মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী, আগামী সপ্তাহ থেকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন শুরু হওয়ার কথা৷ সেই প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের বিস্তারিত নিয়ে দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে সোমবার আলোচনা হয়েছে৷
বিজ্ঞাপন
মিয়ানমারের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ঐ আলোচনায় বাংলাদেশের ১৪ সদস্যের এক প্রতিনিধি দল অংশ নিয়েছে৷ মিয়ানমারের সমাজকল্যাণ ও ত্রাণমন্ত্রী উইন মিয়াত আয়ে বলেন, কতজন রোহিঙ্গাকে ফিরতে দেয়া হবে এবং কীভাবে তাদের পরিচয় পরীক্ষা করা হবে, সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷
বাংলাদেশের দুই কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বার্তা সংস্থা এএফপিকে আলোচনার ব্যাপারটি নিশ্চিত করলেও বিষয়বস্তু সম্পর্কে বিস্তারিত জানাননি৷
এদিকে, মিয়ানমারের সরকারি গণমাধ্যম ‘গ্লোবাল নিউ লাইট অফ মিয়ানমার'-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২৩ জানুয়ারি থেকে রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করতে প্রস্তুত মিয়ানমার৷ এ লক্ষ্যে মংদুতে ১২৪ একর এলাকার উপর একটি ‘অস্থায়ী ক্যাম্প' নির্মাণের কাজ শেষের পথে রয়েছে৷ সেখানে ৬২৫টি ভবনে প্রায় ত্রিশ হাজার জনের বসবাসের ব্যবস্থা হবে বলেও ঐ প্রতিবেদনে জানানো হয়৷ স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা হওয়ার আগ পর্যন্ত রোহিঙ্গারা ঐ ক্যাম্পে থাকবেন৷
রোহিঙ্গা শিশুদের খোঁজ নিচ্ছে না কেউ
01:26
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করতে গত বছরের নভেম্বরে ঢাকায় দুই দেশের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল৷ এরপর ডিসেম্বরে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এক লক্ষ রোহিঙ্গার নামের একটি তালিকা মিয়ানমারকে দেয়া হয়৷ তবে মিয়ানমার এখনও ঐ তালিকা পাবার বিষয়টি নিশ্চিত করেনি৷
চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছেন তাঁদের ফিরে যাওয়ার কথা৷ জাতিসংঘের হিসেবে সংখ্যাটি সাড়ে ছয় লক্ষের উপরে৷ তবে মিয়ানমার আসলেই কতজন রোহিঙ্গাকে ফেরতে নেবে, তা নিয়ে কূটনীতিকদের মধ্যে সংশয় রয়েছে৷
এদিকে, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর আগে তাঁরা আসলেই ফিরতে চান কিনা, তা জিজ্ঞাসা করার দাবি জানিয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা৷ কারণ, বাংলাদেশে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের অনেকের মনে শঙ্কা যে, মিয়ানমারে ফিরে গেলে আবারও হয়ত নির্যাতনের শিকার হতে হবে৷ বার্তা সংস্থা এএফপি বলছে, বাংলাদেশের ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া অনেক রোহিঙ্গার সঙ্গে তাদের প্রতিবেদকরা কথা বলেছেন৷ এদের বেশিরভাগই মিয়ানমারে ফিরতে আগ্রহী নন৷
বাদামি ছাতা ও এক রোহিঙ্গা পরিবারের সংগ্রাম
মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্যাতন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে নূর হাফেস ও তাঁর পরিবার৷ ১২ বছরের হাফেস এখন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
আগতদের ছায়া দেয়া
বাদামি ছাতা হাতে ছেলেটির নাম নূর হাফেস৷ বয়স মাত্র ১২৷ দুই মাসেরও বেশি সময় আগে ছোট সাত ভাই-বোন ও মায়ের সঙ্গে বাংলাদেশে পালিয়ে যায় সে৷ এই বাদামি ছাতার সঙ্গে আগতদের আশ্রয় দিয়ে কিছু অর্থ উপার্জন করে নূর হাফেস৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
