias Delacroix/AP Photo/picture alliance
সাউথ অ্যামেরিকায় খরা
এ বছর প্রায় পুরো সাউথ অ্যামেরিকাই ভয়াবহ খরার সঙ্গে যুদ্ধ চালিয়ে যায়৷ চিলিতে অনাবৃষ্টি চলছে ২০০৭ সাল থেকে৷ দেশটির অনেক নদী-নালা ৫০ থেকে ৯০ ভাগ পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে৷ মেক্সিকোতেও অনেক বছর ধরে বৃষ্টি হয় না৷ আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, উরুগুয়ে, বলিভিয়া, পানামা এবং ইকুয়েডর ও কলম্বিয়ার একাংশও কয়েক বছর ধরে খরার সঙ্গে বসবাস করছে৷
ছবি: IVAN ALVARADO/REUTERS
জলমগ্ন নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া
অতিবৃষ্টির ফলে এ বছর অস্ট্রেলিয়ায় দেখা দেয় ভয়াবহ বন্যা৷ জার্মানিতে সারা বছরে যেটুকু বৃষ্টি হয়েছে, অস্ট্রেলিয়ার পূর্ব উপকূলে তার চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টি হয়েছে শুধু জানুয়ারি আর ফেব্রুয়ারি মাসে৷ লা নিনার প্রভাবে নিউজিল্যান্ডেও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে৷