পরিবারকে সহায়তা
বাদামি ছাতার তলে একজনকে আশ্রয় দিয়ে তাঁর কাছ থেকে পাওয়া ৫০ টাকা দেখাচ্ছে নূর হাফেস৷ এর বাইরে ইমামদের কাছ থেকেও মাঝেমধ্যে টাকা পায় সে৷ রোহিঙ্গাদের জন্য বিভিন্ন মসজিদে মুসল্লিদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে সেগুলো রোহিঙ্গাদের মাঝে বিতরণ করেন ইমামরা৷ বাবা না থাকায় ১২ বছরের নূর হাফেসই এখন তার পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ব্যক্তি৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
বাবার খবর নেই
হাফেসদের বাড়ি ছিল মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংদুর থারায় কোন ইয়ো ডান গ্রামে৷ সেনাবাহিনীর উপস্থিতি টের পেয়ে কিছু বুঝে উঠতে না পেরে নূর হাফেসের বাবা কোথাও চলে যায়৷ এরপর থেকে বাবার আর খবর নেই৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
স্বামী ছাড়াই বাংলাদেশে পাড়ি
স্বামীর খোঁজ না পেয়ে জীবন বাঁচাতে হাফেস সহ আট সন্তানকে নিয়ে নৌকা করে বাংলাদেশে পালিয়ে যান রাবিয়া খাতুন৷ বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে তিনি মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংসতার কথা শুনিয়েছেন৷ এখন তারা আছে কক্সবাজারের পালং খালি শরণার্থী শিবিরে৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
ঘরবাড়ি পোড়ানো
রাবিয়া খাতুন বলেন, ‘‘ঘরের ভেতর মানুষ রেখে বাইরে থেকে সেখানে আগুন ধরিয়ে দেয় মিয়ানমার সেনাবাহিনী৷’’ তিনি বলেন, অনেক মানুষকে তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় দেখেছেন৷ আর ঘর জ্বলতে দেখে মানুষের চিৎকার শুনেছেন৷ ছবিতে বড় ছেলে নূর হাফেসের মাথা আঁচড়িয়ে দিচ্ছেন রাবিয়া খাতুন৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
বাবার বাড়ি পালানো
নিজের গ্রামে সেনাবাহিনীর তাণ্ডব দেখে কিছু জরুরি জিনিস সঙ্গে নিয়ে বাবার বাড়ি পালিয়ে গিয়েছিলেন রাবিয়া খাতুন৷ কিন্তু পরের দিনই সেখানে আবার সেনাবাহিনীর উপস্থিতি দেখতে পান৷ তখন আর কোনো উপায় না দেখে বাংলাদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন তিনি৷ ছবিতে আট মাসের শিশুকন্যা ফাতেমা রাজিয়াকে গোসল করাতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
বাবাকে সহায়তা করত হাফেস
মিয়ানমারে থাকার সময় পাইকারি বাজার থেকে বাবার কিনে আনা পণ্য স্থানীয় গ্রামে বিক্রি করত নূর হাফেস৷ বাংলাদেশে গিয়েও সেরকম কিছু করতে চায় সে৷ কারণ বাবা না থাকায় ছোট ভাই-বোনের কথা ভাবতে হচ্ছে তাকে৷ আট ভাই-বোনের মধ্যে ছ’জনের বয়সই দশের নীচে৷ ছবিতে হাফেসকে মাছ বিক্রি করতে দেখা যাচ্ছে৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
শিশুর মতো আচরণ নয়
হাফেসের মা বলছেন, তিনি জানেন তাঁর ছেলে এখনও ছোট৷ কিন্তু এখনই সে তার দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন বলে জানায় রাবিয়া খাতুন৷ ‘‘এখন সে শিশুর মতো আচরণ করে না’’, বলেন তিনি৷
ছবি: Reuters/A. Abidi
স্কুল আর ফুটবল
ভাগ্যের ফেরে ১২ বছর বয়সেই জীবন সংগ্রামে নামতে বাধ্য হয়েছে নূর হাফেস৷ ছবিতে সাদা শার্ট পরিহিত হাফেসকে ত্রাণের জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যাচ্ছে৷ অবশ্য এখনও বন্ধুদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়া আর ফুটবল খেলার স্বপ্ন দেখে সে৷ রয়টার্সের প্রতিবেদককে অন্তত সেই কথাই জানিয়েছে নূর হাফেস৷